বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২১

আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ

কিউ ডংগু

এ বছরের বিশ্ব খাদ্য দিবস আমাদের একটি সংকটময় মুহূর্তে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কভিড-১৯ মহামারী একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। ফলে হয়েছে অপূরণীয় ক্ষতি এবং অপরিসীম কষ্ট। জলবায়ু সংকটের প্রভাব আমাদের চারপাশে। আগুনে ফসল শেষ হয়ে গেছে। ঘরবাড়ি ভেসে গেছে। দ্বন্দ্ব্ব এবং অন্যান্য মানবিক জরুরি অবস্থার কারণে জীবন ও জীবিকা অশান্তিতে রূপ নিয়েছে। বিশ্বব্যাপী খাদ্যনিরাপত্তার প্রতিকূলতা এত বছর ধরে এমন গুরুতর ছিল না।

তবুও এ সবকিছুর মধ্যে উত্সাহজনক নতুন গতি ও শক্তি গড়ে উঠছে যখন আমরা আমাদের খাদ্য উত্পাদন, সঞ্চয়, বিতরণের উপায়গুলো পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করছি। আমরা সমস্যার মোকাবেলা করতে শুরু করেছি এবং সার্বিক কাঠামোকে আরো উপযুক্ত করে তুলছি।

গত মাসে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস কর্তৃক আয়োজিত জাতিসংঘের খাদ্য ব্যবস্থা শীর্ষক সম্মেলন কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থাকে রূপান্তর করার জন্য বিশ্বকে কীভাবে এগিয়ে যেতে হবে তার বিস্তৃত রূপরেখা তৈরি করেছে।

সমাবেশের সমাপ্তি বিবৃতি ছিল—‘নিউইয়র্ক থেকে রোমে ফিরে আসুন’, যেখানে খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং জাতিসংঘের অন্যান্য খাদ্য সংস্থা রয়েছে।

আমরা এফএওতে এরই মধ্যে আমাদের কাজ শুরু করতে প্রস্তুত এবং বাস্তবায়ন ও রূপান্তরকে নেতৃত্ব দেয়ার বাস্তব কাজে নেমেছি।

আমাদের তরুণ প্রজন্মের সৃজনশীলতা ও সহনশীলতাকে কাজে লাগানোর ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে সর্বজনীন তরুণ ও এফএও এবং আমাদের সহ-সংস্থার তরুণ প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে এ মাসের শুরুতে ইতালির রাজধানীতে সফলভাবে একটি বিশ্ব খাদ্য ফোরাম ডাকা হয়েছিল। তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তারাই জলবায়ু সংকট এবং কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থার ত্রুটির সরাসরি পরিণতি নিয়ে বেঁচে থাকবে। একই সময়ে বিশ্বের ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী ১৮০ কোটি তরুণ, যাদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ উন্নয়নশীল দেশে বাস করছেন, তাদের মধ্যেই আছে সীমাহীন সম্ভাবনা।

আমরা এরই মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা, সামগ্রিক সমাধান এবং পরিবর্তনের জন্য তরুণদের নেতৃত্বের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শুরু করেছি। অবশ্যই কেবল তরুণরাই নয়, যারা আমাদের কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থার সঠিক অবস্থান নিয়ে চিন্তা করবে বরং কীভাবে এটা আরো দক্ষ, সম্পূর্ণ, সহনশীল এবং টেকসই করা যায়, সে সম্পর্কেও চিন্তা করতে হবে।

এমনকি কভিড-১৯ বিশ্বের কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থার দুর্বলতার ওপর আলোকপাত করার আগেও বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষ ক্ষুধায় আক্রান্ত হয়েছিল এবং পৃথিবী আমাদের সবার খাদ্য জোগান দিতে পর্যাপ্ত খাদ্য উত্পাদনের পরেও গত বছরে এ সংখ্যা বেড়েছে ৮১ কোটি ১০ লাখ পর্যন্ত। এটি অকল্পনীয় এবং অগ্রহণযোগ্য।

একই সময়ে আমাদের উত্পাদিত খাদ্যের ১৪ শতাংশ ব্যবহারযোগ্য নয় এবং ১৭ শতাংশ নষ্ট হয়। এটিকে অন্যান্য খাতের সঙ্গে একত্র করলে যেমন কীটপতঙ্গ ও রোগ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জীববৈচিত্র্য হ্রাস, আবাসস্থল ধ্বংস ও সংঘাত এবং একই সঙ্গে পরিবেশগত ও আমাদের কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থার জলবায়ু প্রভাব কমার মধ্য দিয়ে বিশ্বের ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে আমরা যেসব বাধার মুখোমুখি হতে পারি তা দেখতে পারা যায়।

এফএও খাদ্য ও কৃষি নিয়ে কাজ করা শীর্ষস্থানীয় সংস্থা হিসেবে একটি টুলবক্স তৈরি করেছে, যা আমরা আত্মবিশ্বাসী যে আমাদের এই জটিল পদ্ধতিগত সমস্যাগুলোর ওপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম করতে পারে।

আমরা কোথায় যাচ্ছি সে সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট ধারণা আছে, উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে উন্নত উত্পাদন, উন্নত পুষ্টি, উন্নত পরিবেশ ও উন্নত জীবন এবং আমাদের কাজটি পরবর্তী দশ বছরের জন্য একটি নতুন কৌশলগত কাঠামো ২০২২-৩১ দ্বারা পরিচালিত হয়েছে, যা চারটি উন্নতিকে বাস্তব করতে প্রয়োজনীয় কংক্রিট পদক্ষেপ এবং ইনপুটগুলোকে সংজ্ঞায়িত করে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে।

এফএও ধারণা করছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধার অবসান ঘটাতে লক্ষ্যমাত্রার জন্য ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। কম খরচ, উচ্চ প্রভাবযুক্ত প্রকল্প রয়েছে, যা লাখ লাখ মানুষকে তাদের খাদ্য চাহিদা ভালোভাবে পূরণ করতে সাহায্য করতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, কৃষি কাজকে আরো প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত করার জন্য গবেষণা ও উন্নয়ন লক্ষ্যযুক্ত হস্তক্ষেপ, ডিজিটাল কৃষিতে উদ্ভাবন এবং নারীদের মধ্যে সাক্ষরতার হার উন্নত করা ক্ষুধা কমানোর জন্য অনেক অগ্রগতি হতে পারে। কিন্তু আরো প্রয়োজনীয় উপাদান যেমন উন্নত তথ্য, শাসন ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা সমীকরণে যোগ করা প্রয়োজন।

উপরন্তু, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি তখনই কার্যকর হবে যখন এটি সরকার এবং মূল অংশীদারদের সঙ্গে একত্রে কাজ করে। কারণ তারা তাদের নির্দিষ্ট শর্ত ও চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে পরিবর্তনের দিকে তাদের নিজস্ব জাতীয় পথ তৈরি করে।

আমাদের এটাও উপলব্ধি করতে হবে যে বিজ্ঞানী ও আমলারা এমনকি খাদ্য উত্পাদনকারী ও পরিবেশকরা কখনই নিজেদের প্রয়োজনে এ সবকিছুর পরিবর্তন আনতে পারবেন না।

বাস্তব ও সুদৃঢ় পদক্ষেপের সঙ্গে ভোক্তা এবং আমরা যা সিদ্ধান্ত নিই, তা দিয়ে অবশ্যই রূপান্তর শুরু হতে পারে। আমরা প্রতিদিন যেসব খাবার গ্রহণ করি, আমরা সেগুলো কোথা থেকে কিনে থাকি, সেগুলো কীভাবে প্যাকেজ করা হয়, আমরা কতটা খাবার ফেলে দিইএসব আমাদের কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থা এবং এ গ্রহের ভবিষ্যতের ওপর প্রভাব ফেলে।

আমাদের সবারই খাদ্য ব্যবস্থায় নেতৃত্ব দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ। আমাদের কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থাকে রূপান্তর করার প্রক্রিয়াএবং বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা, স্বাস্থ্যকর খাদ্য, পরিবেশের ওপর প্রভাব ও বর্জ্যশুরু হবে আপনাকে আমাকে দিয়েই।

এটি কিন্তু আপনার এবং আমার সঙ্গেই শেষ হয়ে যায় না। পুরনো প্রবাদে বলা হয়, ‘আমরা যা খাই সেটাই আমরা। এটাও সত্য যে আমাদের সন্তানরা এবং নাতি-নাতনিরা কীভাবে বেড়ে উঠবে, তাও আমরা যা খাই সেটা দ্বারা প্রভাবিত হয়। আশা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া তাদের হাতে। আসুন, আমরা একসঙ্গে শিখি, একসঙ্গে কাজ করি এবং একসঙ্গে সবকিছুতে অবদান রাখি। 

কিউ ডংগু: জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মহাপরিচালক

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন