বিজ্ঞান শিক্ষা এবং বিজ্ঞানচর্চার একাল সেকাল

ড. সালেহ্ হাসান নকীব

বর্তমান বিশ্বে প্রাকৃতিক সম্পদকে আর সবচেয়ে বড় সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। মানবসম্পদ প্রাকৃতিক সম্পদের জায়গাটি দখল করে নিয়েছে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এর চমত্কার উদাহরণ। জনসংখ্যা কেবল তখনই জনসম্পদে পরিণত হয়, যখন তারা সুশিক্ষিত। বিশ্বের দরবারে মর্যাদাবান প্রতিটি রাষ্ট্রের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে এই রাষ্ট্রগুলো শিক্ষা, বিশেষ করে বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে অগ্রগামী। এর কোনো ব্যতিক্রম চোখে পড়বে না।

বিজ্ঞান গবেষণা নিয়ে যেকোনো আলোচনা শুরু করতে হলে প্রথমেই শিক্ষার সামগ্রিক চিত্রটি আমাদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন। বিজ্ঞান শিক্ষা সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে কিছু নয়। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। বিদ্যার্থীদের সংখ্যাও বেড়েছে একই হারে। একাধিক শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে। শিক্ষানীতিতে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক দর্শন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে বারবার। শিক্ষা নিয়ে গবেষণা খুব কম হয়নি। বারবার পরিবর্তন আনা হয়েছে। বাহ্য পরিবর্তন। সুফল মিলেছে কতটুকু? এই অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে পাওয়া প্রয়োজন।

শিক্ষাক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি যা হয়েছে তা অনেকটাই সমান্তরাল। ইংরেজিতে বলে horizontal growth সংখ্যা যে হারে বেড়েছে, গুণগত মানের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। আমরা যারা শিক্ষকতা পেশায় আছি তারা এটা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করি। এর কারণ কী? কারণ বিশ্লেষণ করতে বসলে প্রথমেই আসে দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্ন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দেশে আমরা জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি এবং জ্ঞানীর মূল্যায়ন দুটো করতেই অনেকখানি ব্যর্থ হয়েছি। সমস্যাটি সামাজিক রাজনৈতিক। সমাজ রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চায় সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের ভেতর কিছু ভ্রান্ত ভাবধারা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব গিয়ে পড়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ-বিত্ত, পেশিশক্তি, রাজনৈতিক প্রভাব ইত্যাদি সমাজে বিশেষভাবে মূল্যায়িত। জ্ঞানই শক্তি এটা এখন অনেকটাই কথার কথা। অর্থনৈতিক সামাজিক পরিস্থিতি এখনো শিক্ষাকে মূলত শুধু জীবিকা অর্জনের একটি মাধ্যম ছাড়া আর কিছু ভাবতে উৎসাহী করে না। এই মানসিকতা সার্টিফিকেটসর্বস্ব একটি শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। Passionate learner বলে যে একটা কথা আছে, তা আমাদের দেশে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, গবেষকদের মধ্যে অনেকটাই অনুপস্থিত। অত্যন্ত সংক্ষেপে এই হচ্ছে প্রেক্ষাপট।

১৯৭১ সালে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা কয়েকটি। এর সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ। অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের কলেবর বেড়েছে বহুগুণে। বাংলাদেশ বিজ্ঞান শিল্প গবেষণাগারের সংখ্যা, জনবল এবং সাজসরঞ্জাম বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। কৃষি গবেষণায় নতুন নতুন ইনস্টিটিউট গড়ে উঠেছে। ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত আইসিডিডিআর,বি জনস্বাস্থ্য খাতে একটি বিশ্বমানের গবেষণা কেন্দ্রের মর্যাদা লাভ করেছে। এর প্রত্যেকটি একেকটি ইতিবাচক দিক। তবে একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন, বিজ্ঞান শিক্ষা গবেষণায় সাফল্যের আন্তর্জাতিক মাপকাঠি রয়েছে। সাফল্য এবং ব্যর্থতা এই মাপকাঠি অনুযায়ী নির্ণীত হয়। বাংলাদেশী বিজ্ঞান অথবা স্ট্যান্ডার্ড বলে কিছু নেই।

স্বাধীনতার পর থেকে বিজ্ঞান গবেষণায় ধারাবাহিক সাফল্যের কথা বিবেচনা করলে সবচেয়ে এগিয়ে থাকবে কৃষি সেক্টর। উচ্চফলনশীল বিভিন্ন প্রজাতির শস্যবীজ, রোগ প্রতিরোধী উচ্চফলনশীল বিভিন্ন জাতের ফলফলাদি শাকসবজির উদ্ভাবন আমাদের দেশে কৃষিক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সোনালি আঁশ পাটের এবং জাতীয় মাছ ইলিশের জিনোম সিকুয়েন্স উন্মোচিত হয়েছে। এর ফলে বৈশ্বিক জ্ঞানভাণ্ডারে নতুন জ্ঞান সংযোজিত হয়েছে। মত্স্য পশু পালন খাতেও ধারাবাহিক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। এসব সাফল্যের পেছনেই আছে কিছু নিবেদিতপ্রাণ গবেষকের মেধা প্রচেষ্টা।

ভৌতবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। দীর্ঘ সময়ে ভৌতবিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণা গবেষকের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এই ৫০ বছরে উত্কর্ষতার যে নমুনা তা অনেকটাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। আন্তর্জাতিক মানের কিছু গবেষক আমরা পেয়েছি। তাদের ভেতর অনেকেই বর্তমানে গবেষণাকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে সবচেয়ে বেশি যেটি প্রয়োজন ছিল, গবেষণার ক্ষেত্রে সেন্টার অব এক্সসিলেন্স, তা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সেভাবে গড়ে ওঠেনি। গবেষণায় উন্নত সব রাষ্ট্রের মূল শক্তি কিন্তু এই সেন্টার অব এক্সসিলেন্সগুলো। আমাদের আশপাশের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভারতে Tata Institute of Fundamental Research (TIFR) এবং পাকিস্তানে National University of Science and Technology (NUST) বিজ্ঞান গবেষণায় সেন্টার অব এক্সিলেন্স হিসেবে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। এমন আরো উদাহরণ আছে। এই গবেষণা কেন্দ্রগুলো একটিও ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়। ব্যক্তিনির্ভর গবেষণাগারগুলোর দীর্ঘমেয়াদে উজ্জ্বল কোনো ভবিষ্যৎ থাকে না।

নিজে পদার্থবিজ্ঞানের একজন ছাত্র হওয়ায় ভৌতবিজ্ঞানের শাখাটি সম্পর্কে কিছু ধারণা আছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তত্কালীন পদার্থবিজ্ঞানীদের উদ্যোগে Bangladesh Physical Society (BPS) প্রতিষ্ঠিত হয়। মরহুম প্রফেসর এম ইন্নাস আলী BPS-এর প্রথম ফেলো নির্বাচিত হন। জন্মলগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত BPS প্রায় প্রতি বছর পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে কনফারেন্স আয়োজন করে থাকে। কনফারেন্সের পরিসর ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপস্থাপিত গবেষণাপত্রগুলোর গুণগত মান একটু একটু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বৃদ্ধির হার সন্তোষজনক বলা যাবে না। বেশির ভাগ কাজ অত্যন্ত গতানুগতিক এবং প্রাথমিক পর্যায়ের। পদার্থবিজ্ঞানীদের শীর্ষ সংগঠন হিসেবে দেশে বিজ্ঞান গবেষণা শিক্ষায় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে BPS-এর যে ভূমিকা থাকা উচিত ছিল, সেই ভূমিকা সংগঠনটি পালন করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। এই একই কথা সম্ভবত অন্যান্য বিষয়ে বিজ্ঞান সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ১৯৭৩ সালে ১২ জন প্রতিষ্ঠাকালীন ফেলো নিয়ে বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি (Bangladesh Academy of Sciences, সংক্ষেপে (BAS) তার যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে ফেলো এবং সহযোগী ফেলোর সংখ্যা প্রায় শতাধিক। ২০১৬ সাল থেকে সহযোগী ফেলোশিপের সুযোগ রাখা হয়েছে। এটি একটি শুভ উদ্যোগ। এর ফলে অপেক্ষাকৃত তরুণরা বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। BAS বাংলাদেশে বিজ্ঞান বিষয়ে শীর্ষ সংগঠন। সেরা বিজ্ঞানীদের BAS ফেলোশিপ প্রদান করা হয়। প্রতি বছর বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি বেশকিছু সেমিনার, কনফারেন্স কর্মশালার আয়োজন করে থাকে। দেশজুড়ে বার্ষিক বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের আয়োজকও হচ্ছে BAS এছাড়া কৃতী গবেষকদের বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পদকের জন্য বাছাই করার কাজটি প্রতি বছর বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমিই করে থাকে। তার পরও বলতে হয়, বিজ্ঞানে শীর্ষ সংগঠন হিসেবে যে ধরনের গতিশীলতা থাকা প্রয়োজন তাতে ঘাটতি রয়ে গেছে। বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে সংগঠনের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা উচিত তা সংগঠনটি বিভিন্ন কারণে রাখতে পারছে না। ধারা অব্যাহত থাকলে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান প্রযুক্তিবিষয়ক সংগঠনগুলোর শুধু কাগুজে সংগঠনে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা আছে।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর এএম হারুন-আর-রশিদ, প্রফেসর হিরন্ময় সেন গুপ্ত, প্রফেসর শমসের আলী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর আহমাদ হোসেইন, প্রফেসর অরুণ কুমার বসাক, প্রফেসর একেএম আজহারুল ইসলাম প্রমুখ একটি গবেষণা সংস্কৃতি গড়ে তুলতে আত্মনিয়োগ করেন। প্রফেসর একেএম আজহারুল ইসলাম এবং প্রফেসর অরুণ কুমার বসাকের গবেষণাগারে এখনো জোরালো গবেষণা কার্যক্রম জারি আছে। প্রায় তিন দশক ধরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লাজমা ফিজিক্স গ্রুপটি ভালো মানের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে প্রফেসর আব্দুল্লাহ্ আল মামুনের নেতৃত্বে গ্রুপটি গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রফেসর মামুন একজন বিশ্বমানের গবেষক। এছাড়া বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অপেক্ষাকৃত নবীন গবেষকদের নেতৃত্বে ভালো মানের গবেষণা চলছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও অল্প কিছু গবেষক উন্নত মানের গবেষণা কাজে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান শিল্প গবেষণাগারে কিছু কাজ হচ্ছে। এসব কার্যক্রম আমাদের আশাবাদী করে। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, উদাহরণগুলো সামগ্রিক অবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে না। সামগ্রিক অবস্থাটি ভিন্ন।

বিজ্ঞান শিক্ষা বিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণার মাপকাঠি বিশ্বজনীন। কোনো রাষ্ট্রই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়, তাই অর্জন এবং অনার্জনের হিসাব করতে বসলে তুলনার ব্যাপারটি অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতির কলেবর বেড়েছে বহুগুণ। মাথাপিছু জিডিপি হিসাব করলে বাংলাদেশ পাকিস্তান প্রায় একই কাতারে। ভারত কিছুটা এগিয়ে আছে। বিজ্ঞান গবেষণায় বাংলাদেশ, ভারত পাকিস্তানের তুলনামূলক অবস্থানটি কেমন? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উন্নতির ধারাটি আমাদের কী নির্দেশনা দেয়? প্রশ্ন দুটি গুরুত্বপূর্ণ এবং এর উত্তরের ভেতর বহু ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে। Scimago Journal and Country Rank, সংক্ষেপে SJR, বিজ্ঞান গবেষণাভিত্তিক পরিসংখ্যানের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য ডাটাবেজ। SJR-এর তথ্যমতে, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ২২ বছরে স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক জার্নালগুলোয় ভারত থেকে প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। এই একই সময়ে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা ৪১ হাজারের মতো, পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত হয়েছে প্রায় লাখ ২৮ হাজার বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ। ভারতের জনসংখ্যা আমাদের প্রায় আট গুণ, পাকিস্তানের জনসংখ্যা বাংলাদেশ থেকে কিছু বেশি। জনসংখ্যার যথাযথ হিসাব নেওয়ার পরও এটি সুস্পষ্ট যে, আমরা ভারত থেকে তো বটেই, পাকিস্তানের তুলনায়ও বিজ্ঞান গবেষণায় যোজন যোজন পিছিয়ে আছি। পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিষয়টি কেমন? ২০০০ সালে শুধু মৌলিক পদার্থবিজ্ঞান জ্যোতির্বিদ্যায় বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত উচ্চমানের প্রবন্ধের সংখ্যা ২৩, পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত হয়েছে ২৮টি। খুব বেশি পার্থক্য নেই। ২০১৭ সালে একই বিষয়ে বাংলাদেশে থেকে প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা ২৫০, পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত হয়েছে ৮৪৪। পার্থক্যটি এখন অত্যন্ত চোখে পড়ার মতো। ভারতের প্রসঙ্গ আর না- টানি। আমরা যে বিজ্ঞান গবেষণায় অনেক পিছিয়ে পড়েছি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাহ্যিক চাকচিক্য আর রাজনৈতিক গলাবাজি বিজ্ঞান গবেষণায় এই দৈন্য ঢাকতে পারেনি।

কেউ কেউ বলে থাকেন, সম্পদের স্বল্পতা বিজ্ঞান শিক্ষা গবেষণায় সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। যুক্তি ধোপে টেকে না। সম্পদের স্বল্পতা মূল কারণ হলে পাকিস্তানের মতো একটি রাষ্ট্র আমাদের থেকে এতটা এগিয়ে যেতে পারত না। দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে বিভিন্ন মেগা প্রজেক্টে কখনো অর্থ সংকটের কথা শোনা যায় না। শিক্ষা গবেষণায় বরাদ্দের প্রশ্ন উঠলেই দেখা দেয় সমস্যা। বরাদ্দ যেটুকু তার সুষ্ঠু সদ্ব্যবহার হচ্ছে কিনা, তাও একটি বড় প্রশ্ন।

২০০৯ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন একটি প্রোজেক্ট হাতে নেয় Higher Education Quality Enhancement Project (HEQEP) প্রকল্পের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ প্রায় কোটি ডলার। প্রকল্পটি বছর শেষ হতে যাচ্ছে। এই বারাদ্দের ফলে বাংলাদেশে গবেষণার ক্ষেত্রে ঠিক কী ধরনের গুণগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, তা নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ এবং তথ্যভিত্তিক সমীক্ষার প্রয়োজন।

মূল সমস্যা হচ্ছে শিক্ষা গবেষণার প্রকৃত মূল্য উপলব্ধিতে বিপুল ব্যর্থতা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আমাদের দেশে শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ একেবারে নিচের দিকে। একটি রাষ্ট্রের সম্মান সক্ষমতা অনেকটাই নির্ভর করে গবেষণা উন্নয়ন খাতে দক্ষতার ওপর। ইন্টারনেটে খুঁজলে বিভিন্ন রাষ্ট্র এই গবেষণা উন্নয়ন খাতে কতটুকু ব্যয় করে তার একটি তালিকা চোখে পড়বে। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান সুখকর নয়।

শিক্ষা গবেষণায় এই অবহেলা আমাদের ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে নিয়ে যাবে। পাবলিক প্রাইভেট মিলে প্রায় দেড়শ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর একটিও আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে পারেনি। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা হয়ে পড়েছে সাজেশন, সার্টিফিকেট মুখস্থনির্ভর। গবেষণার পরিমাণ বাড়লেও, রিসার্চ এথিক্সে আমরা এখনো অত্যন্ত দুর্বল। হরেক অনিয়ম এখানে বাসা বেঁধেছে। প্রায়ই গবেষণায় অসততার লজ্জাজনক কিছু খবর পত্রিকার পাতায় দেখতে পাই। এটি হিমশৈলীর অগ্রভাগ মাত্র। প্রকৃত অবস্থা অনেক বেশি খারাপ। মানহীন জার্নালে কিছু অর্থের বিনিময়ে সস্তা প্রকাশনার দিকে একদল গবেষক ঝুঁকে পড়ছে। ধারাটি বর্তমানে অত্যন্ত শক্তিশালী। নজরদারির জন্য উপযুক্ত কোনো ব্যবস্থা নেই। সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয় একটি সুস্থ, প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষা গবেষণা সংস্কৃতি স্বাধীনতার এত বছর পরও দেশে গড়ে ওঠেনি। এর দায়দায়িত্বের একটি বড় অংশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কাঁধেই বর্তায়। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা আছেন তাদের ভেতর প্রকৃত গবেষকের সংখ্যা অত্যন্ত কম। বিজ্ঞান ভালো বোঝেন, শিক্ষণবিদ্যায় পারদর্শীএমন উপযুক্ত মানুষ যথাস্থানে কমই দেখা যাবে। আমাদের মূল্যায়ন মাপকাঠি উভয়ই ত্রুটিযুক্ত।

স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত শুধু সংখ্যা বিচার করলে কিছু কিছু উন্নতি যে হয়েছে তা স্বীকার করতেই হবে। সমস্যা হচ্ছে বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে আরো অনেক বেশি দ্রুতগতিতে। এখানেই আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা থাকেন তাদের শিক্ষা গবেষণার প্রকৃত মূল্য উপলব্ধি করতে হবে। চিন্তার বিকাশ, প্রকাশ সৃজনশীলতার জন্য একটি পরিবেশ প্রয়োজন। প্রয়োজন হয় প্রণোদনার। এই প্রয়োজন মেটাতে সরকারের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী গবেষকদের একটি সমন্বিত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এখন সময়ের দাবি। আমরা অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছি। সম্মিলিত সমন্বিত প্রচেষ্টায় এই পিছিয়ে পড়া রুখে দিতে হবে।

 

. সালেহ্ হাসান নকীব: প্রফেসর, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন