বিদ্যুৎ খাতে আবারো ফিরছে রাশান প্রভাব

আবু তাহের

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ছবি: রোসাটম

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশের বিদ্যুৎ খাতে অন্যতম সহযোগী হিসেবে ছিল তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশটির প্রযুক্তিগত সহায়তায় সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সিদ্ধিরগঞ্জ ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হয় ২০১৬ সাল পর্যন্তও দেশের এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে দুটি কেন্দ্র রাশিয়ার পাশাপাশি গত এক দশকে খাতে চীন ভারত দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা বাড়িয়েছে তবে একক দেশ হিসেবে শিগগিরই আবারো বিদ্যুৎ খাতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে রাশিয়া পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শেষে দেশে রাশিয়ার প্রযুক্তিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সার্বিক উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াট

রাশিয়ান ফেডারেশনের সহযোগিতায় পাবনার রূপপুরে নির্মাণ করা হচ্ছে হাজার ৪০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে নির্মাণ প্রযুক্তি অবকাঠামোয় সহযোগিতা দিচ্ছে রাশিয়ার বিদ্যুৎ খাতের প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান রোসাটম স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন এরই মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের কাজ প্রায় ৭০ শতাংশ শেষ হয়েছে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ফুয়েল লোড করা হবে একই বছর বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে আর দ্বিতীয় ইউনিটটি উৎপাদনে যাবে ২০২৫ সালে সব মিলিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুই ইউনিট মিলিয়ে হাজার ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে

স্বাধীনতা-পূর্বকালে রূপপুরে প্রাথমিকভাবে ২০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় প্রকল্পটির জন্য প্রায় ২৬০ একর আবাসিক এলাকার জন্য আরো ৩২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয় তবে পরবর্তী সময়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পাকিস্তানের করাচিতে স্থানান্তর করা হয় স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে আবারো রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয় পরে ওই স্থানে দুটি ইউনিট মিলিয়ে হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে ২০১০ সালে পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ রাশিয়ান ফেডারেশনের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয় রাশিয়ায়

একসময় দেশের সবচেয়ে বড় তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের ছয়টি ইউনিটের সক্ষমতা সব মিলিয়ে সাড়ে নয়শ মেগাওয়াটের বেশি ১৯৬৭ সালে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজ শুরু করে রাশিয়ার টেকনোপ্রম এক্সপার্ট নির্মাণ শেষে ৫৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার প্রথম ইউনিটটির উৎপাদন শুরু হয় ১৯৭৪ সালের জানুয়ারিতে ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে উৎপাদনে আসে একই সক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিটটি ২১০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রের তৃতীয় ইউনিট ১৯৮৬ সালের সেপ্টেম্বরে উৎপাদনে আসে প্রায় সাড়ে পাঁচশ কোটি টাকা ব্যয়ে ইউনিটটি নির্মাণ করা হয় ১৯৮৯ সালের মার্চে উৎপাদনে আসে চতুর্থ ইউনিট তৃতীয় ইউনিটের মতো একই ব্যয়ে নির্মাণ করা ইউনিটটির সক্ষমতাও ২১০ মেগাওয়াট ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ২১০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন নম্বর ইউনিট উৎপাদনে আসে এটির নির্মাণে প্রায় ছয়শ কোটি টাকা ব্যয় হয় আর ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের ষষ্ঠ ইউনিটটি ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে উৎপাদনে আসে ২১০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ইউনিটের নির্মাণ ব্যয় প্রায় সাতশ কোটি টাকা ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতিটি ইউনিটের মেয়াদ ২০ বছর

স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশের বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে সিদ্ধিরগঞ্জে ১০ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয় পরবর্তী সময়ে সেখানে ১০ মেগাওয়াট সক্ষমতার আরো তিনটি স্টিম টারবাইন স্থাপন করা হয় ১৯৬০ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার প্রযুক্তিতে নির্মিত সিদ্ধিরগঞ্জের ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল সবচেয়ে বড় ধারাবাহিকতায় বর্তমানে সেখানে প্রায় এক হাজার মেগাওয়াটের তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, যা পরিচালনা করছে ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ (ইজিসিবি)

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, প্রযুক্তিগত অবকাঠামো উন্নয়নে রাশিয়া এখন একটি আদর্শ বিশেষত বিদ্যুৎ খাতে এশিয়া-ইউরোপে তারা এখন বিনিয়োগ করছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে তারা বিভিন্ন দেশকে সহযোগিতা করছে ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্বল্প খরচে বেশি বিদ্যুৎ পাওয়া যায় বলে অনেক দেশ এখন আগ্রহী হচ্ছে রাশিয়াও সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে

রাশিয়া ছাড়াও দেশের বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ রয়েছে চীন, জাপান, ভারত, সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়ার খাত বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশীদের বিনিয়োগ আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে দেশের বিদ্যুৎ খাত সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে ২০৪১ সাল নাগাদ ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতায় পৌঁছা; যেখানে চীনা বিনিয়োগের অংক ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী

বিদ্যুৎ খাতের পর্যবেক্ষকরা বলছেন, একসময় দেশের বিদ্যুৎ খাতে রাশিয়ার প্রভাব ছিল সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ধারায় পরিবর্তন এসেছে বিদ্যুৎ খাতে চীনা কোম্পানিগুলো এখন বিনিয়োগ প্রতিযোগিতায় নেমেছে বিশেষত বিদ্যুতের মেগা প্রকল্পগুলোয় তারা অর্থায়ন করছে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হলে খাতটিতে আবারো রাশিয়ার প্রভাব বাড়বে

বিদ্যুৎ হাব হিসেবে পরিচিত মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র, এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণে দেশীয় কোম্পানি কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে হাজার ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন প্রকল্পে ঋণসহায়তা দিচ্ছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন (জাইকা) প্রকল্পে ২৮ হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে সংস্থাটি

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সরকার মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে দীর্ঘমেয়াদে চুক্তিবদ্ধ এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে কোহেলিয়ায় ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র সিপিজিসিএলের সঙ্গে সিঙ্গাপুরের কোম্পানি সেম্বক্রপ যৌথভাবে প্রকল্প ২০২৯ সাল নাগাদ বাস্তবায়ন করবে মহেশখালীতে ১২০০-১৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে মালয়েশিয়ার কোম্পানি টিএনবি-পিটিবির সঙ্গে পিডিবিআরও একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যৌথ কোম্পানি গঠন করে ২০১৬ সালে হওয়া চুক্তি স্বাক্ষরে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ২০৩৩ সাল নাগাদ উৎপাদনে যাওয়ার কথা বলা হয় এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি কেপকো বিপিডিপি হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সমঝোতা স্বাক্ষর করে ২০৩৭ সাল নাগাদ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে

বিদ্যুতের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হুসাইন বলেন, দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বিশ্বের অনেক বড় বড় দেশ বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে এরই অংশ হিসেবে দেশের বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে রাশিয়াও অংশ নিয়েছে শুধু রাশিয়া নয়; বিদ্যুৎ খাতে জাপান, চীন, প্রতিবেশী দেশ ভারতও বিনিয়োগ করেছে বিদ্যুতের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণ দেশের খাতকে আরো প্রসারিত করবে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন