অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বড় ভূমিকা রাখলেও বড় বিনিয়োগ পায়নি বাপেক্স

আবু তাহের

চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অপ্রতুল। আন্তর্জাতিক বাজারেও মূল্য লাগামহীন। গ্যাসের চলমান সংকট এরই মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে দেশের শিল্প বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহনসহ বেশকিছু খাতে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে গ্যাস আমদানি করতে হচ্ছে সরকারকে। দেশে গ্যাস সরবরাহের চলমান সংকটের নানা দিক নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক শেষ পর্ব 

গত তিন দশকে দেশের অর্থনীতির আকার বেড়েছে। শিল্প কৃষি খাতে ঈর্ষণীয় সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। এতে শক্তি জুগিয়েছে সহজলভ্য প্রাকৃতিক গ্যাস। সস্তায় গ্যাসের সরবরাহ পেয়ে কারখানায় নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা (ক্যাপটিভ) গড়ে তুলতে পেরেছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। কৃষির উন্নতিতে বড় ভূমিকা রেখেছে সারের সুলভ সহজপ্রাপ্যতা। একই সঙ্গে দেশের বিদ্যুৎ খাতও এগিয়েছে প্রধানত গ্যাসের ওপর ভর করেই। সব মিলিয়ে কৃষি, শিল্প, বিদ্যুৎসহ গোটা অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাসের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। যদিও বিনিয়োগের দিক থেকে সে প্রাকৃতিক গ্যাসই অবহেলিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি।

স্থানীয় পর্যায়ে গত কয়েক দশকে প্রাকৃতিক গ্যাসের অনুসন্ধান-উত্তোলনের মাধ্যমে জ্বালানি সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। ব্যয়বহুল আমদানিতেই খোঁজা হয়েছে জ্বালানি সংকটের সহজ সমাধান। উত্তোলন-অনুসন্ধান যেটুকু হয়েছে, তাতেও প্রাধান্য পেয়েছে বিদেশী কোম্পানিগুলো। এতে করে রাষ্ট্রায়ত্ত খনিজ জ্বালানি অনুসন্ধান উত্তোলনকারী সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি লিমিটেডও (বাপেক্স) হয়ে পড়েছে অনেকটাই গুরুত্বহীন। যদিও বিদেশী নামি কোম্পানিগুলোর চেয়েও অনেক স্বল্প ব্যয়ে প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রেখেছে বাপেক্স।

১৯৮৯ সালে কোম্পানি হিসেবে গঠনের পর শুরুতেই বেশকিছু গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে সক্ষমতার জানান দিয়েছিল বাপেক্স। এরপর বিভিন্ন সময়ে দেশের জ্বালানি খাতে বিদেশী কোম্পানির কর্মতত্পরতা বাড়ায় সংস্থাটি অনেকটাই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। বাপেক্সের দেশের গ্যাস খাতের প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে ওঠার প্রবল সম্ভাবনা ছিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটিকে পর্যাপ্ত মাত্রায় কাজে লাগানো যায়নি। উল্টো বিদেশী প্রতিষ্ঠানের হাতে বাপেক্সের কাজ তুলে দেয়ারও নজির রয়েছে।

যদিও দেশের স্থলভাগে বিদেশী কোম্পানিগুলোর তুলনায় গ্যাসের অনুসন্ধান-উত্তোলন কার্যক্রমে বাপেক্সের সাফল্যের হার বিদেশী কোম্পানিগুলোর চেয়েও অনেক বেশি। এর পরও দীর্ঘদিন স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলনে অনেকটাই উপেক্ষিত থেকেছে সংস্থাটি।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা ভোলায় বাপেক্সের আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রের কূপ খননের কাজ দেয়া হয়েছে রুশ প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রমকে। তিনটি কূপ খননের জন্য সরকারকে প্রতিষ্ঠানটিকে অর্থ দিতে হচ্ছে প্রায় কোটি ৩৬ লাখ ডলারের সমপরিমাণ। দেশের ইতিহাসে এটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যয়বহুল গ্যাস কূপ খনন প্রকল্প। অন্যদিকে কাজ হস্তান্তরের আগে বাপেক্স কূপ তিনটি খননের জন্য ব্যয় প্রাক্কলন করেছিল মোটে কোটি ডলার। 

জ্বালানিসংশ্লিষ্ট এক সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রেও উঠে এসেছে, দেশের স্থলভাগে বাপেক্সকে দিয়ে বিদেশী কোম্পানিগুলোর চেয়ে অনেক কম খরচে গ্যাসের অনুসন্ধান কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া সম্ভব। ২০০৯ সাল থেকে বাপেক্স চার হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকায় দ্বিমাত্রিক ত্রিমাত্রিক জরিপ করেছে। এর মধ্যে হাজার ৭০০ কিলোমিটার ছিল ত্রিমাত্রিক জরিপ। এতে প্রতি কিলোমিটারে গড়ে ব্যয় হয়েছে লাখ ৬৬ হাজার টাকা করে। অন্যদিকে বিদেশী কোম্পানি দিয়ে সিলেটে ত্রিমাত্রিক জরিপ করাতে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয়েছে ৮০ লাখ টাকা করে। এছাড়া দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় কোটি ৭০ লাখ দীঘিপাড়ায় কোটি ৮৫ লাখ টাকা করে ব্যয় হয়েছে।

এতে আরো দেখানো হয়, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে পর্যন্ত প্রতি দুটি কূপ খনন করে একটিতে গ্যাস পেয়েছে বাপেক্স। যেখানে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতি পাঁচটি কূপ খনন করে একটিতে গ্যাস পাওয়া গেলে সেটিকেই বড় সাফল্য বলে মনে করা হয়। মার্কিন কোম্পানি শেভরন এখন পর্যন্ত দেশে প্রতি চারটি কূপ খনন করে একটিতে গ্যাস পেয়েছে। সে অনুযায়ী স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান কাজে দক্ষতার দিক থেকে নামি বিদেশী কোম্পানিগুলোর চেয়েও অনেকটাই এগিয়ে বাপেক্স।

বিষয়ে বাপেক্সের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, জরিপ থেকে উত্তোলন পর্যন্ত সব কাজ করার প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা তৈরি হয়েছে বাপেক্সের। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, লোকবল এবং দক্ষতাও রয়েছে। স্থলভাগে যেখানে কাজ করতে বলা হবে, সেখানে বাপেক্স এককভাবেই কাজ করতে সক্ষম।

দেশে আবিষ্কৃত ২৮টি গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে বাপেক্সের আবিষ্কার নয়টি। সর্বশেষ চলতি বছরই সিলেটের জকিগঞ্জে অনুসন্ধান চালিয়ে দেশের ২৮তম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে সংস্থাটি। জ্বালানি বিভাগ বলছে, গ্যাসক্ষেত্রটি থেকে মোট ৬৮ বিসিএফ গ্যাস পাওয়া যাবে, যার আর্থিকমূল্য হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। উত্তোলন শুরু হলে গ্যাসক্ষেত্রটি থেকে জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের দৈনিক সরবরাহ বাড়বে এক কোটি ঘনফুট।

বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে গ্যাস সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হলো স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাস অনুসন্ধান। এক্ষেত্রে দেশী গ্যাস অনুসন্ধানকারী সংস্থা বাপেক্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। দেশের স্থলভাগে বাপেক্সকে কাজ দেয়া হলে সাফল্যের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু গ্যাস খাতে বাপেক্সকে অকার্যকর করে রাখার প্রবণতা দেখা গেছে। কখনো কখনো বাপেক্সের গ্যাসক্ষেত্র বিদেশীদের হাতে দেয়ায় সংস্থাটির সব পর্যায়ের কর্মীদের মধ্যে হতাশা কাজ করেছে।

তবে এখনো গভীর সমুদ্র এলাকায় অনুসন্ধান চালানোর কারিগরি সক্ষমতা বাপেক্সের তৈরি হয়নি বলে জানিয়েছেন জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, দেশের ভূভাগে ব্যাপক সাফল্য থাকলেও এখন পর্যন্ত সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানের মতো কারিগরি সক্ষমতা তৈরি হয়নি সংস্থাটির। সাগরের গভীর অংশে খনন কার্যক্রম চালাতে পারে না বাপেক্স। বিশেষত হাই প্রেসার জোনে ড্রিলিং করতে হলে বাপেক্সকে বিদেশী কোম্পানির দ্বারস্থ হতে হয়।

দেশে বাপেক্সের আবিষ্কৃত নয়টি গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে পাঁচটি আবিষ্কার হয়েছে ৮০ ৯০-এর দশকে। বাকি চারটি আবিষ্কৃত হয়েছে গত ১০ বছরে। বর্তমানে দেশের সার্বিক গ্যাস সরবরাহে বাপেক্সের অবদান যৎসামান্য। স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে জাতীয় গ্রিডে প্রতিদিন গ্যাস যুক্ত হচ্ছে ২৬৫ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে বাপেক্সের সরবরাহ মাত্র ১৩ কোটি ৬০ লাখ ঘনফুট। সার্বিক গ্যাস সরবরাহে আধিপত্য প্রধানত বিদেশী কোম্পানিগুলোর। স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উত্তোলিত গ্যাসের দুই-তৃতীয়াংশই সরবরাহ করছে এসব কোম্পানি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আলী বণিক বার্তাকে বলেন, বাপেক্সকে এখন কাজ দেয়া হচ্ছে। আগামী ২০২৩ সাল পর্যন্ত বড় পরিকল্পনা রয়েছে বাপেক্সের। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৩টি কূপ খনন করা হবে। এর মধ্যে অনুসন্ধান কূপ, উন্নয়ন কূপ ওয়ার্কওভার কূপ রয়েছে। কাজগুলো করা গেলে আগামী ২০২৩ সাল নাগাদ দেশের জাতীয় গ্রিডে ২০০-২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত করা যাবে।

তিনি বলেন, গ্যাসের অনুসন্ধানে আমরা টুডি থ্রিডি সিসমিক সার্ভে করছি। গ্যাস উন্নয়ন উৎপাদনের মূল চালিকা হলো সিসমিক সার্ভে। এটি না হলে ড্রিলিং করা যাবে না। তিনটি থ্রিডি তিনটি টুডি প্রকল্প আগামী ২০২৪ সালে বাস্তবায়ন করা হবে। বর্তমানে জ্বালানি বিভাগের নেতৃত্বে বাপেক্স বৃহৎ আকারে অনুসন্ধানের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। আশা করছি নির্দিষ্ট সময়ে এসব কাজ বাস্তবায়িত হলে দেশের জ্বালানি খাত এগিয়ে যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন