২০০৯ সালের ১৯ মে। শ্রীলংকার পার্লামেন্টে প্রেসিডেন্ট (তত্কালীন) মাহিন্দা রাজাপাকসে সোল্লাসে ঘোষণা করলেন, ২৬ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধে লংকার সরকারি বাহিনী বিজয় অর্জন করেছে। তার এ ঘোষণার সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন চ্যানেলে লিবারেশন অব তামিল টাইগার ইলমের (এলটিটিই) শীর্ষ নেতা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের মরদেহের ছবিও সম্প্রচার করা হয়।
গৃহযুদ্ধে বিজয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলীদের মধ্যে মাহিন্দা রাজাপাকসের জনপ্রিয়তাকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। পরের বছরের নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় অর্জন করে মাহিন্দার নেতৃত্বাধীন শ্রীলংকা ফ্রিডম পার্টি (এসএলএফপি)। শ্রীলংকার সংবিধান অনুযায়ী ২০১০ সালে শুরু হওয়া ওই মেয়াদের পর রাজাপাকসের আর প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোনো সুযোগই ছিল না। তবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়ে সে বাধাও দূর করে নিলেন তিনি। অনায়াসেই পার্লামেন্টে শ্রীলংকার সংবিধান সংশোধন করিয়ে নিলেন রাজাপাকসে। এর ফলে তার ভবিষ্যতে আবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথে কোনো বাধাই থাকল না।
শ্রীলংকাভিত্তিক সংবাদ মাধ্যমগুলো বলছে, ওই সময় বিরোধী কোনো পক্ষই রাজাপাকসের এ পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ করার মতো জোরালো আওয়াজ তুলতে পারেনি। এলটিটিইকে সফলভাবে দমনের মাধ্যমে নিজের প্রথম মেয়াদেই বাজিমাত করে দিয়েছিলেন রাজাপাকসে। যদিও তখনো তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, এলটিটিইর সহায়তা নিয়েই প্রথম ২০০৫ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন তিনি।
উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া মার্কিন কূটনৈতিক নথিপত্রেও বিরোধী নেতা রনিল বিক্রমাসিংহের তোলা এ অভিযোগের সমর্থন পাওয়া গিয়েছে বলে কলম্বো টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বিক্রমাসিংহের অভিযোগ ছিল, ২০০৫ সালের নির্বাচনে শ্রীলংকার উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের তামিল ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে দেয়নি এলটিটিই। এ ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য স্থানীয় এলটিটিই নেতাদের ঘুষ দিয়েছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকসে।
রনিল বিক্রমাসিংহের দাবি, ২০০১ সালে যুদ্ধবিরতির চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে তামিল জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছিলেন তিনি। তারা ভোট দিতে পারলে নির্বাচনে তার বিজয় নিশ্চিত ছিল। এছাড়া ফেডারেল (যুক্তরাষ্ট্রীয়) কাঠামোর ভিত্তিতে তামিল-সিংহলী সমস্যা সমাধান করতে চেয়েছিলেন তিনি। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মহলের সামনে এলটিটিইর কার্যক্রমের আর কোনো যৌক্তিক ভিত্তিই অবশিষ্ট থাকত না। বরং কট্টরপন্থী রাজাপাকসে ক্ষমতায় থাকলে এলটিটিইর পক্ষে আন্তর্জাতিক সহানুভূতি আদায় করা সম্ভব ছিল। এলটিটিইর নির্বাচন বয়কটের ডাক এবং হামলার হুমকিতে সেবার তামিল ভোটারদের মাত্র ১ শতাংশ ভোট দিতে পেরেছিলেন। অন্যদিকে রাজাপাকসে জয়ী হয়েছিলেন দুই লাখেরও কম ভোটের ব্যবধানে। তামিল ভোটাররা ভোট দিতে পারলে সেবার ফলাফল ভিন্ন হওয়ারও সম্ভাবনা ছিল।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, গৃহযুদ্ধই রাজাপাকসেদের শক্তি জোগানোর পাশাপাশি সম্পদশালীও করে তুলেছে। তামিলদের সঙ্গে সিংহলীদের জাতিগত বিদ্বেষের সূচনাপর্বের সঙ্গেও পরিবারটির নাম জড়িত। গৃহযুদ্ধ শুরুর পর পরিবারটি তামিলদের সঙ্গে শত্রুতা করেছে। আবার প্রয়োজন অনুযায়ী কখনো কখনো সখ্য গড়েছে। এমনকি পরিবারের সদস্যও বানিয়েছে। মাহিন্দা রাজাপাকসের ভাতিজি নিরুপমা রাজাপাকসের স্বামী থিরুক্কুমারান নাদেসান জাতিগতভাবে একজন তামিল। স্থানীয় বেশ কয়েকটি তামিল মন্দিরের ট্রাস্টিও তিনি। মাহিন্দার আমলে এ দম্পতি শ্রীলংকায় পরিচিতি পেয়েছে ‘পাওয়ার
কাপল’ হিসেবে।
সম্প্রতি প্রকাশিত প্যান্ডোরা পেপারসে গৃহযুদ্ধের আড়ালে নিরুপমা রাজাপাকসে ও থিরুক্কুমারান নাদেসানের বিদেশে অননুমোদিত বিনিয়োগ ও অর্থপাচারের বিস্তারিত বর্ণনা উঠে এসেছে। ১৯৯০ সালে শ্রীলংকায় গৃহযুদ্ধ যখন তুঙ্গে, সে সময় থিরুক্কুমারান নাদেসান ফ্রান্সের উপকূলে অবস্থিত ব্রিটিশ ডিপেন্ডেন্সি (ব্রিটিশ রাজপরিবারের আওতাধীন স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল) চ্যানেল দ্বীপপুঞ্জে একটি ট্রাস্ট ও শেল কোম্পানি (দপ্তর ও কর্মকর্তা-কর্মচারীবিহীন যে কোম্পানির অস্তিত্ব শুধু কাগজে-কলমে। যদিও এসব কোম্পানি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, পরোক্ষ লেনদেন ও সম্পত্তির মালিকানা নিতে সক্ষম। কখনো কখনো বৈধ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যেও এসব কোম্পানি খোলা হয়) খোলেন।
সংশ্লিষ্ট নথিপত্রে দেখা গিয়েছে, প্যাসিফিক কমোডিটিজ লিমিটেড নামে ওই প্রতিষ্ঠানের আয়ের উৎস ছিল পরামর্শ সেবা। গৃহযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানিকে শ্রীলংকা সরকারের সঙ্গে নিরাপদে ব্যবসা চালানো-সংক্রান্ত ‘পরামর্শ
সেবা’ দিয়ে কোটি কোটি ডলার আয় করেছে প্যাসিফিক কমোডিটিজ।
১৯৯১ সালের মে মাসে নিরুপমা রাজাপাকসে ও থিরুক্কুমারান নাদেসান রোসেত্তি লিমিটেড নামে আরেকটি শেল কোম্পানি খোলেন। প্রতিষ্ঠানটির নথিপত্রের তথ্য অনুযায়ী, এর আয়ের উৎস ছিল গৃহযুদ্ধ জর্জরিত শ্রীলংকায় বিনিয়োগ-সংক্রান্ত পরামর্শ সেবা।
শেল কোম্পানিগুলোকে কাজে লাগিয়ে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেনামে সম্পত্তি গড়ে তুলেছেন নিরুপমা রাজাপাকসে ও থিরুক্কুমারান নাদেসান। বিদেশে বেনামে সম্পত্তি বাড়ার মধ্য দিয়েই ১৯৯৪ সালে পার্লামেন্টে সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন নিরুপমা রাজাপাকসে।
মাহিন্দা রাজাপাকসে ২০০৫ সালে প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর বড় ভাই চমল রাজাপাকসেকে পার্লামেন্টের স্পিকার হিসেবে নিয়োগ দেন। আরেক ভাই বাসিল রাজাপাকসেকে নিয়োগ দেয়া হয় অর্থনৈতিক উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে। প্রতিরক্ষা ও নগর উন্নয়ন সচিবের দায়িত্ব পান গোতাবায়া রাজাপাকসে। প্রতিরক্ষা, অর্থ, বন্দর, বেসামরিক বিমান চলাচল এবং মহাসড়ক যোগাযোগ উন্নয়ন মন্ত্রণালয় নিজের হাতেই রেখে দেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। সব মিলিয়ে শ্রীলংকার অর্থনীতির ৭০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় রাজাপাকসে ভাইদের হাতে। এছাড়া পরিবারের অন্য সদস্যদের রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়।
এলটিটিইকে দমনের দায়িত্ব দেয়া হয় সাবেক সামরিক কর্মকর্তা গোতাবায়া রাজাপাকসের কাঁধে। তার নিয়ন্ত্রণাধীন শ্রীলংকার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ওই সময় ব্যাপক যুদ্ধাপরাধ ও নির্মমতার অভিযোগ ওঠে। যদিও এসব অভিযোগের তোয়াক্কা না করেই এলটিটিইকে।
২০১০ সালে আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর নিরুপমা রাজাপাকসেকে পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। দায়িত্ব পাওয়ার পরও নিরুপমা-থিরুক্কুমারান দম্পতি বিদেশে বেনামে সম্পত্তি বাড়িয়েই চলেন।
রাজাপাকসে ভাইদের পিতা শ্রীলংকার সাবেক কৃষিমন্ত্রী ও পার্লামেন্টের ডেপুটি স্পিকার ডন আলভিন রাজাপাকসের মৃত্যু হয়েছিল অনেকটা কপর্দকহীন অবস্থায়। তার নয় সন্তানের সবাই তখন অধ্যয়নরত। তাদের পড়াশোনার খরচ জোটানোই সে সময় মুশকিল হয়ে পড়েছিল। কালের পরিক্রমায় ডন আলভিনের পরিবার এখন শ্রীলংকার সবচেয়ে প্রভাবশালী ও অন্যতম ধনী পরিবার। দেশটির জাতীয় বাজেটের প্রায় ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছেন তার সন্তানরা।
বলা হয়, শ্রীলংকার দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধ রাজাপাকসে পরিবারকে দেশটিতে ক্ষমতা সুসংহত করার সুযোগ করে দিয়েছে। নির্মম দমনের মাধ্যমে প্রায় সিকি শতকের এ গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটিয়েছিলেন আলভিন রাজাপাকসের ছেলেরা। হয়ে উঠেছিলেন সিংহলী বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের প্রতিভূ। দেশটিতে সিংহলী-তামিল দ্বন্দ্বের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে রাজাপাকসে পরিবারের নাম। শ্রীলংকার প্রথম পার্লামেন্টে সংখ্যাগুরু সিংহলীদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে ১৯৪৮ সালে পাস হয় ‘সিলোন
সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট’। ওই আইনের মাধ্যমে সিংহলী ছাড়া দেশটির অন্য জাতিসত্তার বাসিন্দাদের নাগরিক সুবিধা অস্বীকার করা হয়। সে সময় শ্রীলংকার মোট জনসংখ্যার ১১ শতাংশ ছিল তামিল। আইনটির কারণে দেশটির নাগরিকত্ব পায় মাত্র পাঁচ হাজার তামিল বাসিন্দা। রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ে সাত লাখেরও বেশি মানুষ। ওই সময় হাম্বানটোটার এমপি ডন আলভিন রাজাপাকসে এ আইনের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন।
এ গৃহযুদ্ধই রাজাপাকসে পরিবারকে বেইজিংয়ের কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। তামিল টাইগারদের দমনে প্রথমে ভারতের সহায়তা চেয়েছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। তবে ভারতের কাছ থেকে যেভাবে চেয়েছিলেন, সে সহযোগিতা পাননি তিনি। স্থানীয় জনগণের মধ্যে তামিলদের প্রতি সহানুভূতির কারণে ভারতের পক্ষে একটি পর্যায়ের পর শ্রীলংকাকে সহায়তা করা সম্ভব হয়নি। ওই সময়ে প্রত্যক্ষ সহায়তা দিতে অস্বীকৃতি জানালেও লংকার সেনাবাহিনীকে নিয়মিত গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছে ভারত। তবে মাহিন্দা রাজাপাকসের জন্য এটুকু যথেষ্ট ছিল না। ভারতের কাছ থেকে অস্ত্র সহায়তা না পেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও পাকিস্তানের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেন তিনি। বেইজিং ও ইসলামাবাদের সরবরাহ করা অস্ত্র ও সামরিক সহায়তাকে এলটিটিইর বিরুদ্ধে যুদ্ধে সফলতা অর্জন করেন রাজাপাকসে ভাইয়েরা।