শিখন ঘাটতির ঝুঁকিতে শিক্ষার্থী

ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে টাস্কফোর্স গঠন করুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়

অস্বীকার করার উপায় নেই, দীর্ঘদিন সরাসরি ক্লাসের বাইরে থাকায় শিক্ষার্থীদের বড় ধরনের শিখন ঘাটতি (লার্নিং গ্যাপ) তৈরি হয়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, মাধ্যমিক শিক্ষার্থীর ৩০ শতাংশ শিখন ঘাটতির ঝুঁকিতে রয়েছে। পুনর্বাসন সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ব্যতিরেকে শুধু বিদ্যালয় খুললে শিখন ঘাটতি ঝরে পড়ার ঝুঁকি মোকাবেলা করা যাবে না। অনুমান করা যাচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে থাকায় শিক্ষার্থীদের অনেক বড় অংশ হয়তো আর ক্লাসে ফিরবে না। শিশুশ্রম বৃদ্ধি পেয়েছে, বাল্যবিবাহের হার বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। অনেক পরিবারের জীবনযাপন পদ্ধতিতেও পরিবর্তন এসেছে। ফলে ওইসব পরিবারের শিশুরা স্কুলে না- ফিরতে পারে। এমন সব শিক্ষার্থীকে ক্লাসে ফেরানোর জন্য, বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত শিশু বিভিন্নভাবে ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার জন্য কী কী করা যায়, সে বিষয়ে পরিকল্পনা দরকার। আর পরিকল্পনা প্রণয়ন বাস্তবায়নের জন্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে দ্রুত।

করোনায় সৃষ্ট মানবসম্পদে ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে শিক্ষার্থীদের জন্য কার্যকর বিকল্প সুযোগ সৃষ্টি করা আবশ্যক। এটি নিশ্চিত করার জন্য প্রথম পদক্ষেপটি হলো, শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সঠিক মূল্যায়ন করে মহামারীকালীন ক্ষতি চিহ্নিত করা এবং সে অনুযায়ী তাদের যত্ন নেয়া। অতিরিক্ত ঝরে পড়া এবং শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতি হ্রাস করতে হবে। সংকট মোকাবেলায় ক্ষতিগ্রস্ত পুরো শিক্ষাবর্ষের পুনরাবৃত্তি করা ক্ষতিপূরণের একটি বিকল্প উপায় হতে পারে বলে কেউ কেউ মত ব্যক্ত করেছেন। যেমন কেনিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশের সরকার এরই মধ্যে ঠিক এমনটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্বাস থেকে যে শিক্ষার্থীরা পুরো শিক্ষাবর্ষের পুনরাবৃত্তি করে তাদের সবাই একই মানে মূল্যায়িত হতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে পড়ালেখা শেষ করতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের আরো দু-একটি বছর বৃদ্ধি পাবে বলে এটি শিক্ষার্থীদের মনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। শিক্ষার ক্ষতি পোষাতে কারিকুলামসহ পাঠ্যক্রম হ্রাস এবং সংশ্লেষিত করার কথা বলছেন কেউ কেউ। এমনটি হলে শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ে মনোনিবেশ করতে এবং সেগুলো ভালোভাবে শিখতে সক্ষম হবে। ভারতের ওড়িষা কানাডার অন্টারিও এটি করেছে। বাংলাদেশ শিক্ষা পুনরুদ্ধার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, যার মধ্যে পরের দুই বছরের জন্য একটি সংক্ষিপ্ত সিলেবাস অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যেখানে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গণিত, বাংলা, ইংরেজি বিজ্ঞানের মতো মূল বিষয়গুলোয় মনোনিবেশ করা হবে। কভিড-পরবর্তী সময়ের ক্লাসগুলোয় রুটিনমাফিক পাঠ্যের বাইরে অফ বা গ্যাপ আওয়ারে অতিরিক্ত ক্লাস দেয়ার ব্যবস্থা করাও ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার একটি বিকল্প পদ্ধতি হতে পারে। ম্যাককিনসে-ইউনেস্কোর যৌথ টুলকিট অনুসারে এটি কার্যকর করার প্রধান উপায় হলো, শিক্ষার্থীদের আরো বেশি সময় শেখার সুযোগ দেয়া। এটি বছরের দীর্ঘ ছুটিগুলো কমিয়ে, সাপ্তাহিক ছুটি বাদ দিয়ে বা দিনের শেষে অতিরিক্ত সময় যোগ করার মাধ্যমে হতে পারে। ফিলিপাইনসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশ হারিয়ে যাওয়া সময় পুনরুদ্ধার করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ২০২০ সালে গ্রীষ্মকালীন ছুটির দিনে অতিরিক্ত ক্লাস চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। -জাতীয় কার্যক্রমকে ক্যাচআপ বা রিমেডিয়াল প্রোগ্রাম বলা হয়, যা শিক্ষার ক্ষতি পোষানোর জন্য খুবই ফলপ্রসূ। সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য ছোট ব্রেকআউট গ্রুপ বা ওয়ান-টু-ওয়ান টিউটরিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যেতে পারে। এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যে সরকার একটি জাতীয় প্রশিক্ষণ কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ দিয়েছে, যা সর্বাধিক প্রান্তিক শিক্ষার্থীদের জন্য নিবিড় তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ঘানায় স্কুল ফর লাইফ প্রোগ্রাম স্কুলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি বাড়ানোর জন্য পিয়ার টিউটরিং ব্যবহার করেছে। বার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় শিক্ষাবর্ষের মেয়াদ কমিয়ে আনা শিক্ষার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার একটি ভালো বিকল্প হতে পারে। ইথিওপিয়ায় স্পিড স্কুল মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের প্রথম তিন বছর থেকে ১০ মাসে নামিয়ে এসেছে। নেপালেও এটি নয় মাসে কমিয়ে আনা হয়েছে।

শিখন ঘাটতি মেটাতে সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে বটে। তবে তার মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। স্কুল খুলে দেয়া হয়েছে। তবে গেল দেড় বছরে শিক্ষার্থীরা যে জ্ঞান লাভ থেকে বঞ্চিত হয়েছে, তার ঘাটতি পুষিয়ে নিতে উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি নেয়া হয়নি। পরীক্ষা থেকে শুরু করে পাঠদানে পরিবর্তন আনার চিন্তাভাবনার কথা শোনা যাচ্ছে। তবে তা এখনো কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। বাড়তি পদক্ষেপের মাধ্যমে শিখন ঘাটতি পূরণের কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান হয়নি এখনো। করোনার কারণে শিক্ষার যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে দীর্ঘমেয়াদি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে সম্ভাব্য সব বিকল্প বিবেচনায় নিতে হবে। এতে হয়তো সময়ের ব্যবধানে শিক্ষার সব ধরনের ক্ষতি কভিড-পরবর্তী সময়ে পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি, ব্যক্তিগত সংস্থা, এনজিও এবং সমাজের সুশীল শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যখন যেমনটি প্রয়োজন, সেভাবে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার বিকল্পগুলো কাজে লাগানোই সরকারের পরবর্তী প্রচেষ্টা হওয়া চাই।

গত বছরে অনেক আবশ্যকীয় শিখন দক্ষতা অর্জন না করেই শিক্ষার্থীরা পরবর্তী শ্রেণীতে উঠে গেছে। শিখন ঘাটতি পুষিয়ে নিতে না পারলে মানবসম্পদে তার প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। তাই ঘাটতি দূর করার জন্য অবশ্যই সুনির্দিষ্ট এবং মেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। পরিকল্পনার মধ্যে পূর্ববর্তী শ্রেণীসহ বর্তমান শ্রেণীর শিখন দক্ষতা অর্জনের নির্দেশনা থাকতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার বাইরে থাকার কারণে অনেক শিক্ষার্থীর পড়ালেখার সঙ্গে মানসিক দূরত্বও সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষকদের সময় অনেক বেশি দিতে হবে এবং অবশ্যই পরিশ্রম বাড়বে, তার পরও শিক্ষার্থীদের সব ধরনের শিখন চাহিদা হয়তো পূরণ হবে না। তাই সরাসরি ক্লাসের পাশাপাশি অনলাইন পাঠদান চালু রাখা অপরিহার্য। পাশাপাশি ক্লাসের পড়াকে সাপ্লিমেন্ট করার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে অতিরিক্ত কনটেন্টের আয়োজন থাকলে শিখন ঘাটতি কমানো সহজ হবে। এনসিটিবির কারিকুলাম অনুযায়ী ভাষা, গণিত, বিজ্ঞানসহ অন্যান্য মৌলিক দক্ষতাকে কেন্দ্র করে এসব কোর্স ডিজাইন করা যেতে পারে। শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুটি মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, শিক্ষা বোর্ড এবং এটুআই ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। সঠিক নির্দেশনা পেলে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাই কনটেন্ট নির্মাতা হিসেবে কাজ করতে পারবেন। মানসম্মত কনটেন্টের এমন একটি উন্মুক্ত প্লাটফর্ম থাকলে সেখান থেকে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকবে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশে শিক্ষার্থীদের কতটুকু ক্ষতি হয়েছে, কত শিক্ষার্থী পড়াশোনার বাইরে চলে গেছে কিংবা আদৌ শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে ফিরিয়ে আনা যাবে কিনাএখন পর্যন্ত তার সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের হাতে নেই। বেসরকারিভাবে কিছু তথ্য সংগ্রহ করা হলেও তার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে। শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দু-তিন বছরের জন্য কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়ে এখন থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। তা না হলে ক্ষতির প্রভাব পড়বে দীর্ঘমেয়াদে। চতুর্থ শিল্প বিকল্প উন্নয়নশীল দেশের জন্য গুণগত মানসম্পন্ন যে মানবসম্পদ প্রয়োজন হবে, তাতে সংকট তৈরি হবে। এতে অর্থনীতির গতি স্তিমিত হয়ে পড়তে পারে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন