মিয়ানমার-বাংলাদেশ-ভারত গ্যাস পাইপলাইন

সিদ্ধান্তহীনতার মূল্য অনেক চড়া

আবু তাহের

২০০৫ সালে ইয়াঙ্গুনে বাংলাদেশ, ভারত মিয়ানমারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে ভারতের মিজোরাম, ত্রিপুরা হয়ে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত একটি গ্যাস পাইপলাইন স্থাপনের বিষয়ে আলোচনা হয়। প্রস্তাবটি নিয়ে শুরুতে খুব একটা অনাগ্রহ ছিল না বাংলাদেশের।

ওই বৈঠকের পর এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছিল, বাংলাদেশ ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে পাইপলাইনে গ্যাস রফতানিতে সম্মতি দিয়েছে মিয়ানমার। আন্তর্জাতিক একটি কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে পাইপলাইন পরিচালিত হবে। সম্পদের পর্যাপ্ততা, নিরাপত্তা সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক সুবিধার ভিত্তিতে পাইপলাইনের রুট নির্ধারিত হবে। বাংলাদেশ ভারত উভয় দেশই নিজ নিজ প্রয়োজন অনুযায়ী পাইপলাইন ব্যবহার করতে পারবে। এমনকি চাইলে এটিকে কাজে লাগিয়ে দুই দেশ নিজস্ব চাহিদার ভিত্তিতে গ্যাস আমদানি রফতানি করতে পারবে।

জ্বালানি সংকটের দীর্ঘস্থায়ী সমাধান হিসেবে ওই সময় উদ্যোগটিকে স্বাগত জানিয়েছিলেন সংশ্লিষ্টরা। পাইপলাইনটিতে সংশ্লিষ্ট তিন দেশেরই লাভবান হওয়ার সুযোগ দেখতে পাচ্ছিলেন সবাই। যদিও শেষ পর্যন্ত অনেকটা বাংলাদেশের সিদ্ধান্তহীনতার কারণেই পাইপলাইন স্থাপন প্রকল্প আর কখনই আলোর মুখ দেখেনি।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, মূলত দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিবেচনায় বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যায় তত্কালীন সরকার। আঞ্চলিকভাবেও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক তেমন একটা ভালো ছিল না। এছাড়া ত্রিপক্ষীয় বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় কোনো আলোচনা বা চুক্তি করা যাবে না বলেও শর্ত ধরা হয়েছিল। কিন্তু চুক্তি নিয়ে আলোচনার সাইডলাইনে আকস্মিকভাবেই ভারতের ওপর বেশকিছু শর্ত আরোপ করে বাংলাদেশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে গোটা বিষয়টিই মুখ থুবড়ে পড়ে।

রাখাইনে ভূখণ্ডের বা উপকূলের অফশোর গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলিত গ্যাস পাইপলাইনে বাংলাদেশ বা ভারতে আর কখনই পরিবহন করা সম্ভব হয়নি। ২০১৫ সালে নিয়ে আবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এবার বাংলাদেশ আগ্রহী হলেও বিষয়টি খুব একটা এগোয়নি। কারণ ততদিনে রাখাইনে উত্তোলিত গ্যাস পাইপলাইনে করে চীনে পরিবহন শুরু হয়ে গিয়েছে। ২০০৮ সালে যখন ত্রিপক্ষীয় পাইপলাইন প্রকল্পটি নিয়ে এক ধরনের অচলাবস্থা বিদ্যমান, সে সময় সুযোগ কাজে লাগাতে এগিয়ে আসে বেইজিং। রাখাইন থেকে উত্তোলিত গ্যাস পরিবহনের জন্য দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক দাইয়ু ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি হাইড্রোকার্বন কেনাবেচার চুক্তি করে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশন। পাইপলাইনটি দিয়ে পরিবাহিত গ্যাসের জন্য দ্বিগুণ দামও প্রস্তাব করেছিল দেশটি। বর্তমানে রাখাইনের রামরি দ্বীপে শুরু হয়ে ৭৯৩ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইনটি শেষ হয়েছে চীনের ইউনান প্রদেশের রুইলিতে। চীনের ভেতরে পাইপলাইনটির দৈর্ঘ্য হাজার ৭২৭ কিলোমিটার।  ২০১৩ সালে সচল হয় পাইপলাইনটি। ২০১৯ পর্যন্ত পাইপলাইনটি দিয়ে মোট ৩৪ লাখ টন গ্যাস আমদানি করেছে চীন।

অন্যদিকে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের সুবর্ণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত বাংলাদেশে এখন গ্যাসের সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। সরবরাহ কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নিয়েও এক ধরনের বিড়ম্বনা দেখা দিয়েছে। উৎপাদন ঠিক রাখতে কখনো আবাসিক আবার কখনো শিল্পে গ্যাস কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। একদিকে দেশীয় গ্যাসের সংকট, অন্যদিকে এলএনজির সরবরাহ কমে সার্বিক জ্বালানি ব্যবস্থাপনাতেই মারাত্মক সমস্যা দেখা দিয়েছে। জ্বালানি বিভাগ নানামুখী পরিকল্পনা করলেও তা কাজে আসছে না। গ্যাস সংকটে জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বেড়ে গিয়েছে। যদিও বাজারের বর্তমান লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে পণ্যটির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিয়েও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিপাকে রয়েছে পরিবহন খাতও। বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি সরবরাহ বাড়াতে গত মাসের মাঝামাঝি থেকে সরকারি নির্দেশে সিএনজি স্টেশনগুলো বন্ধ থাকছে প্রতিদিন ঘণ্টা করে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাসকে কেন্দ্র করে নানামুখী পরিকল্পনা করা হলেও শুরুতেই জ্বালানি পণ্যটির সংস্থান না করায় এমন সংকট তৈরি হয়েছে। অথচ রাখাইন থেকে আসা পাইপলাইনের গ্যাসের সরবরাহ বজায় থাকলে সমস্যা থেকে অনেকটাই পরিত্রাণ পাওয়া যেত বলে মনে করছেন তারা।

বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, আজকের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে আমরা সুযোগ কাজে লাগাতে পারতাম। মিয়ানমারের সঙ্গে গ্যাস চুক্তিতে যেতে না পেরে শুধু যে বাংলাদেশের সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে এমনটি নয়। ভারতেরও অনেক বেশি সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। কম মূল্যে গ্যাস কেনার সুযোগ ছিল। সেটি করা যায়নি রাজনৈতিক, দ্বিপক্ষীয় নানা ধরনের স্বার্থসংশ্লিষ্টতা জড়িত থাকার কারণে।

তিনি আরো জানান, আলোচনা চলাকালে গ্যাসের মূল্য প্রতি এমএমবিটিইউ (মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট) ডলারের কিছু বেশি ধরে চুক্তির কথাবার্তা চলছিল। একই সঙ্গে সে চীন সময় মিয়ানমারের গ্যাস কেনার সুযোগটি কাজে লাগাল। তারা ডলার ২৫ সেন্টে গ্যাস কিনে নেয়ার চুক্তি করে। গ্যাস প্রাইসের সঙ্গে মেটাল প্রাইস, সিপিসহ সব ধরনের খরচ বিবেচনায় দামে গ্যাস কিনে নেয় চীন।

দেশে স্থানীয় পর্যায়ে উত্তোলিত গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে অনুসন্ধান কার্যক্রমের অগ্রগতিও যৎসামান্য। সমস্যা মোকাবেলায় জ্বালানি বিভাগ নানামুখী পরিকল্পনা নিলেও তা কাজে আসছে না। এখন পর্যন্ত জ্বালানির প্রাপ্যতা নিশ্চিতে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেয়া হয়নি। বাংলাদেশকে বর্তমানে গ্যাসের সংকট মেটাতে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে সুদূর মধ্যপ্রাচ্যের কাতার বা সিঙ্গাপুর থেকে। লাগামহীনভাবে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠা জ্বালানির আন্তর্জাতিক বাজার থেকে গ্যাস সংগ্রহ করতে হচ্ছে চড়া মূল্যে। সর্বশেষ গত মাসে উচ্চমূল্যে তিন কার্গো এলএনজি আমদানির উদ্যোগ নেয় জ্বালানি বিভাগ। তিনটি কার্গোতেই এলএনজি কিনতে হয়েছে রেকর্ড মূল্যে। এরই মধ্যে দেশে এসে পৌঁছা প্রথম কার্গোয় প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম পড়েছে ৩২ ডলার করে (প্রায় হাজার ৭৩৮ টাকার সমপরিমাণ) পৌঁছার অপেক্ষায় থাকা অন্য দুটির মধ্যে একটিতে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম পড়েছে ৩৫ ডলার ৮৯ সেন্ট করে। আরেকটি পড়েছে প্রায় ৩৬ ডলার ৯৫ সেন্ট করে। সব মিলিয়ে তিন কার্গো এলএনজি কিনতে পেট্রোবাংলার ব্যয় হয়েছে প্রায় হাজার কোটি টাকা।

ত্রিদেশীয় পাইপলাইন থেকে গ্যাস পাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বণিক বার্তাকে বলেন, সে সময় যতগুলো ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল তার মধ্যে জ্বালানির সরবরাহ-আমদানির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানটি ছিল একটি বড় ভুল। ফলে মিয়ানমারের কাছ থেকে আমরা কম মূল্যের জ্বালানি থেকে স্থায়ীভাবে বঞ্চিত হয়েছি। পরে সেই সুযোগ লুফে নিয়েছে চীন। তারা পাইপলাইনের মাধ্যমে মিয়ানমার থেকে গ্যাস নিয়ে যাচ্ছে। ধরনের চুক্তি থাকলে হয়তো দেশটির সঙ্গে যে স্বাভাবিক সম্পর্ক সেটি আরো ঘনিষ্ঠ হতো। ধরনের সিদ্ধান্তের কারণে প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সম্পর্কেও অনেক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন