যশোরে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ১০ বছর পার হয়েছে। তবে এখনো মেডিকেল কলেজের জন্য অত্যাবশ্যকীয় হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা হয়নি। তাই প্রশিক্ষণ ক্লাসের জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যেতে হয় যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে। এতে ভোগান্তির শিকার হতে হয় তাদের। পাশাপাশি যশোর, নড়াইল, ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলার মানুষ উন্নত চিকিত্সা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, স্থানীয়ভাবে উদ্যোগ নেয়ার অভাবে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নির্মাণ হচ্ছে না। মেডিকেল কলেজের সঙ্গে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল চালু হলে বৃহত্তর যশোর জেলার মানুষ আরো উন্নত চিকিত্সা সেবা পেত।
মেডিকেল কলেজ সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে যশোরে মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা হয়। ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষ থেকে এমবিবিএস প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়। প্রথমদিকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে কলেজটির সব কার্যক্রম চালানো হতো। ২০১৬ সালে শহরের শংকরপুর বাস টার্মিনাল এলাকায় হরিণার বিলে ৭৫ বিঘা জমির ওপর নিজস্ব ক্যাম্পাসে স্থানান্তর করা হয় কলেজটির কার্যক্রম। বর্তমানে ইন্টার্নিসহ কলেজে চার শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছেন। তবে দীর্ঘ ১০ বছরেও এখানে চালু হয়নি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। যদিও যশোরের পর স্থাপিত পার্শ্ববর্তী জেলা সাতক্ষীরা ও কুষ্টিয়ায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চালু হয়েছে।
যশোর মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষের ছাত্র শাহাদত হোসাইন রাসেল বলেন, ‘মেডিকেল কলেজের সঙ্গে হাসপাতাল থাকলে আমাদেরসহ সাধারণ মানুষের অনেক সুবিধা হতো। আমাদের প্রতিদিন কলেজ থেকে ক্লিনিক্যাল ক্লাসের জন্য যশোর জেনারেল হাসপাতালে যেতে হয়। এতে নানা ভোগান্তিতে পড়তে হয়। যশোরে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হলে আমাদের শিক্ষার্থীদের অনেক উপকার হবে। তাই আমাদের জোর দাবি খুব দ্রুতই যেন এ হাসপাতাল নির্মাণকাজ শুরু হয়।’
যশোর মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা ইন্টার্ন চিকিত্সক ও ইন্টার্ন চিকিত্সক পরিষদের সভাপতি সাইফুদ্দিন আহমেদ খান শিহাব বলেন, ‘আমাদের কলেজের শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ ক্লাস বা কাজ রোগীদের সঙ্গে। আর রোগী পেতে হলে অবশ্যই হাসপাতাল প্রয়োজন। সে কারণে শিক্ষার্থীদের মেডিকেল কলেজ থেকে যশোর সদর হাসপাতালে আসতে হয়, যা তাদের জন্য বড় ভোগান্তির বিষয়।’
যশোর মেডিকেল কলেজের শিক্ষক নাজমুস সাদিক রাসেল জানান, ৫০০ শয্যার হাসপাতাল ছাড়া মেডিকেল কলেজ চলতে পারে না। হাসপাতাল না থাকায় আমাদের শিক্ষার্থীদের অন্য স্থানে হাতে-কলমের পাঠদান দিতে হয়। ফলে শিক্ষার্থীসহ আমাদের যাতায়াত খরচ বাড়ে এবং সন্ধ্যার পর শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটে।
যশোর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মহিদুর রহমান বলেন, ‘৫০০ শয্যার হাসপাতালের জন্য বিভিন্ন অনুদানের কথা হচ্ছিল। তাছাড়া ভারতের সঙ্গে একটা চুক্তির বিষয়ে কথাও হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত তা ফেল করেছে। হাসপাতাল নির্মাণের বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) এটা এখনো পাস হয়নি। একটা কিছু করতে গেলে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। হাসপাতাল হবে তবে সময় লাগবে।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘যশোরে বড় পর্যায়ে উদ্যোগ নেয়ার কেউ নেই। সাতক্ষীরায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী রুহুল আমিন ছিলেন। আবার মানিকগঞ্জে রয়েছেন বর্তমানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেই। সেখানে তারা নিজেরা থেকে কাজ করেছেন। যশোরে এমন কেউ নেই। বড় ধরনের উদ্যোগ নিতে পারলে কাজটা আরো দ্রুত হতে পারত। তবে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। দ্রুতই হবে বলে মনে করছি।’
যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল না থাকায় আমাদের হাসপাতালের ওপর অনেক চাপ পড়ে। সেখানকার সব শিক্ষার্থী হাসপাতালে ক্লিনিক্যাল ক্লাস করতে আসে। কলেজে শিক্ষকদের ক্লাস নিয়ে আবার এখানে এসে রোগী দেখতে হয়। মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থাকলে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি পোহাতে হতো না। শিক্ষকরা ক্লাস নিয়ে পাশেই রোগীর চিকিত্সা দিতে পারতেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে যশোরসহ আশপাশের কয়েক জেলার রোগীরা চিকিত্সা নেয়। এতে হাসপাতালে রোগীর চাপ থাকে অনেক। মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থাকলে এ চাপ কমে যেত। যশোরে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হলে সদর হাসপাতাল থেকে প্রায় ৭৫ শতাংশ রোগীর চাপ কমবে। এতে চিকিত্সা সেবার মান বাড়ানো সম্ভব হবে।’
সচেতন নাগরিক কমিটি যশোরের সভাপতি সুকুমার দাস বলেন, ‘আমরা হাসপাতালের জন্য সবসময় দাবি জানিয়ে আসছি। আমরা নামে একটা মেডিকেল কলেজ পেয়েছি। এর পূর্ণ সুবিধা পাচ্ছি না। সবচেয়ে বড় কথা, মেডিকেল কলেজের সঙ্গে যদি হাসপাতাল না থাকে তাহলে শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে শিখতে পারেন না। হাসপাতাল থাকলে শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে শিক্ষা নিতে পারত। জরুরি রোগী নিয়ে আমাদের খুলনা বা ঢাকা যেতে হতো না।’
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির (মার্ক্সবাদী) সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, ‘যশোরে সরকারি ও বেসরকারি তিনটি মেডিকেল কলেজ আছে, যার একটিরও হাসপাতাল নেই। ফলে সেখানকার শিক্ষার্থীদের যেতে হয় যশোর সদর হাসপাতালে। তাছাড়া যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থাকলে সেখানে আরো অভিজ্ঞ চিকিত্সক থাকতেন, যা আমাদের জন্য অনেক উপকারে আসত। এ বিষয়ে যশোরবাসী অনেকদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে। দ্রুত কোনো উদ্যোগ নেয়া না হলে আমরা আন্দোলনে নামব।’
এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী এবং যশোর-৫ আসনের সংসদ সদস্য স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, ‘ভারতীয় প্রকল্প নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। যে কারণে আমরা যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি রাজস্ব খাতে আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। আশা করছি শিগগিরই এটি আলোর মুখ দেখবে। আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’