আলোকপাত

নীল অর্থনীতির সবুজ সম্ভাবনা

মামুন রশীদ

প্রায় বছর চার আগে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে আমার নির্ধারিত ক্লাসের পর গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের এক অধ্যাপকের বক্তব্য। যদিও আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমার ভারতের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ আইনি লড়াইয়ের বিজয়ে অতিশয় আনন্দিত হয়েছিলাম। সমুদ্র অর্থনীতি বা ব্লু ইকোনমি নিয়ে আমার উৎসাহের শুরু তখন থেকেই। পরবর্তীকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম বিভাগের সচিব মহোদয়ের সঙ্গেও অনেকবার কথা হয়েছে। করোনাকালে সুযোগ হলো সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে অপরাপর বা সমপর্যায়ের দেশগুলো কী করছে কিছুটা জানার।

এরই মধ্যে আমরা জেনেছি, বাংলাদেশে অপার সম্ভাবনা রয়েছে নীল অর্থনীতি বা ব্লু ইকোনমি কিংবা সমুদ্রভিত্তিক অর্থনীতিতে। যথাযথ গুরুত্ব দিলে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটে যেতে পারে বলেও অনেকে জানিয়েছেন। বিশ্লেষকদের মতে, শুধু সামুদ্রিক মাছ শৈবাল রফতানি করেই বছরে আয় হতে পারে বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ।

সরকারি ভাষ্যমতে, সম্পদ কাজে লাগিয়ে অর্থনীতিতে বিপ্লব ঘটানোর প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। টেকসই উন্নয়নে সমুদ্রসম্পদ ব্যবহারের ওপরও গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশের সমুদ্র অংশে কী পরিমাণ মৎস্য সম্পদ, খনিজ সম্পদ, নৌ-চলাচলসহ কী ধরনের অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা রয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে ১৯টি মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি সমুদ্র অর্থনীতির বিষয়ে নিজস্ব কর্মপরিকল্পনা দ্রুত পাঠাতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ সংস্থাকে নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা আগেই বলেছেন, সমুদ্রে বিশাল সুযোগ রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তারে সহায়ক। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা ঘিরে বিরোধ নিষ্পত্তিতে প্রাপ্ত এলাকা এখন দেশের উন্নয়নের নতুন ক্ষেত্র হিসেবে গণ্য হচ্ছে। সমুদ্র অর্থনীতিতে বিনিয়োগের দ্বার দ্রুত খুলে দেয়া উচিত বলে মনে করেন অনেকে। তা না হলে সমুদ্রের গভীরে কেউ সীমানা মানবে না। ফলে সম্পদ চলে যেতে পারে অন্য দেশে। তাই আমাদের শুধু পরিকল্পনার মধ্যে থাকলে চলবে না, কৌশলগুলোরও দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।

একটি সমৃদ্ধ এবং টেকসই নীল অর্থনীতির লক্ষ্যে আমাদের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও ১২টি কার্যকলাপ উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে মৎস্য চাষ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, মানবসম্পদ, ট্রান্সশিপমেন্ট, পর্যটন এবং জলবায়ু পরিবর্তন। এছাড়া ২০১৭ সালে নীল অর্থনীতি সম্পর্কিত উদ্যোগগুলোর সঙ্গে বিভাগীয় মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয় সাধনের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে সেল প্রতিষ্ঠা করা হয়। চিহ্নিত করা হয় নীল অর্থনীতির ২৬টি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। তার মধ্যে রয়েছে মৎস্য চাষ, জাহাজ চলাচল, জ্বালানি, পর্যটন, উপকূলীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা এবং সংশ্লিষ্ট নজরদারির বিষয়গুলো।

বঙ্গোপসাগরের অভ্যন্তরে ২০০ নটিক্যাল মাইলের একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ ৭১০ কিলোমিটার সুদীর্ঘ উপকূলরেখা রয়েছে। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের শতকরা ১৯ দশমিক ভাগই আসে সামুদ্রিক মৎস্য থেকে। এছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের উপকূল এলাকায় বর্ধিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। স্থানীয় পর্যটকদের মধ্যে গড়ে শতকরা ৮১ ভাগই কক্সবাজার ভ্রমণ করেন।

আমারা সবাই জানি, দেশের অভ্যন্তরে গ্যাসের মজুদ থাকার পাশাপাশি সমুদ্রের অভ্যন্তরেও গ্যাস মজুদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের বিশাল সাগরসীমায় কী আছে এবং সেই সম্পদ কাজে লাগিয়ে কীভাবে অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করা যায়, তা গবেষণা করতে ২০১৭ সালে কক্সবাজারে নির্মাণ করা হয় সমুদ্র গবেষণা কেন্দ্রবাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট। শুধু বঙ্গোপসাগরের তলদেশের সম্পদ গবেষণায় নিজেদের সীমাবদ্ধ না রেখে তা কীভাবে বাড়ানো যায়, সেই প্রচেষ্টাও রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।

বাংলাদেশের একটি বেসরকারি সমুদ্র গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যানুযায়ী, সমুদ্র থেকে মাছ ধরে শুধু বিদেশে রফতানি করেই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব। সেই সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়টিও রয়েছে। ২০১২ ২০১৪ সালে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি হলেও আমরা এখন পর্যন্ত বিজয়কে কাজে লাগাতে পারিনি। মেরিটাইম এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। সমুদ্রের তলদেশে খনিজ বালিসহ কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, তাও নিরূপণ করা যায়নি। এমনকি মৎস্য সম্পদেরও উপযুক্ত ব্যবহার করতে পারিনি। যুক্তরাষ্ট্র শুধু সমুদ্রের তলদেশের সৌন্দর্য দেখিয়ে বছরে ১০ বিলিয়ন ডলার আয় করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোক সেখানে ভ্রমণ করতে যায় এবং বিভিন্ন ধরনের সৌন্দর্য উপভোগ করে। বাংলাদেশেও ধরনের সুযোগ রয়েছে, কিন্তু আমরা তা কাজে লাগাতে পারছি না। অনেকেই মনে করেন, যদি সঠিকভাবে মৎস্য সম্পদ, গ্যাস সম্পদ, খনিজ সম্পদ এবং স্কুবা ট্যুরিজম কাজে লাগানো যায়, তাহলে বাংলাদেশের প্রতি অর্থবছরে যে বাজেট হয়, তা নীল অর্থনীতি দিয়েই জোগান দেয়া সম্ভব।

বিশ্বব্যাংক বলছে, নীল অর্থনীতি হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উন্নততর জীবিকার সংস্থান এবং কাজের লক্ষ্যে সামুদ্রিক পরিবেশের উন্নয়ন। টেকসই উন্নয়নে প্রতিষ্ঠানটি সমুদ্রসম্পদ ব্যবহারের ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেছে। তাছাড়া সমুদ্রসম্পদ খাদ্যের পাশাপাশি জ্বালানিও সরবরাহ করে।

সমুদ্রসম্পদ সুরক্ষায় টেকসই ভারসাম্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে নীল অর্থনীতির বিকাশে আরো নজর দিতে হবে, বিষয়টি প্রায় সর্বজনস্বীকৃত। খাতে নতুন বিনিয়োগ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতকল্পে আরো ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে পারে। এখন মৎস্য পালন, জাহাজ নির্মাণ, জাহাজ ভাঙা, লবণ উৎপাদন, বন্দর সুবিধাসহ বেশ কিছুসংখ্যক নীল অর্থনীতির ক্ষেত্র উন্মোচন হয়েছে। নীল অর্থনীতির ক্ষেত্র আরো বাড়ানো সম্ভব হলে ২০৪১ সালের আগেই আমাদের উন্নত দেশের তালিকায় পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে বলেও অনেকে বলছেন।

খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, নীল বা ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলো খুঁজতে আটটি প্রকল্পের মাধ্যমে গবেষণার কার্যক্রম চলছে। মৎস্য সম্পদ আহরণ থেকে শুরু করে সমুদ্রগর্ভে খনিজ অন্যান্য সম্পদ আহরণের সব বিষয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। তবে সক্ষমতার অভাবে বিস্তৃত মহীসোপান থেকে এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন (ইইজেড) বা একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে গবেষণা শুরুই করা যায়নি এখনো। প্রতিবেশী দেশ ভারতে ১৯৬০ সালে ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ চালু হয়। অঞ্চলে বর্তমানে সমুদ্রসম্পদবিষয়ক গবেষণায় দক্ষ জনবলের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে ভারত। অন্যদিকে বাংলাদেশে ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণসংক্রান্ত জাতিসংঘের সালিশি আদালতের রায়ের আগে বাংলাদেশে সমুদ্রসম্পদ গবেষণা নিয়ে কোনো উদ্যোগ ছিল না। তবে এটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। ইংরেজিতে একটি কথা আছেহোয়াই উই আর পুওর? বিকজ উই আর পুওর (আমরা দরিদ্র কেন? কারণ আমরা দরিদ্র)

এটা সত্য যে ২০১৪ সালে বাংলাদেশের পক্ষে জাতিসংঘের ঐতিহাসিক রায়ের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট থেকে সরকারের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ওশানোগ্রাফি বা সমুদ্রবিজ্ঞানবিষয়ক বিভাগ খোলার জন্য অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমবারের মতো সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ খোলে। তারপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নোয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়েও সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের যাত্রা শুরু হয়।

বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় ধরে সমুদ্রসম্পদ নিয়ে গবেষণার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো না থাকার কারণেই বিপুল নীল অর্থনীতি বা ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনা কাজে লাগানো যায়নি। তবে ২০১৪ সালের পর বাংলাদেশে সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনা কোথায়, কোন ক্ষেত্র থেকে কী পরিমাণ অর্জন হবে তা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে এখন পর্যন্ত সমুদ্রসম্পদ অনুসন্ধান ব্যবহারের জন্য বড় কার্যক্রম হাতে নেয়া যাচ্ছে না। এখন যেহেতু কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্রবিজ্ঞান পড়ানো হচ্ছে, সে কারণে হয়তো জনবলের অভাব পূরণ হতে বেশি সময় লাগবে না।

বিদ্যমান বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেখা যায়, সারা বিশ্বে সমুদ্রসম্পদের যে বিশালতা, তার মাত্র এক ভাগ এখন পর্যন্ত বিশ্ব ব্যবহার করতে পারছে। আগেই জেনেছি, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় শুধু মৎস্য সম্পদ আহরণ থেকেই বছরে থেকে দশমিক বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব। শুধু সামুদ্রিক মাছকে কেন্দ্র করেই একটি শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব। বর্তমানে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বছরে প্রায় ৪৭৫ জাতের ৮০ লাখ টন মাছ ধরা হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, গবেষণার মাধ্যমে ঠিকমতো মৎস্য সম্পদ আহরণ সম্ভব হলে এর পরিমাণ দশমিক কোটি টন পর্যন্ত উন্নীত করা সম্ভব। এসব সামুদ্রিক মাছের তেল বিভিন্ন ধরনের উপাদেয় খাদ্যপণ্য এবং জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার হয়। ফলে মাছ এবং মাছের একাধিক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বে ভারী শিল্পে ব্যবহূত ম্যাগনেশিয়াম, কৃষিক্ষেত্রের সার তৈরিতে ব্যবহূত পটাশিয়াম, প্রতিদিনের খাবার লবণ সোডিয়াম ক্লোরাইড এবং ওষুধ তৈরিতে ব্যবহূত ব্রোমিনের প্রায় ৫০ শতাংশই আসে সমুদ্র থেকে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা থেকেও ধরনের বিপুল সম্পদ আহরণ এবং তা রফতানির সুযোগ রয়েছে। সম্পদ কাজে লাগিয়ে দেশে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠারও সুযোগ আছে। নতুন কর্মসংস্থানের কথা আগেই বলেছি। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বিপুল পরিমাণ তেল-গ্যাসের মতো খনিজ সম্পদও পাওয়া সম্ভব। এছাড়া সমুদ্র দিয়ে চলাচল করা জাহাজ থেকেও বিপুল আয়ের সুযোগ রয়েছে।

এখন এটি প্রায় স্বীকৃত সত্য যে সমুদ্র থেকে বাংলাদেশের আয়ের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সমুদ্রসম্পদ অনুসন্ধান এবং আহরণের জন্য দরকার প্রণোদনা বিনিয়োগ। সমুদ্রসম্পদ অনুসন্ধানে এখনো তেমন প্রণোদনা নেই, আবার দেশের বড় উদ্যোক্তা এবং বিনিয়োগকারীরাও এত কঠিন ক্ষেত্রে বিনিয়োগে উৎসাহী নন। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য কার্যকর পরিকল্পনা দরকার, বিশেষ করে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানসংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি বা আইওসিগুলোকে নিয়ে আসতে। তাদের ছাড়া প্রকৃতপক্ষে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান সম্ভবও নয়। গবেষকরা এরই মধ্যে দেখিয়েছেন সমুদ্রসম্পদ সঠিকভাবে কাজে লাগানো হলে দেশের অর্থনীতিতে মোট আয়ের অর্ধেকের বেশি জোগান আসবে সমুদ্রসম্পদ থেকেই।

 

মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন