প্রাচুর্য নয়, উদ্যমই নোয়াখালীতে সিলেটের চেয়ে বেশি উদ্যোক্তা তৈরি করেছে

হাছান আদনান

প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর সিলেট দেশের সমৃদ্ধতম অঞ্চলগুলোর একটি। অঞ্চলটি এক সময়ে সামাজিক অনেক সূচকেই বেশ এগিয়ে ছিল। সে তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল নোয়াখালী। তবে বর্তমানে এসে দেখা যাচ্ছে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, শিল্পায়ন উদ্যোক্তা তৈরিতে নোয়াখালী এখন সিলেটের চেয়ে অনেক এগিয়ে। এর কারণ হিসেবে দুই অঞ্চলের বিদগ্ধজনরা বলছেন, সিলেট অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ঝুঁকি নেয়ার প্রবণতা কম। অন্যদিকে নোয়াখালীর বাসিন্দারা অনেক উদ্যমী। বিষয়ই উদ্যোক্তা তৈরির দিক থেকে দুই অঞ্চলের মধ্যে বড় ব্যবধান তৈরি করে দিয়েছে।

যদিও প্রাচীনকাল থেকেই অনেক অগ্রসর জীবনযাপন ছিল সিলেট অঞ্চলের বাসিন্দাদের। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন খাতে নেতৃত্বও দিয়েছেন অঞ্চলের অনেক গুণীজন। দেশের অর্থনীতির দিকপালদের অনেকেরই আদি নিবাস সিলেটে। এম সাইফুর রহমান, আবুল মাল আব্দুল মুহিত শাহ এএমএস কিবরিয়া তিন অর্থমন্ত্রীই ছিলেন সিলেট অঞ্চলের। স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫০ বছরের মধ্যে ৩০ বছর অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন তারা। তাদের হাত ধরেই দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধির পথে এগিয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ১১ জন গভর্নরের মধ্যে দুজন এসেছেন সিলেট অঞ্চল থেকে। অনেক বাঘা বাঘা আমলারও পৈতৃক নিবাস সিলেটে। গত শতকে দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় অঞ্চলের বাসিন্দারা সমৃদ্ধ হয়েছেন দ্রুত। পঞ্চাশের দশক থেকেই যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অভিবাসন নিয়ে নগদ অর্থ উপার্জন করেছেন সিলেট অঞ্চলের বাসিন্দারা।

অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘনবসতিপূর্ণ নোয়াখালী অঞ্চল এক সময় দারিদ্র্যসহ সামাজিক বিভিন্ন সূচকে সিলেটের তুলনায় বেশ পিছিয়ে ছিল। তবে সে চিত্র এখন অনেকটাই বদলে গিয়েছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, শিল্পায়ন, ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি, কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে অর্থনীতির সমৃদ্ধিতে নেতৃত্বের আসনে উঠে এসেছে অঞ্চলের তিন জেলাফেনী, নোয়াখালী লক্ষ্মীপুরের মানুষ।

অর্থনৈতিক অবদানে সিলেটের পিছিয়ে পড়ার বিষয়টি অনুসন্ধান করতে গিয়ে সেখানকার সংস্কৃতি-জীবনাচারসহ নানা পরিসংখ্যান তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পাশাপাশি কথা হয়েছে সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গেও। তাদের সঙ্গে আলোচনায় অঞ্চলটি নিয়ে বেশ হতাশার গল্পই উঠে এসেছে।

সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ বলছে, উদ্যোক্তা হতে হলে কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি বড় ধরনের ঝুঁকি নিতে হয়। কিন্তু সিলেট অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে পরিশ্রমপ্রিয়তা থাকলেও ঝুঁকি নেয়ার মানসিকতা নেই। তারা স্বভাবের দিক থেকে বেশ রাগী প্রকৃতির। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের মধ্যে অহংকার আভিজাত্য প্রবল। কারণে প্রাকৃতিক সম্পদের পাশাপাশি সম্পদ হাতে নগদ অর্থ থাকলেও সিলেট অঞ্চলের বাসিন্দারা উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারেনি।

১৯৫৪ সাল থেকে সিলেটের হরিপুর গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। ১৯৫৫ সালে গড়ে উঠেছে সিলেট গ্যাসফিল্ড। ফেঞ্চুগঞ্জে সারকারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৬০ সালে। ১৯৫৭ সালে সিলেটে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রগ্রেসিভ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মতো শিল্প। পাক শেল অয়েল কোম্পানিও সিলেটে কার্যক্রম শুরু করেছে সমসাময়িক সময়ে। এরও আগে ১৯৪৩ সালে সিলেটের ছাতকে গড়ে উঠেছিল আসাম বেঙ্গল সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫০ বছরে শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান তৈরি উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে ক্রমাগত পিছিয়েছে সিলেট।

গ্যাসের পাশাপাশি উন্নতমানের বালির প্রাচুর্য রয়েছে সিলেটে। কিন্তু গড়ে ওঠেনি কোনো সিরামিক কারখানা। পাথরের পাশাপাশি কয়লাও আছে সিলেটে। কিন্তু দুটি প্রকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে কোনো শিল্প তৈরি হয়নি। চায়ের জন্য বিখ্যাত সিলেটে বাগান আছে কয়েকশ। কিন্তু এখনো সিলেটে চা প্রক্রিয়াকরণের কোনো কারখানা গড়ে ওঠেনি। সিলেট অঞ্চলের হাওর-বাঁওড়ে প্রচুর ধান উৎপাদিত হলেও চালকলের মতো শিল্পও গড়ে ওঠেনি। পর্যটনসমৃদ্ধ সিলেট অঞ্চলে বেশকিছু বিলাসবহুল রিসোর্ট হোটেল তৈরি হলেও সেগুলো নির্মাণ করেছেন অন্য এলাকার উদ্যোক্তারা। সিলেটের বাসিন্দাদের হাতে এখন আর চা বাগানের মালিকানাও খুব বেশি নেই বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, ট্রেডিংয়ের পাশাপাশি দোকানপাট আবাসন খাতের কিছু প্রতিষ্ঠান ঘিরেই সিলেটের ব্যবসা-বাণিজ্য ঘুরপাক খাচ্ছে।

যদিও ব্র্যাকের স্বপ্নদ্রষ্টা স্যার ফজলে হাসান আবেদের পৈতৃক নিবাস সিলেট অঞ্চলে। প্রাইম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী, শিল্পোদ্যোক্তা রাগীব আলী, পূবালী ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক সফি চৌধুরী হাফিজ আহমদ মজুমদার, ব্যাংক এশিয়ার পরিচালক সাফওয়ান চৌধুরীর মতো উদ্যোক্তারাও সিলেট অঞ্চলের চার জেলার। দেশের বাইরে যুক্তরাজ্যের সফলতম ব্যবসায়ীদের একজন ইকবাল আহমেদ (ওবিই), দুবাইভিত্তিক আল হারামাইন গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমানের (নাসির) পৈতৃক নিবাসও সিলেটে।

সিলেট অঞ্চল থেকে উঠে আসা দেশের প্রতিষ্ঠিত শিল্পোদ্যোক্তাদের একজন ইস্ট কোস্ট গ্রুপের কর্ণধার আজম জে চৌধুরী। বেসরকারি খাতের প্রাইম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার সন্তান। উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে সিলেটের বাসিন্দারা অনেক বেশি পিছিয়ে আছে বলে মন্তব্য করেছেন আজম জে চৌধুরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির ৩০-৩৫ শতাংশই নোয়াখালী অঞ্চলের মানুষদের হাতে বিনির্মাণ হয়েছে। অথচ নোয়াখালী অঞ্চলে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার মতো কোনো সম্পদ ছিল না। কঠোর পরিশ্রম পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে নোয়াখালীর লোকেরা উঠে এসেছে। সিলেটে গ্যাসসহ ভৌগোলিক প্রাকৃতিক অনেক অনেক উপাদান ছিল। কিন্তু আমাদের অঞ্চলের লোকেরা সেটি পারেনি।

আজম জে চৌধুরী বলেন, প্রাইম ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় আমি সিলেট অঞ্চলের অনেক লোককে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার জন্য অনুপ্রেরণা দেয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে অর্থে সফলতা পাইনি। সিলেটের খুবই ছোট একটি অংশ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে। বাকিরা চেষ্টা করেছে কীভাবে লন্ডন যেতে পারবে। বিদেশ গিয়ে যারা সম্পদ অর্জন করেছে, তারাও দেশে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ার চেষ্টা করেনি।

অন্যদিকে দেশের বস্ত্র পোশাক শিল্প, ইস্পাত, সিমেন্ট, নির্মাণ, সেবাসহ প্রায় সব খাতের বিস্তৃতিতে নোয়াখালী, ফেনী লক্ষ্মীপুরের উদ্যোক্তারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বেসরকারি ব্যাংক, বীমাসহ দেশের আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও অঞ্চলটির শিল্পোদ্যোক্তাদের ভূমিকা ছিল সামনের সারিতে। দেশের বড় করপোরেটগুলোর মধ্যে আবুল খায়ের গ্রুপ, পারটেক্স, মাল্টিমোড, বেঙ্গল, গ্লোব, দুলাল ব্রাদার্স, আরএসআরএম, মোহাম্মাদিয়া গ্রুপ, প্রভিটা, জে কে গ্রুপ, মিউচুয়াল গ্রুপ, বেস্ট হোল্ডিংস, এজি গ্রুপ, ম্যাক্স গ্রুপ, তমা গ্রুপ, নিউ জেনারেশন কনস্ট্রাকশন, সজীব গ্রুপ, এমকেআর গ্রুপ, আনোয়ার খান, ইলেকট্রোমার্ট, রেজা গ্রুপ, এভিন্স গ্রুপ, সানম্যান গ্রুপ, নূরজাহান, এফএআরএস গ্রুপের উদ্যোক্তাদের জন্মস্থান বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলভুক্ত তিন জেলায়। দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এসব শিল্প গ্রুপ। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, তৈরি পোশাক শিল্পসহ বিভিন্ন খাতের নীতিনির্ধারণী সংগঠনগুলোর নেতৃত্বেও দায়িত্ব পালন করছেন নোয়াখালী অঞ্চলের শিল্পোদ্যোক্তারা।

দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন নোয়াখালীর বাসিন্দা। নোয়াখালী অঞ্চলের মানুষের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে ওঠার মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে জসিম উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, বিভিন্নমুখী কারণ প্রয়োজনে নোয়াখালী অঞ্চলের মানুষ ব্যবসায়িক মানসিকতা উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে প্রধানতম কারণ ছিল নোয়াখালীর ভূমির আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা ছিল অনেক বেশি। নদীভাঙন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নোয়াখালী অঞ্চলের মানুষের নিত্যসঙ্গী। এসব কারণে অঞ্চলের মানুষ দেশের নানা প্রান্তের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়েছে। জেলা কোটা প্রথার কারণে শিক্ষিতরা সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আতিথেয়তা, পরোপকারী, কঠোর পরিশ্রম, দৃঢ় মনোভাবসহ বেশকিছু মানবিক গুণ নোয়াখালীর মানুষ পেয়েছে প্রকৃতিগতভাবে। গুণগুলোকে কাজে লাগিয়ে অঞ্চলের মানুষ প্রথমে সেবা খাতের প্রতিষ্ঠান গড়েছে। এখন দেশের প্রতিটি শিল্পে নোয়াখালী অঞ্চলের মানুষের অংশগ্রহণ সামনের সারিতে।

পূর্ব পাকিস্তান জেলা গেজেটিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫১ সালে সিলেটের শিক্ষার হার ছিল ২৪ দশমিক শতাংশ। ওই সময় ২৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের গড় শিক্ষার হার। ১৯৬১ সালের জরিপ অনুযায়ী, সিলেটের জনসংখ্যা ছিল ৩৪ লাখ ৮৯ হাজার ৫৮৯। বর্তমানে সিলেট বিভাগের চার জেলার জনসংখ্যা প্রায় ৯৮ লাখ। এর মধ্যে শিক্ষার হার ৪৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। বর্তমানে দেশের শিক্ষার গড় হার অতীতের তুলনায় অনেক বাড়লেও পিছিয়ে সিলেট অঞ্চল। দেশে শিক্ষার হার এখন প্রায় ৭৩ শতাংশ। এর বিপরীতে সিলেট অঞ্চলের সুনামগঞ্জে শিক্ষার হার এখনো ৩৫ শতাংশ। জেলাটিতে এখনো প্রতি হাজারে ৬২ জন শিশুর মৃত্যু হয়। আর হবিগঞ্জ জেলার শিক্ষার হার ৪০ দশমিক শতাংশ।

এর বিপরীতে গত কয়েক দশকে শিক্ষাসহ সামাজিক প্রতিটি সূচকে উন্নতি করেছে নোয়াখালী অঞ্চল। জেলা গেজেটিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫১ সালে নোয়াখালীতে শিক্ষার হার ছিল ২৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ১৯৬১ সালে এলাকাটিতে জনসংখ্যা ছিল ২৮ লাখ ৮৩ হাজার। ওই সময়ে ডেল্টা জুট মিলস দোস্ত টেক্সটাইল মিলস ছাড়া বড় কোনো শিল্প ছিল না নোয়াখালীতে। অল্প কিছু ছোট কুটির শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছিল জেলাজুড়ে। শ্রমশক্তির মাত্র শতাংশ ছিল এসব শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। বাকিদের বৃহৎ অংশের জীবিকা উপার্জনের মাধ্যম ছিল কৃষি মত্স্য। বর্তমানে নোয়াখালী অঞ্চলের তিন জেলা ফেনী, নোয়াখালী লক্ষ্মীপুরের জনসংখ্যা প্রায় ৬৬ লাখ। এর মধ্যে ফেনী নোয়াখালীতে শিক্ষার হার ৬৯ শতাংশের বেশি। আর লক্ষ্মীপুরে শিক্ষার হার ৬২ শতাংশ।

সিলেট অঞ্চল ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি সামাজিক বিভিন্ন সূচকেও পিছিয়ে পড়ার বিষয়টিতে একমত পোষণ করছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী . কে আব্দুল মোমেনও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ১৮৭৪ সালে সিলেটকে আসামের সঙ্গে সংযুক্ত করে প্রদেশ তৈরি করা হয়েছিল। ওই সময় আসামে কোনো শিক্ষিত লোক ছিল না। সিলেটের লোকরাই আসাম প্রশাসন পরিচালনা করত। ১৯৪৭ সালে গণভোটের মাধ্যমে আসাম থেকে বেরিয়ে সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়েছিল। ওই সময় পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষার হার ছিল ১৫ শতাংশ আর সিলেটের শিক্ষার হার ছিল ২৪ শতাংশের বেশি। অথচ বর্তমানে সারা দেশের মধ্যে সিলেট অঞ্চলের শিক্ষার হার কম। কারণে সিলেটে শিশু মাতৃমৃত্যুর হারও অনেক বেশি।

আব্দুল মোমেন বলেন, সিলেট অঞ্চলের শিক্ষার কাঠামোতেই বড় ধরনের দুর্বলতা আছে। ২০০৩ সালে আমি বরিশাল সিলেট বিভাগ নিয়ে একটি গবেষণা করেছিলাম। তখন দেখেছি, দুটি বিভাগের জনসংখ্যা প্রায় সমান হলেও সিলেটের তুলনায় বরিশালে স্কুলের সংখ্যা তিন গুণ বেশি ছিল। সিলেট অঞ্চলের প্রবাসীরা রেমিট্যান্সের যে অর্থ পাঠাচ্ছেন, তার বড় অংশ ব্যাংকের শাখাগুলোয় অলস পড়ে থাকে। সিলেটের রাস্তাঘাটসহ রেলপথও খুব দুর্বল। অনেক সম্ভাবনা থাকার পরও সিলেটে এখনো কোনো অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে ওঠেনি। অথচ এক সময়ের পিছিয়ে থাকা নোয়াখালী অঞ্চল এখন অনেক সমৃদ্ধিশালী।

নোয়াখালীর লোকেরা যেখানে গিয়েছে, সেখানেই আলোকিত করে তুলেছে বলে মন্তব্য করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সম্পদের অভাবসহ নানা কারণে নোয়াখালী অঞ্চলের লোকেরা অনেক কষ্টের মধ্যে বড় হয়েছে। কিন্তু কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তারা নিজেদের ভাগ্য বদল করেছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সমৃদ্ধি শিল্পায়নে নোয়াখালী অঞ্চলের লোকেরা যে ভূমিকা রেখেছে, সেটির জন্য তারা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।

পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানও মনে করছেন তৈরি পোশাক শিল্পসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সিলেট অঞ্চলের মানুষ পিছিয়ে আছে। তবে ঠিক কী কারণে অঞ্চলের মানুষ উদ্যোক্তা হিসেবে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে পারেনি, সেটি নিয়ে গবেষণা হতে পারে।

সুনামগঞ্জের সন্তান এমএ মান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, ছোটবেলায় আমি দেখেছি, আমাদের অঞ্চলের অনেক মানুষ জাহাজে চাকরির জন্য কলকাতায় যাচ্ছেন। ব্রিটিশ জাহাজগুলোতে চাকরি করতে গিয়েই সিলেটের লোকেরা লন্ডনমুখী হয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সিলেটিদের বিদেশযাত্রা অনেক বেড়েছে। যে হারে আমাদের অঞ্চলের মানুষরা বিদেশ গিয়েছে, সে মাত্রায় উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে ওঠেনি। তবে নবীন-প্রবীণ মিলিয়ে বেশকিছু উদ্যোক্তা সিলেট অঞ্চল থেকে উঠে এসেছেন। এর মধ্যে অনেকে লন্ডনসহ ইউরোপের দেশগুলোতে ভালো ব্যবসা করছেন।

নোয়াখালী অঞ্চলের শিল্পোদ্যোক্তারা জানান, দেশের শিল্পায়ন বেসরকারি খাতের বিকাশ শুরু হয়েছিল মূলত আশির দশকে। ওই সময় নোয়াখালী অঞ্চলের ছোট ছোট উদ্যোক্তা দেশের বিভিন্ন এলাকায় সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। বেশির ভাগই তৈরি  করেছিলেন সেবা খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বস্ত্র পাট খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছিলেন তারা। পরবর্তী সময়ে তৈরি পোশাক খাতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অনেক উদ্যোক্তাই ব্যবসার পরিধি বড় করেছেন। লোকসানে ধুঁকতে থাকা বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানও কিনে নিয়েছিলেন নোয়াখালী অঞ্চলের শিল্পোদ্যোক্তারা।

ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে নব্বই দশকের শুরুতে উদ্যোক্তাদের খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন বস্ত্র পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠান রেজা গ্রুপের কর্ণধার একেএম সাহিদ রেজা শিমুল। ফেনী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি মার্কেন্টাইল ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের একজন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ব্যাংকের ভালো পদের চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম। ব্যবসায়ী শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শ নির্দেশনায় ব্যবসায় নেমে পড়ি। নিজের পাশাপাশি আত্মীয়স্বজন দেশের মানুষের জন্য কিছু করার মানসিকতা নিয়েই ব্যবসায় নাম লিখিয়েছিলাম। এখন মনে হয় নিজের আকাঙ্ক্ষার কিছুটা হলেও পূর্ণতা দিতে পেরেছি।

সাহিদ রেজা শিমুল বলেন, নোয়াখালী অঞ্চলের মানুষ অন্যের জন্য কিছু করতে পারলে পরিতৃপ্তি পায়। একে অন্যের সহযোগী হতেও পছন্দ করে। নিজে বড় হওয়ার পাশাপাশি আত্মীয়স্বজন পাড়াপ্রতিবেশীর জন্য কিছু করার মানসিকতার কারণেই উদ্যোক্তা হিসেবে সফলতা পেয়েছে এলাকার মানুষ। 

সিলেট অঞ্চলের লোকেরা ঐতিহাসিকভাবেই ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক . সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার। শিক্ষাবিদের পৈতৃক নিবাসও সিলেট অঞ্চলের হবিগঞ্জে। নিজের গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে ফারহাত আনোয়ার বণিক বার্তাকে বলেন, ব্রিটিশ ভারতে আসামের প্রশাসন সিলেটের লোকেরাই পরিচালনা করেছে। সমসাময়িক সময়ে সিলেট অঞ্চলে বিপুলসংখ্যক চিকিৎসকও ছিলেন। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান সরকার সেনাবাহিনীতে সিলেটের শিক্ষিত মুসলিমরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে এখন পর্যন্ত সিলেটিরা চাকরি আর বিদেশযাত্রার মধ্যে আটকে আছে। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের বড় অংশই বেকার অকর্মণ্য। উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী হিসেবে সিলেটের লোকেরা ভালো অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। এক্ষেত্রে নোয়াখালীর লোকেরা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ এখন দেশের সবচেয়ে দরিদ্রতম জেলাগুলোর একটি।

ফারহাত আনোয়ারের ভাষ্য হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘনবসতি নোয়াখালী অঞ্চলের বাসিন্দাদের দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়তে প্রেরণা জুগিয়েছে। অল্প কিছু পুঁজি জমা করে ব্যবসায় নেমেছে। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উন্নতি করে দেশের বড় ব্যবসায়ী বা করপোরেটে রূপান্তরিত হয়েছে। নোয়াখালীর লোকেরা পুঁজি খাটিয়ে ব্যবসায়ী হলেও সিলেটিরা ভোগবিলাসে উড়িয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন