কভিডে ধসে গিয়েছে তাঁতীবাজারের স্বর্ণ ব্যবসাও

আল ফাতাহ মামুন

মাস ছয়েক আগে সপরিবারে ঢাকা ছেড়েছেন তাঁতীবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী মো. রাজন। বর্তমানে বেকার। গ্রামেই আয়-রোজগারের পথ খুঁজছেন। কভিডের শুরু থেকেই ব্যবসায় মন্দা ছিল। বারবার লকডাউনের প্রভাবে আর দাঁড়াতে পারেননি।

একই বাজারের আরেক ব্যবসায়ী হাসান (ছদ্মনাম) শিগগিরই ব্যবসা ছাড়বেন বলে পাকা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রতিদিনই টিকে থাকার লড়াই করছি। শেষ রক্ষা করা আর সম্ভব হলো না। হিসাবপত্র গুছিয়ে সামনের মাসেই ব্যবসা গুটিয়ে ফেলব। জীবিকার তাগিদে এভাবেই ব্যবসা ছেড়েছেন তাঁতীবাজারের ৭৫ শতাংশের বেশি স্বর্ণ ব্যবসায়ী।

বাংলার স্বর্ণ শিল্পের গোড়াপত্তন হয় রাজধানীর তাঁতীবাজারে। অন্যান্য ব্যবসার মতো দেশের সবচেয়ে বড় স্বর্ণের পাইকারি বাজারের জৌলুসও কেড়ে নিয়েছে কভিড-১৯। কভিডের প্রকোপে তাঁতীবাজারের ৭৫ শতাংশের বেশি মহাজন ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। বেকার হয়েছেন প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি শ্রমিক।

তাঁতীবাজার বণিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, কভিডের আগে এখানে সচল স্বর্ণ দোকান ছিল তিন হাজার। কভিডের অভিঘাতে বর্তমানে সাতশর মতো স্বর্ণ দোকান টিকে আছে। পরিসংখ্যান মতে, কভিডকালে প্রায় হাজার ৩০০ জন মহাজন ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন, যা মোট ব্যবসায়ীর ৭৫ শতাংশের বেশি।

ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, কষ্টেসৃষ্টে যেসব মহাজন টিকে আছেন, তারাও এখন ভিন্ন ব্যবসার কথা ভাবছেন। নিউ জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী মারুফ হোসেন বলেন, সপ্তাহ চলে যায়, দোকানে টাকাও বেচাকেনা হয় না। কিন্তু খরচ ঠিকই হচ্ছে। তিনি বলেন, আমার দোকানে দৈনিক ১০ হাজার টাকা খরচ আছে। মাসে লাখ টাকা। বিক্রি করতে পারি না ৫০ হাজার টাকাও। দোকান বন্ধ থাকলে দোকান ভাড়া, ভ্যাট, ট্যাক্স, কর্মচারীর বেতন সবকিছুই তো দিতে হয়। এভাবে তো বেশি দিন ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

মহাজনদের সঙ্গে সঙ্গে দুর্দিন নেমে এসেছে স্বর্ণ শ্রমিক বা কারিগরদের জীবনেও। কভিডের আগে তাঁতীবাজারে তিন হাজার দোকানে ১০ হাজার কারিগর কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিন হাজার শ্রমিক বিভিন্ন দোকান কারখানায় কাজ করছেন। তবে কভিড ছাড়াও প্রতিনিয়তই কারিগররা স্বর্ণের কাজ ছাড়তেন বলে জানা গেছে। তাঁতীবাজার বণিক সমিতির নেতারা জানান, ১০ বছর আগেও তাঁতীবাজারে ৩৬ হাজার স্বর্ণ শ্রমিক ছিলেন। বর্তমানে মাত্র তিন হাজার শ্রমিক আছেন। শ্রমিক কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে মহাজনরা বলেন, নানা কারণেই শ্রমিকরা চলে যাচ্ছেন। এর মধ্যে বড় কারণ হলো, মানুষ এখন বাইরের গহনার প্রতি আগ্রহী বেশি। ফলে দেশী কারিগরদের কদর কমে গেছে।

তাঁতীবাজারের স্বর্ণের দোকানগুলোয় জুয়েলারি সামগ্রীর পাশাপাশি স্বর্ণ বন্ধকের ব্যবসায়ও ভাটা পড়েছে। একাধিক মহাজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কভিডকালে অনেকেই স্বর্ণ বন্ধক রাখতে এসেছেন। কিন্তু ব্যবসা মন্দা থাকায় মহাজনরা স্বর্ণ বন্ধ রাখার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ দেখান না। লক্ষ্মী জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী রমেশচন্দ্র বলেন, কভিডের বেশির ভাগ সময়ই দোকানপাট বন্ধ ছিল। সময় মানুষের আয় কমেছে। বেশির ভাগ মানুষ মৌলিক চাহিদা মেটাতেই হিমশিম খেয়েছে। সেখানে স্বর্ণের গ্রাহক কম থাকবেএটাই তো স্বাভাবিক কথা।

তবে বর্তমান সাবেক মহাজনরা অভিযোগ করে বলেছেন, তাদের দুর্দিনে ব্যবসায়ী নেতা কিংবা সরকার কেউই পাশে ছিলেন না। প্রণোদনার অর্থও তারা পাননি। তাঁতীবাজার বণিক সমিতির সেক্রেটারি ইউসুফ শরিফ বণিক বার্তাকে বলেন, কভিডের দুর্দিনে ব্যবসায়ীরা দোকান ছেড়ে চলে গেছেন। আমরা কিছুই করতে পারেনি। সমিতির মাসিক চাঁদা ১০০ টাকা। তাও আদায় করিনি। আমাদের পাশেও কেউ ছিল না। দোকান ভাড়া কমানো হয়নি। ভ্যাট ছাড় দেয়া হয়নি। নানা চাপে অনেকে ব্যবসা ছেড়েছেন। আমরা যারা টিকে আছি, আমরাও বিকল্প আয়ের কথা ভাবছি। তিনি বলেন, আমার নিজের মার্কেট ছিল, কারখানা ছিল। এখন সব ভাড়াটিয়া শূন্য। এভাবে চলতে থাকলে তো বেশি দিন টিকে থাকা যাবে না।

মহাজনরা দোকান কারখানা ছেড়ে দেয়ার কারণে বিপাকে পড়েছেন পজিশন মালিকরাও। বেশির ভাগ কারখানা মালিকই মহাজন না পেয়ে আবাসিক বাসা হিসেবেই ভাড়া দিচ্ছেন একসময়ের স্বর্ণ কারখানাগুলো। কারখানা মালিকরা জানিয়েছেন, কয়েক মাস খালি রাখার পরও ভাড়া না পেয়ে এবং দিন দিন মহাজনের সংখ্যা কমে যাওয়ায় আবাসিক বাসা হিসেবে সেগুলো ভাড়া দেয়া হচ্ছে।

সার্বিক ব্যাপারে তাঁতীবাজার বণিক সমিতির সভাপতি এবং বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির কার্যকর পরিষদের সদস্য বিশ্বাস জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী রঞ্জন বিশ্বাস বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের ব্যবসায়ীদের দুর্দিন যাচ্ছে, এটা সত্যি কথা। অনেক সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ীও আজ পথে বসে গেছেন। এসব ব্যবসায়ীর পাশে দাঁড়ানোর জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন