সাঁওতালদের কৃষিজমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন নয়

অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) এবং বণিক বার্তার যৌথ উদ্যোগে গত ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে আয়োজিত গোবিন্দগঞ্জ বাগদা ফার্মের সাঁওতালসহ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভূমি অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্র নাগরিকদের করণীয় শীর্ষক একটি অনলাইন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচকদেও বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ে ক্রোড়পত্র


দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

সম্পাদক

বণিক বার্তা

অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য সরকার আইন করে আলাদা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন দেয়, গঠন করে বেজা। যতদূর জানি এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে ছয়-সাতটি অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর বাইরে বেসরকারিভাবে প্রিকোয়ালিফিকেশন লাইসেন্স দেয়া হয়েছে ১৭টির মতো। অর্থনৈতিক অঞ্চল করার উদ্দেশ্য ছিল শিল্পায়নকে শৃঙ্খলায় নিয়ে আসা, এক জায়গায় আনা। ধারণা করা হয়েছিল, চীনের সানসেট ইন্ডাস্ট্রিগুলো বাংলাদেশের দিকে আসবে। সরকারি মহলেরও পর্যবেক্ষণ ছিল বিদেশী বিনিয়োগ আসবে। অথচ সেভাবে বিনিয়োগ আকর্ষণ করা যায়নি। এমন একটা প্রেক্ষাপটে আমরা গোবিন্দগঞ্জ নিয়ে আলোচনা করছি। একসময় গোবিন্দগঞ্জে একটা চিনিকল ছিল। তার জন্য সেখানকার আদিবাসী জনগোষ্ঠী সাঁওতালদের কাছ থেকে ষাটের দশকে চুক্তির ভিত্তিতে জমি রিকুইজিশন করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, সেসব জমিতে আখ চাষ হবে। তারপর চিনিকল বন্ধ হয়ে গেলে তাদের জমি ফিরিয়ে না দিয়েই সেখানে একটা অর্থনৈতিক অঞ্চল করার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল করার আগে সম্ভাব্যতা যাচাই (ফিজিবিলিটি স্টাডি) খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওই এলাকায় একটা অর্থনৈতিক অঞ্চল করলে আসলেই সেখানে শিল্পায়ন হবে কিনা, সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার।

গোবিন্দগঞ্জে যে অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তার জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছে এমন কোনো সরকারি নথিপত্র চোখে পড়েনি। সেখানকার জেলা প্রশাসন থেকে একটা প্রস্তাব দেয়া হয়েছে কিন্তু গোবিন্দগঞ্জ আদৌ শিল্পায়নের জন্য উপযুক্ত কিনা, সে রকম কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। চিনিকল বন্ধ হওয়ার পরে ওই অর্থে সেখানে বাস্তবে কোনো শিল্প-কারখানা নেই। সুতরাং সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া সেখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল করার প্রস্তাব সুচিন্তিত পরিকল্পনার ফসল নয়। ২০১৫ সাল থেকে সেখানে আন্দোলন চলছে এবং সেটা জাতীয় পর্যায়ে উঠে এসেছে। সরকারের পক্ষে সেখানে কোনো শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব কিনা, তা নিয়েও যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কারণ গত ৫০ বছরে গাইবান্ধায় সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে বড় কোনো শিল্প গড়ে ওঠেনি। কাজেই বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিরা আরো ভাববেন বলে আমাদের প্রত্যাশা। যাদের জমি তাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার যে অঙ্গীকার ছিল, সরকারি উচ্চমহল স্থানীয় প্রশাসন তাকে সম্মান করবে। আসলে যেকোনো জায়গায় শিল্প বা অর্থনৈতিক অঞ্চল করার আগে পূর্বশর্ত হলো পরিবেশ সমীক্ষা করা, সম্ভাব্যতা যাচাই করা, স্থানীয়ভাবে টিকে থাকতে পারবে কিনা, জাতীয় বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলের সঙ্গে সংযোগ তৈরি সম্ভব কিনা, তা খতিয়ে দেখা। গোবিন্দগঞ্জের ক্ষেত্রে এসব বিষয় যাচাই করে দেখা প্রয়োজন।

 

শামসুল হুদা

নির্বাহী পরিচালক এএলআরডি

গোবিন্দগঞ্জে একটা চিনিকল ছিল। তার জন্য সাঁওতালদের জমি রিকুইজিশন করা হয়। তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে রিকুইজিশন আইন নামে একটি আইন ছিল। সেই আইন অনুযায়ী রিকুইজিশন করা হয়েছিল। জমি রিকুইজিশন করার পরে সেখানে চিনিকল গড়ে তোলা হয়। ১৯৬২ সালে ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের (ইপিআইডিসি) সঙ্গে সরকারের একটি চুক্তি হয়। চুক্তির একটি শর্ত ছিল, চিনিকলের প্রয়োজনীয় আখ চাষের জন্য জমি ব্যবহার করা হবে। কোনো দিন যদি সেটি আর প্রয়োজন না হয় তাহলে তা পূর্বতন মালিকের কাছে ফেরত দেয়া হবে। এটা হলো সরকারের চুক্তি। জোর করে আদায় করা কিছু নয়। দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের অনেক চিনিকলের মতো গোবিন্দগঞ্জের চিনিকলটিও ২০০৪ সালে বন্ধ হয়ে যায়। তার পর থেকে আজকে ২০২১, প্রায় ১৭ বছর জমিটি সেখানে আছে। কর্মকর্তারা সেখানে বহাল তবিয়তে আছেন। তাদের কাজ নেই। কারণ সেখানে উৎপাদন নেই। কোনো শ্রমিক নেই। তাদের চাকরি চলে গেছে। অথচ কর্মকর্তারা সুযোগ-সুবিধা, বেতন সবই ভোগ করছেন। রকম একটা অবস্থায় যাদের জমি নেয়া হয়েছিল তাদের বংশধররা গণতান্ত্রিকভাবে, ন্যায়সংগতভাবে একটা আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাদের দাবি ছিল, চুক্তি অনুযায়ী জমি ফেরত দিতে হবে। যেহেতু সেখানে আর আখ চাষ হচ্ছে না। এর মধ্যে ২০০৪ সালের পর থেকে চিনিকল কর্তৃপক্ষ জমি লিজ দেয়া শুরু করে। যাদের পছন্দ হয় তাদের লিজ দেয়। কত টাকা সরকারি কোষাগারে এসেছে, তা আমরা জানি না। কিন্তু জমিগুলো অনেকটা কর্মকর্তাদের ভোগদখলে চলে যায়। সংগত কারণে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী কিছু বাঙালি পরিবার, যাদের জমি সেখানে ছিল তারা সবাই মিলে একটা আন্দোলন গড়ে তোলেন। সেই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে একটা তদন্ত হয়। একজন এডিসি রেভিনিউ বিষয়টি তদন্ত করেন। তিনি এর সত্যতা তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন। এখানে আর আখ চাষ হচ্ছে না। অন্য ফসল আবাদ হচ্ছে। যেহেতু কল বন্ধ হয়ে গেছে সেহেতু জমি ফেরত দেয়া হোক। যারা দাবি করছেন, তাদের মধ্যে বংশধররা রয়েছে। এগুলো সবই ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু রহস্যজনকভাবে জেলা প্রশাসন থেকে কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে যে অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ওটা বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে। কারণ এটা হলে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী গরিব বাঙালি পরিবারকে জমি আর ফেরত দিতে হবে না। জেলা প্রশাসন একাট্টা যে কোনোভাবেই তাদের জমি ফেরত দেয়া যাবে না।

২০১৬ সালে আন্দোলনটা বড় আকার ধারণ করে। সরকার মারমুখী হয় এবং সেখানে হত্যাকাণ্ড ঘটে। আগুন জ্বালিয়ে সাঁওতালদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয়, সরকারের ইউনিফর্ম পরা কিছু লোকও আগুন লাগানোর কাজে অংশ নেয়। গুলি চালানো হয়। আন্দোলনরত অবস্থায় ওইদিন তিনজন সাঁওতাল আদিবাসী শহীদ হন। পুলিশ মামলা নেয় না, তদন্ত করে না, অপরাধীদের আড়াল করার জন্য নানা রকম ফন্দিফিকির করে। তখন আমরা বাধ্য হয়ে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হই। আইন সালিশ কেন্দ্র, ব্রতী এএলআরডি মিলে একটা রিট পিটিশন দায়ের করে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে ঘটনার ২০ দিন পর অভিযোগগুলো তাদের গ্রহণ করতে হয়েছে। আগে একটা সাজানো অভিযোগ পেশ করা হয়েছিল। আদালত বলেছেন, দুটো অভিযোগই সমান গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করতে হবে। সঠিকভাবে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে হবে।

আন্দোলনের পর সাঁওতালরা ওই জমিতে বসবাস শুরু করে। যেহেতু তাদের অনেকেরই ঘরবাড়ি নেই, সেহেতু তারা সেখানে ঝুপড়ি বা বস্তির মতো করে থাকতে শুরু করে। তারা দাবি জানিয়ে এসেছেন, আইনগতভাবে এটা সরকার আমাদের যতক্ষণ না দিচ্ছে ততক্ষণ একসনা ভিত্তিতে লিজ দেয়া হোক। আমরা তো এটা উৎপাদনশীল রাখছি। সেখানে বছরে তিন বা চার ফসলি জমিও রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার নির্দেশনা দিয়েছেন, তিন-চার ফসলি জমিতে কৃষি ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না। শিল্প বা কোনো প্রকল্পের কাজে নেয়া যাবে না। কিন্তু প্রশাসন সেটিকে তোয়াক্কা না করে নানা রকম ফন্দিফিকির আঁটছে। সম্প্রতি তারা বেজা কর্তৃপক্ষকে নিয়ে গেছে, এখানে কীভাবে অর্থনৈতিক অঞ্চল করা যায়। দীর্ঘদিন ধরে যে আন্দোলন চলছে, তার মামলাগুলো কিন্তু আদালতে বিচারাধীন। আমরা জানি, মামলা নিষ্পত্তি হতে আদালতে অনেক সময় লাগে। নিম্ন উচ্চ আদালত উভয় জায়গায় মামলা আছে। আইনের প্রতি ন্যূনতম সম্মান না দেখিয়ে তারা সেখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল করার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে। ফলে এক ধরনের শঙ্কা উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। এর আগে আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে একটা বিবৃতি প্রকাশ করেছি। কিন্তু তারা তাতে বিরত হয়নি। পরিশেষে কয়েকটি দাবি উত্থাপন করছিঅবিলম্বে গোবিন্দগঞ্জের বাগদা কৃষি ফার্মে ইপিজেড স্থাপনের প্রকল্প বাতিল ঘোষণা করতে হবে; বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন মামলাগুলো নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কৃষিকাজ অব্যাহত রাখতে সাঁওতাল দরিদ্র বাঙালি পরিবারের কাছে অস্থায়ীভাবে একসনা ইজারা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল ইস্যুতে চলমান মামলাগুলোর নিষ্পত্তি সাপেক্ষে রিকুইজিশন-পূর্ববর্তী জমির মালিক সাঁওতালদের উত্তরাধিকারী পরিবারগুলোকে স্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া ২০১৬ সালে আন্দোলনে নিহত সাঁওতাল পরিবার এবং আহতদের পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

 

কমরেড পঙ্কজ ভট্টাচার্য

সভাপতি

ঐক্য ন্যাপ

আজকের আলোচনায় বর্তমান সময়ের উপযোগী কিছু প্রস্তাব রয়েছে। ২০১৬ সালে আমি আশঙ্কা করছিলাম আন্দোলনটা একটা রক্তক্ষয়ী সংঘাতের দিকে যাবে এবং প্রাণহানি ঘটবে। এমন এক প্রেক্ষাপটে আমি তখনকার শিল্পমন্ত্রীকে অনুরোধ করি, রক্তপাত হতে দেবেন না। শান্তিপূর্ণ আলোচনায় যা বেরিয়ে আসবে তার ভিত্তিতেই সমাধান করুন। আমরা সহযোগিতা করব। তিনি খুব উত্তেজিত হয়ে বলেছিলেন, আমরাও দেখে নেব তারা কীভাবে ওখানে থাকে। আমরা তাদের উচ্ছেদ করব। প্রয়োজনে ঢাকা থেকে বিশেষ বাহিনী পাঠাব। আমি তখন ওখানকার সিনিয়র রাজনীতিবিদ ডেপুটি স্পিকারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে দেখা করলাম। বিস্তারিত বললাম। তিনি আমাকে কথা দিলেন যে রক্তপাত নয়, শান্তিপূর্ণ উপায়ে এটি সমাধানের চেষ্টা করা হবে। কথা সত্ত্বেও ২০১৬ সালের নভেম্বর শুরু হলো গোলাগুলি। সেখানে এমপি সাহেবের ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়। সেদিন আমি ডেপুটি স্পিকার সাহেবকে ফোন করে বললাম, আপনি হস্তক্ষেপ করুন। তখন গোলাগুলি চলছে। তিনি তখন বললেন, আমি রেস্ট হাউজে আছি। ঢাকায় এসে আপনার সঙ্গে কথা বলব। তিনি আর কথা বলার প্রয়োজন বোধ করেননি। এই ছিল আমার রাষ্ট্রের

ব্যবহার। আজকের আলোচনায় রাষ্ট্র নাগরিকের কর্তব্য এবং যে সমাধানগুলো দেয়া হয়েছে, তার সঙ্গে আমি অনেকাংশেই একমত। আমার কথা পরিষ্কার, চিনিকল স্থাপনের সময় যে চুক্তি হয়েছিল, আখ চাষ না হলে এবং অন্য ফসল চাষ হলে করপোরেশনের জমি সরকারের কাছে ফেরত যাবে এবং সরকার প্রকৃত মালিকদের জমি ফেরত দেবে। আমি চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছি। এখানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার যে প্রস্তাব সরকারকে দেয়া হয়েছে, তা বেআইনি। এটি মানবাধিকারবিরোধী। এটা জনগণের স্বার্থবিরোধী। এটা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের বিরোধী। প্রধানমন্ত্রী বারবার বলেছেন, দোফসলি বা তিন ফসলি জমিতে কোনো স্থাপনা হবে না। 

সেদিন পুলিশের গুলিবর্ষণ বেআইনি ছিল। কোনো আইনসংগত কাগজপত্র তাদের ছিল না। সেদিন সাঁওতালদের বাড়িতে পুলিশ আগুন লাগিয়েছে। এটা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম তুলে ধরেছিল। তারপর আমার দেশের প্রচারমাধ্যম তা লুফে নেয় এবং প্রচার করে সাঁওতালদের বাড়িতে পুলিশ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। ঘটনার এখনো বিচার হয়নি। অথচ হাইকোর্ট বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে সরকারের নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন, সাঁওতালদের পুনর্বাসনের কথা বলেছেন এবং উৎপাদিত ফসল তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিতে বলেছেন। জেলা প্রশাসক পুলিশ সুপার দুজন হাইকোর্টে ক্ষমা চেয়েছেন। রাষ্ট্র যেখানে ক্ষমা চেয়েছে, সেখানে সেই রাষ্ট্র ভুল সংশোধন করবে দাবি জোরদার হওয়া উচিত। 

 

খুশী কবির

সমন্বয়কারীনিজেরা করি;

চেয়ারপারসনএএলআরডি

চিনিকল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর চিনিকল কর্তৃপক্ষ, সরকার কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি জমি ফেরত না দিয়ে সেটিকে বাণিজ্যের দিকে নিয়ে যেতে চাইছেন। আমরা অধিগ্রহণের নথিপত্রগুলো দেখেছি, সেখানে সাঁওতালের অধিকাংশ নামই আছে। কিছু বাঙালি নাম রয়েছে। সেখানে স্পষ্ট লেখা আছে আখ চাষ না হলে সেটা ফেরত দেয়া হবে। সেটা না করে তারা এটাকে বাণিজ্যের দিকে নিয়ে যেতে চাইছিল, তখনই আন্দোলন হয়েছে। আন্দোলন চলাকালে সংঘাত হয়েছে, কয়েকজনকে হত্যাও করা হয়েছে। এর আগে আমরা জড়িত ছিলাম। আলোচনায় ছিলাম। সেখানকার নেতারা আমাদের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য আসতেন। তখন আমরা সশরীরে গিয়ে সেখানকার অবস্থাটা দেখেছি। সংবিধান আমাদের বলছে, জনগণই রাষ্ট্রের মূল শক্তির উৎস। তাহলে তো জনগণের পক্ষে আইনগুলো হবে, জনগণের জন্য যেটা সুবিধা হয় তার আলোকেই কর্মসূচি নেয়া উচিত। রাস্তাঘাট, অবকাঠামো, শিল্প সবই জনগণকে সুবিধা দেয়ার জন্য, দেশকে উন্নত করার জন্য করা হচ্ছে। মুষ্টিমেয় কারো সুবিধার জন্য এটা করা হচ্ছে না। আমাদের নীতিমালাও আছে। আইনও আছে যে কোনো কিছু নির্মাণ করতে হলে কোন জমি অধিগ্রহণ করা যাবে আর কোনটা যাবে না। অনেক কিছু আছে। এসবের তোয়াক্কা না করে কিছু ব্যক্তি নিজেদের  মুনাফার স্বার্থে সংবিধানকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন, আইনকেও দেখাচ্ছেন, নীতিমালাকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন। এখানে আমার প্রশ্ন, সরকার কোথায়? তাদের ভূমিকাটা কী? একজন সংসদ সদস্য তো গোটা সরকারকে প্রতিনিধিত্ব করেন না। সেখানে আইন, নিয়মনীতি, সংবিধান সবকিছুর পরিপ্রেক্ষিতেই কাজ করতে হবে। সব শেষে বলব, আমাদের আদিবাসী প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, কৃষক, যাদের আমরা আমলে নিই না কিন্তু তারাই সবচেয়ে বেশি ফসল ফলাচ্ছেন। কৃষিই আমাদের বাঁচিয়ে রাখছে। আমাদের খাদ্যের জোগান দিচ্ছে। কৃষিই যারা করছেন, তাদের বাদ দিয়ে আমরা যা করতে চাইছি, সেখানে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হচ্ছে। মানুষের জীবন একেবারে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। তাদের জীবিকা থাকছে না। যেখানে নাগরিকদের ন্যূনতম অধিকার তথা বাঁচার অধিকার যদি দিতে না পারি  সেখানে আমরা কিসের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি? এটাই আমার সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। যেভাবে অনিয়ম, অপচয়, অব্যবস্থাপনা হচ্ছে তা মানুষের মঙ্গল ব্যাহত করছে। একদল ব্যক্তি রাষ্ট্র, সংবিধান, জনগণ, আইন সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কৃষি জমিতে ইপিজেড করছে। মানুষের যদি জীবন-জীবিকারই নিরাপত্তা না থাকে, তাহলে অর্থনৈতিক জোন দিয়ে কী হবে? এসব কার জন্য হবে? আমরা চাই মানুষের ন্যূনতম অধিকার জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক। এটাই হোক আমাদের সুবর্ণজয়ন্তীর অঙ্গীকার।

 

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান 

প্রধান নির্বাহী, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি

(বেলা)

আমি সাঁওতালদের আজকের বিষয়ে আলোচনার আগে একটা বিষয় বলব। প্রায় সাত বছর ধরে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। নারায়ণগঞ্জে সোনারগাঁয় কৃষিজমি জলাভূমি ভরাট করে প্রথমে ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট গড়ে তোলার চেষ্টা করা হলো। তার পরে সেখানে যখন উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা এল, ওই নিষেধাজ্ঞা বাইপাস করার জন্য বেজা থেকে একটা কাগজ আনা হলো। বলা হলো, জমিতে এখন একটা অর্থনৈতিক অঞ্চল করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। আগে ছিল সোনারগাঁ হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট। যে জমিতে হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টের নিষেধাজ্ঞা আছে, সেখানে তারা অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য একটা প্রিকোয়ালিফিকেশন লাইসেন্স নিয়ে চলে এল। প্রিকোয়ালিফিকেশন লাইসেন্সের জন্য তারা আবেদন করল এবং বলা হলো তাদের হাজার ২০০ একর জমি আছে। বেজা যখন অনুমতি দিল তখন মাত্র ৫৫ একর জমিতে প্রিকোয়ালিফিকেশন লাইসেন্স দিয়ে বলল, বাকি জমি ধীরে ধীরে অধিগ্রহণ করবে। ১০০ একরের জমি না হলে নাকি ইকোনমিক জোন করতে দেবে না। যাই হোক, দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পরে রায় আমাদের পক্ষে এল। অর্থনৈতিক অঞ্চল অবৈধ ঘোষণা করা হলো। কারণ সেখানে জলাশয় কৃষিজমি ভরাট করা হচ্ছিল। তখন আদালত একটা শর্ত দিলেন যে এখন থেকে অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য আবেদন করতে হলে আগে থেকে পরিবেশগত ছাড়পত্র দাখিল করতে হবে। পরিবেশগত ছাড়পত্র দেশে কীভাবে হয়, সেটি আমরা সবাই জানি। এটা আমি এজন্য বলছি, অর্থনৈতিক অঞ্চল বলে যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আমাদের দেশে শুরু হয়েছে, এর কিন্তু কোনো স্ট্র্যাটেজিক, এনভায়রনমেন্টাল অ্যাসেসমেন্ট হয়নি। এখন শোনা যাচ্ছে চিনিকল কর্তৃপক্ষ জেলা প্রশাসন থেকে গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্মে একটা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রস্তাব এসেছে। এটা নিয়ে বেজার একটি তদন্ত দল ফিজিবিলিটি টেস্ট করেছে বলে একটা রিপোর্টে বলা হয়েছে। বেজা না ভূমির কোনো ছাড়পত্র দেয়ার ক্ষমতা রাখে, না সে পরিবেশের কোনো ছাড়পত্র দেয়ার ক্ষমতা রাখে। যত কাজ করি, দেখি যে সমস্যা দিনকে দিন তীব্র হচ্ছে। একটি বিষয়ে লড়াই করে ভাবি, যেহেতু একটা সমাধান এসেছে সেহেতু এখন থেকে বিষয়টি সহজ হবে। দেখা যায়, বিষয়গুলো আরো জটিল হতে থাকে। কারণ আমরা যা বলি, তার সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনার কোনো সম্পর্ক নেই। সংবিধানে কী আছে এবং রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হয়, তার কোনো সম্পর্ক নেই। সংবিধানও কি খুব জোরেশোরে আদিবাসী কথাটা বলেছে? তাদের একটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু জাতিসত্তা হিসেবে তাদের স্বীকৃতি কি সংবিধানে এসেছে। তাদের স্বীকৃতি দেয়ার যে অঙ্গীকার আছে, সেটি নিয়ে গর্বিত হওয়ার কী আছে! আমাদের সংবিধানে কি আরো স্পষ্ট করে বলতে পারতাম না? তারা কি আমাদের অংশ নয়? তাদের তো আমরা অস্বীকার করতে পারব না। স্বীকারই যদি করি, তাহলে রকম দৈন্য রেখে স্বীকার করাটা আমার কাছে বোধগম্য নয়। সাংবিধানিক ওই প্রতিশ্রুতি নিয়ে আমি মোটেই উত্তেজিত নই, খুব বেশি আশাবাদীও নই।

আমাদের মূল জায়গায় হাত দিতে হবে। আমাদের দাবি তুলতে হবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এবং অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও আমাদের কথা শুনতে হবে। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের কথা শুনতে হবে। কথাগুলো একসঙ্গে না বলে আমরা আসলে বিচ্ছিন্নভাবে বলে যাচ্ছি। আশা করি, এটিই পরবর্তী সময়ে প্রতিফলন হবে। কিন্তু তা হয় না। সমস্যা তো সমাধান হচ্ছে না। কোন আইন অনুযায়ী রিকুইজিশন করা সম্পত্তি তার আসল মালিককে ফেরত দেবে না? এটা অ্যাকোয়ার করা সম্পত্তি নয়, এটা রিকুইজিশন করা সম্পত্তি। এটা যে উদ্দেশ্যে নেয়া হবে, সে উদ্দেশ্য শেষ  হয়ে গেলে বা ব্যবহার না হলে ফেরত যাবে আসল মালিকের কাছে। আইনগত দিকটা আরো ভাবনা-চিন্তা করে, কৌশল করে আমরা যদি কোর্টে যাই তাহলে আমি আশা করি, ইস্যুতে কোর্ট থেকে আমরা প্রতিকার পাব। কারণ কোর্টের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ আমাদের পক্ষে আছে। এখন একটা স্থগিতাদেশ দেয়া যাতে সাঁওতালদের দাবি না মেটানো পর্যন্ত উক্ত ভূমি অন্য কোনো কাজে লাগানো না হয়। আমাদের মূল বক্তব্য এখন এই একটাই। দেখা যায়, একটি বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলার পর হয়তো এর সমাধান হয়েছে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে আরো জটিল সমস্যা আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এভাবে বিচ্ছিন্নভাবে কয়টা সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পারব আমরা? সমস্যা তো দিনকে দিন বেড়েই চলছে। তাই আমাদের একটাই দাবিরাষ্ট্রকে আমাদের কথা মূল্যায়ন করে এগোতে হবে। নয়তো এভাবে বিচ্ছিন্নভাবে কথা বলে খুব একটা লাভ আছে বলে মনে হয় না।

 

সিরাজুল ইসলাম বাবু

সাধারণ সম্পাদক, গাইবান্ধা জেলা বার অ্যাসোসিয়েশন

২০১৬ সালের নভেম্বরের পর আদিবাসীদের ওপর যারা নির্যাতন করেছে, হত্যা করেছে, অগ্নিসংযোগ ঘটিয়েছে, পিবিআই সিআইডির চার্জশিটে তাদের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসেবে দেখানো হয়েছে। আসামি হিসেবে দেখানো হয়নি।  কতটা ভয়াবহ ব্যাপার, আসামিরা সাক্ষী হয়ে গেছে। আর আমরা বিচার পাচ্ছি না। এই হলো অবস্থা। আমরা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আড়াই মাস পরে ফরোয়ার্ড ডেট দিলেন। তাকে আমরা কাগজপত্র, রুলিং, যত কিছু সাপোর্ট দেয়া দরকার, দিয়েছি। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, এই যে ৯০ জন আসামিনা সিআইডি না পিবিআই, তদন্ত কার্যক্রমে তাদের ধরল না; গ্রেফতার করল না, রিমান্ড চাইল না। ওয়ান সিক্সটি ফোরেও ধরল না। আদিবাসী জনগোষ্ঠী বা সাঁওতালদের বিষয়ে ধরনের যে দায়সারা গোছের কার্যক্রম চলছে, সে বিষয়ে আমি চরম হতাশা ব্যক্ত করছি। আমরা বিচার চেয়েও বিচার পাচ্ছি না। আমাদের উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণও ছিল।

২০১৬ সালের নভেম্বর আমাদের তিনজন নিহত হলো। অনেকেই চোখ হারাল, অনেকেই পঙ্গু হয়ে গেল, অনেকেই গুলিবিদ্ধ হলো। ঘরবাড়ি উচ্ছেদ হলো, লুটপাট হলোএগুলো তো হলোই। অথচ ওই দিনই যারা আন্দোলন করছিল, তাদের বিরুদ্ধে এবং সাঁওতালদের পক্ষে যেসব বাঙালি ছিল, তাদের ৪৬ জনকে আসামি করে মামলা দেয়া হয়েছে। সে মামলাগুলো আমরা আদিবাসী সাঁওতালরা মোকাবেলা করছি। এটা একটা দুঃখজনক ইতিহাস। বাস্তবতায় এখানে আলোচনা হলো ইপিজেড, বেপজা ইত্যাদি নিয়ে। ইপিজেডের পরিকল্পনা দীর্ঘদিন ধরে করা হয়েছে। আমি এটিও শুনেছি, এই ভূমি এরই মধ্যে চিনিকল কর্তৃপক্ষ থেকে হস্তান্তর করা হয়েছে। চুক্তিতে এটা বলা ছিল, কোনো সময়ই জমি অন্য কাউকে হস্তান্তর করা যাবে না। এটা সরকারকে হস্তান্তর করবে। সরকারের দায়িত্ব হলো, রিকুইজিশন বিধিমূলে জমিটা তার আগের মালিককে ফেরত দেয়া। সেই ভূমিতে তারা ইপিজেডের ঘোষণা দিল। বেজা পরিদর্শন করে গেছে। জায়গায় আমরা অবস্থান করছি, যেকোনো সময় সেখানে কার্যক্রম শুরু হবে। সুতরাং আমাদের মনে হয় একটু ভিন্নভাবে সজাগ থাকা দরকার। আইনি লড়াইয়েও আমরা সুফল পাচ্ছি না। আমাদের জাতিগোষ্ঠীর সংকট তীব্রতর হচ্ছে। জাতিসত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ২০১১ সালে সরকার তাদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলা শুরু করল। তারা কোনো আদিবাসী নয়। সব মিলিয়ে আমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে সংকটে ফেলে দেয়া হয়েছে। সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে হবে। আদিবাসী এবং আমরা বাঙালিরা মনে করি, এখানে ইপিজেড করার বাস্তবতা নেই। আগের এক ডিসি সাহেব পলাশবাড়ী থানাধীন সাকুয়া নামের এক জায়গায় ইপিজেড করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ধরনের একটি বিকল্প প্রস্তাব আমাদের রয়েছে। পরে প্রস্তাব আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়ে সাঁওতাল পল্লীর দিকে কীভাবে নজর গেল, তা আমরা বুঝতে পারিনি। যদি পলাশবাড়ীতে সাকুয়া ব্রিজের কাছে ইপিজেড স্থাপন করতে পারতাম তাহলে সেখান থেকে মহাসড়ক, রেলপথ, পানিপথসব পথেই বাণিজ্য সুবিধা পাওয়া পেত। এমনকি অন্য আনুষঙ্গিক অর্থনৈতিক কাঠামোগুলো সেখানে রয়েছে। রকম একটা সুবিধাজনক অবস্থা থেকে আদিবাসী পল্লীর দিকে যে ইপিজেড নেয়া হচ্ছে, তাতে গাইবান্ধাবাসী খুব একটা উপকৃত হবে না। কারণে আমি মনে করি, সেখানে ইপিজেড স্থাপনের কোনো বাস্তবতা নেই। সেখানে ইপিজেড করলে আদিবাসীরা তো ক্ষতিগ্রস্ত হবেই, গাইবান্ধার উন্নয়নও থমকে যাবে। আসলে সেখানে উন্নয়নের নামে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে।

 

সঞ্জীব দ্রং

সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম

আমরা রাষ্ট্রকে যেভাবে চেয়েছিলাম, রাষ্ট্র সেভাবে আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারছে না। রাষ্ট্র সাঁওতালদের কাছ থেকে, আদিবাসীদের কাছ থেকে, ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘু মানুষের কাছ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। সংবিধান পড়লে খুব ভালো লাগে। এখানে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা আছে। আইনের চোখে সবাই সমান। কারো প্রতি বৈষম্য করা হবে না। রকম সুন্দর সুন্দর কথা আছে। কিন্তু আমরা আদিবাসী মানুষ, প্রান্তিক মানুষ বঞ্চিত। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে সংবিধানের কথামালা সংবিধানের শোভা-অলংকার হয়ে আছে, বাস্তবে আদিবাসী, জাতিগত ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষের দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। এই যে সাঁওতাল তিনজনকে মেরে ফেলা হলো, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হলো, কোনো বিচার তো হলো না। রকম অনেক উদাহরণ আমরা দিতে পারি। কিন্তু আমি যন্ত্রণার কথাগুলো খুব বেশি বলব না। আমরা সবাই জানি, আমাদের দেশে অনেক উন্নয়ন হচ্ছে। এটিকে অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন বলা হচ্ছে। উন্নয়ন হলো রাস্তাঘাট, ভবন প্রভৃতি। আমরা একদিকে উন্নয়নের আস্ফাালন দেখছি, অন্যদিকে দেখছি ব্যাপক বৈষম্য। অবস্থায় প্রান্তিক মানুষদের, সাঁওতাল আদিবাসীদের, পাহাড়ি মানুষদের জীবনে হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আমি আর কিছুই দেখছি না। এখন তো আমরা দেখছি যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারও হচ্ছে না। সাঁওতালদের ক্ষেত্রেও তা- হচ্ছে। একটা দেশ-সমাজ কতটা সভ্য, গণতান্ত্রিক, মানবিক, তার অন্যতম বিচার্য বিষয় হলো সেই সমাজ-রাষ্ট্রে প্রান্তিক-আদিবাসী-সংখ্যালঘু মানুষ কেমন আছে। এখন আমরা উন্নয়নের কথা বলছি। অথচ সাঁওতালদের কথা ধরুন। উন্নয়ন দূরে থাক, তাদের তো জীবনধারণই কঠিন হয়ে পড়ছে। একজন সংখ্যালঘু মানুষ যদি বলে যে ভালো আছি, তাহলে বুঝব যে আমরা ভালো আছি। খাসিয়াদের ঐতিহ্যগত বংশানুক্রমিক জায়গায় বন বিভাগ সামাজিক বনায়নের নামে জোর করে গাছ লাগাচ্ছে। সাইনবোর্ডে লেখা আছে জায়গায় দেড় লাখ গাছ লাগানো হবে। খোঁজ করলে দেখা যাবে, সেখানে আদৌ সেই পরিমাণ গাছ লাগানো হয়নি কিংবা গাছ লাগানোর পর এক মাস-দুই মাস পর সেখানে তা থাকে না। সরকার আদিবাসীদের জন্য একটা কমিশন গঠন এবং একটি সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন করার অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু তাতে কোনো অগ্রগতি নেই। আমি সমতলের আদিবাসী মানুষ। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সমতলের আদিবাসীদের জন্য একটি ভূমি কমিশন করা হবে। বিষয়েও কোনো অগ্রগতি নেই। বিষয়ে কোনো বৈঠক হয় না। কোনো বৈঠকে আমাকে ডাকাও হয় না। আমি চাই, রাষ্ট্র প্রান্তিক আদিবাসী মানুষের পাশে দাঁড়াবে। দাঁড়িয়ে প্রমাণ করবে রাষ্ট্র তাদের কাছ থেকে দূরে চলে যায়নি। রাষ্ট্র এখনো সাম্যের কথা বলছে। বিশ্বাস করতে চাই, রাষ্ট্র এখনো সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা ভুলে যায়নি, যা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল। বাংলাদেশের সব মানুষের জন্য আমরা সাম্য, মানবিক মর্যাদা সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করব অঙ্গীকার করা হয়েছিল। আমি মনে করি, সাঁওতালদের, আদিবাসীদের শ্রদ্ধা সম্মান জানালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র মহিমান্বিত হবে। আমি চাই পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন হোক। আদিবাসীদের জন্য একটি মন্ত্রণালয় গঠিত হোক। আর সাঁওতালসহ সবার ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য অবিলম্বে ভূমি কমিশন গঠন করা হোক। ভূমি কমিশন গঠন না করা পর্যন্ত একটা প্রজ্ঞাপন জারি করা হোকআদিবাসীদের নিজস্ব জায়গাজমি থেকে কোনো রকম উচ্ছেদ করা যাবে না; তাদের হয়রানি করা যাবে না। রকম প্রজ্ঞাপন অবিলম্বে জারি করা হোক। আমাদের রাষ্ট্র এগিয়েছে কিন্তু আদিবাসীদের জীবনে হাহাকার ছাড়া তো আর কিছুই দেখছি না। তাদের হত্যা করে ফেলা হচ্ছে কিন্তু বিচার হচ্ছে না। তাহলে এটা কেমন উন্নয়ন? সংখ্যালঘুদের জীবন ধারণই তো কঠিন হয়ে পড়ছে, রাষ্ট্র কবে আন্তরিক হবে?

 

সুলতানা কামাল

মানবাধিকারকর্মী

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

আজকের ওয়েবিনারের প্রশংসনীয় দিক হলো এর মধ্যে আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পেরেছি। আমরা জানি যে আমরা যখন সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলতে বসি, সেটি হিন্দু সম্প্রদায় হোক, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হোক কিংবা নারী হোক, দুঃখের বিষয় হলো দীর্ঘদিন ধরে একই কথা বলে যেতে হচ্ছে। এসব কথার বাইরে আর আমরা যেতে পারছি না। আমরা যে লড়াই করে দেশের স্বাধীনতা অর্জন করলাম, যেভাবে আমাদের সামনে এগোনোর কথা ছিল, সেভাবে এগোতে পারলাম না। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার পর যেভাবে এগোনোর কথা ছিল, আমরা সেভাবে এগোতে পারিনি। প্রেক্ষিতটা আমরা সবাই জানি। কীভাবে বাগদা ফার্মের ভূমি অধিগ্রহণ করা হলো। সেটা যাদের ফেরত দেয়ার কথা, তাদের ফেরত দেয়া হলো না। সেটি নিয়ে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করার পরে আমরা কয়েকজনের হত্যাকাণ্ড দেখলাম। পুলিশের দুষ্কৃতকারীদের মতো আচরণও আমরা দেখেছি। আজকে বিষয়টা দাঁড়িয়েছে এই, যে মামলা করা হয়েছে, সেটি এখনো চলমান। শেষ পর্যন্ত যে ফলাফল, তা আমরা এখনো পাইনি। মামলা চলমান থাকা অবস্থায় ইপিজেড করার উদ্যোগের ক্ষেত্রে আদালত অবমাননার মামলা করা যায় কিনা তা যাচাই করে দেখা যেতে পারে। আমরা এটাকে ডিসপুটেড ল্যান্ড বলতে পারি কিনা। যেহেতু মামলা চলমান সেহেতু এটা একটা ডিসপুটেড ল্যান্ড। এর ওপর অন্য কিছু হতে পারে কিনা।  আজকের আলোচনায় মোটাদাগে যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হলো সাঁওতালদের কৃষিজমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো জমিটি নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। মামলা চলমান এমন জমিতে অন্য কোনো পরিকল্পনা নেয়া কতটা আইনসম্মত, তা খতিয়ে দেখতে হবে। এখানে আদালত অবমাননা হচ্ছে কতটুকু, তাও খতিয়ে দেখা দরকার। আমরা একসময় হয়তো মৃদু ভাষায় কথা বলেছি। এখন চিত্কার করা ছাড়া উপায় নেই। আমরা এখন চিত্কার করেও বলার চেষ্টা করছি, কিন্তু কেউ শুনছে না। কিন্তু শোনানোর চেষ্টাটা আমাদের করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। দীর্ঘদিন ধরে সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছি। এক্ষেত্রে আইনগত যে সুযোগগুলো আছে, আমরা সেটিও নিতে পারি। ইদানীংকালে কয়েকটা ঘটনায় আইন-আদালতের প্রতি আমাদের আস্থা কিছুটা হলেও বাড়ার কথা। পরী মনির রিমান্ড নিয়ে যে রকমভাবে নির্দেশনাগুলো পেয়েছি, তা দেখে মনে হচ্ছে হয়তোবা কোথাও কোথাও সুযোগ থাকতে পারে। খুবই শঙ্কার তথ্য উঠে এসেছে যে সাঁওতালদের এই ভূমি হস্তান্তর হয়ে গেছে। ওই জায়গাটায় আরো এক্সপ্লোর করা দরকার। ভূমি হস্তান্তর হলে আইনি এবং আইনের বাইরে কোন ধরনের পদক্ষেপ সেখানে নেয়া যেতে পারে, সেটি নির্ণয় করতে হবে। একটা বিকল্প জায়গায় ইপিজেড করার সুপারিশও এসেছে, তা নিয়েও আমরা এগোতে পারি। রাষ্ট্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুযোগ-সুবিধা থেকে অনেক দূরে চলে গেছে বলেও আলোচনায় উঠে এসেছে। ঠিকই প্রান্তিক গোষ্ঠীকে রাষ্ট্র গুরুত্ব দিচ্ছে না। তাদের অধিকার সুরক্ষার জায়গা থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। জনগণ যে রাষ্ট্রের একটা উপাদান, সেটি জানান দেয়ার একটা নৈতিক দায়িত্ব আমাদের রয়েছে। সে জায়গা থেকে আমরা কাজগুলো করছি। লিখিত সুপারিশগুলোর সঙ্গে আমরা একমত। সেগুলো আমরা গ্রহণ করেছি। আবার আলোচনার মাধ্যমে নতুন যে সুপারিশগুলো এসেছে সেগুলোও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। সর্বোপরি বিদ্যমান আইনি সুযোগগুলোর প্রতিটিই আমাদের এক্সপ্লোর করতে হবে। যারা ছাড়পত্র দিয়েছে, তারা কারা, তাদের কী এখতিয়ার আছে সেগুলো খতিয়ে দেখতে হবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ব্যক্তিদের কাছে আমাদের তথ্যগুলো পৌঁছে দিতে হবে। বিকল্প স্থানে ইপিজেড করার সুপারিশ নিয়েও একটা ক্যাম্পেইন করা যেতে পারে। আলোচনায় অংশ নেয়ায় সবাইকে ধন্যবাদ।

 

শ্রুতলিখন: হুমায়ুন কবির



এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন