শিখন ঘাটতি হ্রাসে শিক্ষা পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা প্রয়োজন

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান

দেড় বছরের বেশি সময় ধরে শিক্ষার্থীরা সশরীরে শ্রেণীকক্ষে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তবে তারা সবে শ্রেণীকক্ষে ফিরেছে। অভিজ্ঞতা পুরো এক প্রজন্মকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করবে?

স্কুলে ফিরে শিক্ষার্থীদের চোখে-মুখে যে খুশির আভা ফুটে উঠেছে তাতে বোঝা যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে আরো দেরি করাটা অমার্জনীয় হতো। নিশ্চিতভাবে এটি এক নতুন সূচনা এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকেই পুনরায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সচল করার উদ্যোগ সফল করতে সব ধরনের প্রচেষ্টা নিতে হবে। এক্ষেত্রে নিবিড় তদারকিও অত্যন্ত জরুরি।

তবে কেবলই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনরায় চালু করার মাধ্যমেই ইস্যুটি নিষ্পত্তি হবে না। কেননা কভিডকালীন দীর্ঘ ছুটিতে এটি বিপুলভাবে পুঞ্জীভূত শিখনফল (লার্নিং) হারানোর একটি জটিল সমস্যার সঙ্গে যুক্ত। পিপিআরসি-বিআইজিডির করা কভিডের প্রভাবসংক্রান্ত জরিপে প্রাথমিক মাধ্যমিকের একটা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থীদের নেয়া সাক্ষাত্কার থেকে গভীর শিখনফল হারানোর ইস্যুটি সামনে এসেছে। শিখনফল হারানো চলমান ক্লাসগুলোর মাধ্যমে পোষানো সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন হয় শ্রেণী ঘণ্টার পর, নতুবা স্কুল চলাকালীন বাইরে কমিউনিটি লার্নিং সেন্টারের মাধ্যমে একটি পরিপূরক লার্নিং লস রিকভারি প্রোগ্রাম নেয়া জরুরি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করার কাজের বাইরে এটা নিয়ে একটি জাতীয় সংলাপ আয়োজনের উদ্যোগ নেয়াটা খুবই জরুরি। যদি শিখনফল হারানোর সমস্যা কার্যকর পরিপূরক কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিকার করা না যায়, তাহলে প্রকৃত অর্থে পুরো একটি প্রজন্মই পিছিয়ে পড়তে পারে।

আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কীভাবে সাক্ষরতার সংজ্ঞায়ন করবেন? আপনার দৃষ্টিতে মানুষ জাতির জন্য সাক্ষরতা কেন গুরুত্বপূর্ণ?

করোনা মহামারীর কারণে একটি ব্যতিক্রমী দীর্ঘবিরতির পর পুনরায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলাটা কেবল শিক্ষার্থী অভিভাবকদের জন্য একটি স্বস্তিকর মুহূর্ত নয়, উপরন্তু একটি মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার আকাঙ্ক্ষী জাতির সাক্ষরতা সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা কী, সেটি পর্যালোচনা করতে পুরো সমাজের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। পড়তে লিখতে পারার সামর্থ্য সাক্ষরতার আভিধানিক সংজ্ঞার মধ্যে আটকে থাকা কতটা অর্থবহ, সে প্রশ্নও সামনে এসেছে। জরিপগুলোয় সাধারণত যাদের কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই এবং কিছু বর্ণ চেনে এমন ব্যক্তিদের সম্পর্কে একটা ন্যূনতম তথ্যে পৌঁছতে সংজ্ঞা ব্যবহার করা হয়। শিক্ষাবিদরাও ধরনের একটা ন্যূনতমবাদী সংজ্ঞায়নের বাইরে গিয়ে মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা থেকে ফাংশনাল লিটারেসি পদবন্ধটি ব্যবহার করেছেন। তবে জ্ঞান শতকে (নলেজ চেঞ্চুরি) সাক্ষরতা কোনোভাবেই একটি সংকীর্ণ ইনস্ট্রুমেন্টাল কনসেপ্টের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। সাক্ষরতার ধারণাকে একটি দৃষ্টিভঙ্গিগত সামর্থ্য হিসেবে বিবেচনায় আনতে হবে। অর্থাৎ পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ার সক্ষমতা হিসেবে দেখা প্রয়োজন। একই স্বার্থে ব্যক্তি সমাজের কল্যাণ অর্জনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামর্থ্য হিসেবেও দেখা।

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পাঠদান শিক্ষা গ্রহণ, পরিবেশ, ব্যয় কল্যাণমূলক ব্যবস্থাসহ সার্বিক অবস্থা কেমন?

এটি এক বড় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বাংলাদেশ যথার্থভাবেই প্রাথমিক মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ, বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। এমডিজি যুগে এসব ছিল চমত্কার অর্জন। কিন্তু আমরা এখন রয়েছি এসডিজি যুগে, যেখানে লক্ষ্যমাত্রাগুলো আরো উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং ফোকাস আরো বেশি জটিল। কাজেই পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি কৌশল দরকার।

মনে রাখা প্রয়োজন, দেশের শিক্ষার অবস্থা মূল্যায়নের অনেক সূচক আছে। জরিপের উদ্দেশ্য অনুসারে সূচকগুলো ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। আমার মতে, দেশের শিক্ষার সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে একটি অন্তর্দৃষ্টি পেতে চারটি সূচক খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক. শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত সম্পদ বিনিয়োগ করা হচ্ছে কিনা। দুই. খাতের সুশাসনপ্রবণতাগুলো শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জন্য একটি উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে কিনা। তিন. মানসম্মত শিক্ষাপ্রাপ্তিতে ব্যাপকতর বৈষম্য আছে কিনা এবং চার. শিক্ষিত জনশক্তিকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে শিক্ষা শিল্পের কার্যকর সংযোগ আছে কিনা।

একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের প্রথম দশকে জিডিপি অনুপাতে শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ ছিল শতাংশের কাছাকাছি। পাঁচ দশকে শতাংশ বেড়েছে, তবে তা এখনো আড়াই শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এটি + শতাংশের বেশ নিচে, যা মধ্যম আয় নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোয় শিক্ষা খাতে বরাদ্দের বৈশ্বিক গড়। বাজেট উপস্থাপনাকালে হিসাববিদ্যার অপকৌশল রূঢ বাস্তবতা লুকাতে পারেনি। অবশ্যই প্রশ্ন এই যে সমস্যা সমাধানে কেবল অর্থ ঢাললে হবে না; বরং সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রগুলোয় লক্ষ্য স্থিরীকৃত মানস্মত বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ঠিক এখানেই সমস্যার সুতাটি নিহিত। কেননা শিক্ষায় সুশাসনের সঙ্গে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ঘাটতি পুরো সমস্যাটি আরো বাড়িয়েছে, যা আসলে একদিকে দলীয় রাজনৈতিকীকরণ, অন্যদিকে আমলাতান্ত্রিক নজরদারির ঘেরাটোপ উভয়সংকটে বন্দি। আশার কথা শুধু এই যে শিক্ষক শিক্ষার্থীর একটি অংশ এসব প্রতিকূলতার মাঝেও তাদের শিক্ষার আকাঙ্ক্ষার বাতি জ্বালিয়ে রাখতে সংগ্রাম করে যাচ্ছে।

গ্রাম শহর এবং সম্পদ প্রাচুর্যের স্কুল সম্পদ অপ্রতুল স্কুলের মধ্যেও শিক্ষাগত বৈষম্য ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ডিজিটাল সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তিতেও ব্যাপক বৈষম্য রয়েছে। কভিডকালীন দীর্ঘ ছুটিতে এটি বৈষম্যের একটি নতুন ফ্যাক্টর হিসেবে সামনে এসেছে। শিক্ষা শেষ করার পর কর্মসংস্থানের বাস্তবতাও সমানভাবে উদ্বেগজনক। একটি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান হলো যে ২৯ দশমিক শতাংশ তরুণ জনগোষ্ঠী শিক্ষা, কর্মসংস্থান, প্রশিক্ষণের (এনইইটি) কোথাও নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্নাতকদের ওপর পরিচালিত সমীক্ষা ইঙ্গিত দেয় যে সেখান থেকে পাস করা ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থীই বেকার থেকে যাচ্ছে।

এভাবে গত ৫০ বছরের পরিভ্রমণে শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করলেও কেবল এসব অতীতের অগ্রগতি ফিরে দেখাটা আর কোনো ইস্যু হতে পারে না। আজকের এবং আগামীর চ্যালেঞ্জ উত্তরণের প্রশ্নের জায়গা থেকে শিক্ষার প্রকৃত বাস্তবতা একটা নাজুক ভিত্তির মধ্যে রয়েছে, ওপরের আলোচনায় যেমনটা স্পষ্ট।

মানোন্নয়নে প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কী?

কঠিন শোনালেও আমি একটি প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই। জাতি হিসেবে আমরা মানসম্মত শিক্ষাকে আসলে কতটা প্রাধিকার দিয়েছি? অসংখ্য নীতি দলিল অগণন সেমিনার অনুষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও আমার মনে হয়, আমাদের মূল আগ্রহ রয়ে গেছে শুধু বিস্তারে, মানে নয়। ফলে জাতীয় শিক্ষাদর্শন কার্যত আটকে আছে নিম্নমানের সর্বজনীন শিক্ষায়। গুণগত শিক্ষার দ্বীপগুলো নিম্নমানের শিক্ষার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে।

রাজনৈতিক প্রাধিকার হলো শিক্ষার সম্প্রসারণ সর্বজনীনতা, কিন্তু শিক্ষার মান কার্যকরভাবে কাগুজে লক্ষ্যে রয়ে গেছে। পুরো বাংলাদেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট আন্ডারগ্রেড প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্প্রসারণশীল নেটওয়ার্ক এমন সব স্নাতক তৈরি করছে শ্রমবাজার উপযোগী দক্ষতা যাদের খুব কমই রয়েছে। ফলে দুটি স্ববিরোধী বাস্তবতা পরস্পরের মুখোমুখি। শিক্ষিত তরুণরা বলছে, আমরা চাকরি পাচ্ছি না। অন্যদিকে নিয়োগকর্তারা বলছেন, আমরা যোগ্য কর্মী পাচ্ছি না।

কেউ যদি শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের মর্মকথা উন্মোচন করে তাহলে গুণগত শিক্ষায় মনোযোগের ঘাটতিও খোলাসা হবে। শিক্ষা খাতে ভবন অবকাঠামো নির্মাণে মনোযোগ বেশি, কিন্তু এসব ভবন ব্যবহারের কার্যকারিতা বাড়াতে পর্যাপ্তসংখ্যক যোগ্য লোক নিয়োগ, শিক্ষা উপকরণ জোগানো কিংবা গবেষণার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির প্রতি তেমন একটা নজর নেই। কেউই সদুত্তর দিতে পারে না কেন প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষের তাত্পর্যজনক মঞ্জুরীকৃত পদ খালি রেখে ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তি দিয়ে কাজ সারানো হচ্ছে। গাইডবইয়ের রাজত্ব মানের আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিনিয়ত বিদ্রূপের বিষয়বস্তুতে রূপান্তর করছে।

এরপর সুশাসনের প্রশ্ন তো আছেই। স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটিতে কাদের রাখা হয় এবং সমকালীন বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনাস্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্তক্ষমতা বলয়গুলোর কাছে কতটুকু নতজানু সেটিও বিবেচ্য বিষয়। মাঝে মধ্যেই সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে বাস্তবতাগুলো উঠে আসে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গণহারে রাজনৈতিকীকরণ মান নিশ্চিতের নীতি-বিধিমালা প্রণয়ন সম্পর্কিত উদ্বেগগুলো জলাঞ্জলি দিয়েছে।

স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশে শিক্ষা খাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুশাসন স্তম্ভ ছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়মিত স্কুল পরিদর্শন। গুরুত্বপূর্ণ কাজটি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। শিক্ষা কার্যালয়ের প্রাধিকারগুলো স্থানান্তরিত হয়েছে প্রকল্পে এর সঙ্গে রয়েছে মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ থেকে আমলাতান্ত্রিক নজরদারির অব্যাহত বৃদ্ধি, যা শিক্ষকদের মানসম্মত শিক্ষা এজেন্ডায় চালকের আসন থেকে বিচ্যুত করেছে এবং তাদের আমলাতান্ত্রিক অধস্তনে পরিণত করেছে। এসব প্রবণতার সার্বিক পরিণাম হলো বিদ্যমান ব্যবস্থায় গুণগত মানের এজেন্ডার ব্যাপারে কোনো প্রকৃত দাবিদার না থাকা।

বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী বিদেশে, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোয় যাচ্ছে। ধরনের প্রবণতাগুলো গুণগত শিক্ষার প্রতি উচ্চতর চাহিদাই প্রকাশ করে প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক ত্রুটিগুলো সংশোধনের এটিই সুবর্ণ সময় নয় কি?

এটি যদি নিছকই গুণগত শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীরা বিদেশে যাচ্ছে এমন হতো, তাহলে জাতীয় আকাঙ্ক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে এটি বড় কোনো ইস্যু ছিল না। দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, ধরনের প্রবণতা মেধা স্থানান্তর-ব্রেইন ড্রেইন প্রতিফলন ঘটায় কিনা। তরুণদের জন্য এখানে উদ্বেগ দুই ধরনের। এক. দেশের মধ্যে গুণগত শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ আছে কিনা এবং দুই. শিক্ষা শেষে লাভজনক কর্মসংস্থানের (গেইনফুল এমপ্লয়মেন্ট) পর্যাপ্ত সুযোগ আছে কিনা। উভয় দিক থেকে বাস্তব গভীরতর উদ্বেগ বিরাজমান। মেধা অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিচারে যাদের সামর্থ্য আছে তারা অব্যাহতভাবে বিদেশ যাওয়ার এবং পরবর্তী সময়ে সেখানে লাভজনক কর্মসংস্থানের পথ বেছে নেয়ার দিকে ঝুঁকছে। যদি ধরনের ছদ্মাবেশী ব্রেইন ড্রেইন পাকাপোক্ত হয়, তাহলে সেটি দেশকে মধ্যম আয়ের আকাঙ্ক্ষায় মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন