রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক

অবলোপনকৃত ১৬ হাজার কোটি টাকা আদায় হবে কি

হাছান আদনান

হলমার্কের মতো দেশের বৃহৎ ঋণ কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়ে তুমুল সমালোচিত হয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। নজিরবিহীন অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে গ্রুপটিকে দেয়া প্রায় হাজার কোটি টাকার ঋণ আর ফেরত পাচ্ছে না ব্যাংকটি। মামলা করেও হলমার্কের কুশীলবদের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে না পেরে ঋণ অবলোপনের পথে হেঁটেছে সোনালী ব্যাংক। এরই মধ্যে হলমার্কের প্রায় হাজার ৩০০ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। তার পরও গ্রুপটির হাজার ৫০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়ে বিপদ বাড়ছে রাষ্ট্রায়ত্ত বৃহৎ ব্যাংকটির।

হলমার্কের মতোই অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণ আদায় করতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংক সোনালী, জনতা, অগ্রণী রূপালী। মামলা করেও খেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায় করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত অবলোপনের পথে হাঁটছে ব্যাংকগুলো। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংকের অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৬ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। অনিয়ম আড়াল করার পাশাপাশি আর্থিক প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখাতেই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপনের পথ বেছে নিচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হাজার ৯৯৫ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করছে সোনালী ব্যাংক। হাজার ৫৩৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করে অগ্রণী ব্যাংক রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে। আর জনতা ব্যাংক অবলোপন করেছে হাজার ৫০৫ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। রূপালী ব্যাংকও ৫৯৯ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ অবলোপনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত অবলোপনকৃত ঋণসহ রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫১ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩৪ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা আছে খেলাপির খাতায়। বাকি ১৬ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপনের মাধ্যমে আর্থিক প্রতিবেদন থেকে আড়াল করা হয়েছে।

খেলাপি হওয়ার পর মামলা করেও কোনো ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে এলে সে ঋণ অবলোপন করে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, বিতরণকৃত ঋণের সমপরিমাণ অর্থ সঞ্চিতি হিসাবে রেখে তবেই কোনো ঋণ অবলোপন করতে হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোও শতভাগ সঞ্চিতি সংরক্ষণ করেই ঋণ অবলোপন করছে। যদিও প্রতি বছরই শত শত কোটি টাকার সঞ্চিতি ঘাটতি রেখে বছর শেষের আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। এক্ষেত্রে সঞ্চিতি ঘাটতি পূরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডেফারেল সুবিধাও নিতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে।

অবলোপনের নামে ব্যাংকের ব্যালান্স শিট পরিচ্ছন্ন করে কোনো লাভ নেই বলে মনে করেন সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতাউর রহমান প্রধান। অবলোপনকৃত ঋণ আদায় করা সম্ভব হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে আতাউর রহমান প্রধান বণিক বার্তাকে বলেন, ঋণ অবলোপন করা মানে খেলাপি ঋণকে অন্ধকারে নিয়ে যাওয়া। এভাবে ঋণ অবলোপন করে কোনো লাভ নেই। সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে আমি দুই বছর দায়িত্ব পালন করছি। সময়ে আমি ব্যাংকে কোনো খেলাপি ঋণ অবলোপন করিনি। রূপালী ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালেও আমি ঋণ অবলোপনের বিরুদ্ধে ছিলাম।

সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বলেন, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত অবলোপনকৃত ঋণ থেকে ৬১ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। বছর শেষে অবলোপনকৃত ঋণ থেকে ১০০ কোটি টাকা আদায় হতে পারে। খেলাপি ঋণ রাষ্ট্রায়ত্ত সবকটি ব্যাংকের জন্যই বড় সংকট। তবে বিদ্যমান খেলাপি ঋণ রাতারাতি তৈরি হয়নি। এসব খেলাপি ঋণ আমরা উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছি।

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংক যেসব ঋণ অবলোপন করছে, তার বেশির ভাগই বড় গ্রাহকদের ঋণ। অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে এসব ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল। তার পরও বড় করপোরেটদের ঋণ দিতেই বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা। সোনালী ব্যাংক বড় চার করপোরেট গ্রাহককে ঋণ দিয়েছে হাজার কোটি টাকার বেশি। ২২ বড় করপোরেট গ্রুপের কাছে জনতা ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৭ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। অগ্রণী ব্যাংকের প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়েছে মাত্র ১৩টি গ্রুপের কাছে। ২৩ বড় গ্রাহকের কাছে ১৩ হাজার ৭১১ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে রূপালী ব্যাংকের। কোনো কোনো গ্রাহক চার ব্যাংক থেকেই বড় অংকের ঋণ নিয়েছে। হিসেবে অল্প কিছু করপোরেট গ্রাহকের কাছেই কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে সরকারি খাতের প্রধান চার ব্যাংকের ঋণ। বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকগুলোর ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণের বিকেন্দ্রীকরণের নির্দেশনাও দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। যদিও বড় গ্রাহকদেরই এখনো ঋণ দিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো।

১৩ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের পাশাপাশি হাজার ৫০৫ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। সব মিলিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত দ্বিতীয় বৃহৎ ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা। তবে অবলোপনকৃত ঋণের গ্রাহকদের মধ্যে কিছু ভালো গ্রাহকও আছে বলে জানিয়েছেন জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, এক্সিট পলিসির আওতায় আমরা কিছু গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছি। এক্ষেত্রে বেশকিছু গ্রাহক সাড়া দিয়েছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমরা অবলোপনকৃত ঋণ থেকে ৪৭ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছি। চলতি বছর শেষে ১০০ কোটি টাকার বেশি আদায় হবে বলে আশা করছি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণের পাশাপাশি অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ে তাগিদ দেয়া হচ্ছে। অবলোপনকৃত ঋণ যেন অন্ধকারে না হারায় সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক। ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত প্রতিটি বৈঠকেই অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের বিষয়টি আমরা স্মরণ করিয়ে দিই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন