ব্যবস্থাপনা ও উচ্চশিক্ষা উন্নয়নে আইবিএ

ড. আবদুর রব

আইবিএ প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ শফিউল্লাহ। আইবিএ প্রতিষ্ঠা করার কাজটি খুব সহজ ছিল না। বাণিজ্য শিক্ষার একটি বিভাগ থাকতেও অনুরূপ আরেকটি বিভাগ তথা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করার যৌক্তিকতা প্রমাণ করা কষ্টসাধ্য ছিল। তবে ১৯৫৫ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে করাচিতে আইবিএ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানেও এটা হওয়া উচিতএটি একটি সংবেদনশীল যুক্তি ছিল।

অধ্যাপক শফিউল্লাহ তত্কালীন উপাচার্য অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, ঢাকায় আইবিএ প্রতিষ্ঠা করা একটি যুক্তিসংগত পদক্ষেপ এবং এর উদ্যোগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রাজি হয়ে একটি অধ্যাদেশ জারি করে। অধ্যাপক শফিউল্লাহকে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করা হয়।

যেসব উদ্দেশ্য নিয়ে আইবিএ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা ছিল নিম্নরূপ:

. ডিগ্রি প্রোগ্রামের মাধ্যমে দক্ষ ব্যবস্থাপনা গ্র্যাজুয়েট তৈরি করা তাদেরকে প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দানের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা। . সার্টিফিকেট কোর্সে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মরত ব্যবস্থাপকদের ব্যবস্থাপনা দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা। . কনসালট্যান্সি কাজের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা সিস্টেমের উন্নয়ন করা।

তিনটি কাজের সার্বিক লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের ব্যবসা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে অবদান রাখা। এছাড়া আরো একটি মহৎ উদ্দেশ্য ছিল। সেটি হচ্ছে উচ্চমানসম্পন্ন আধুনিক উচ্চশিক্ষার সিস্টেম চালু করে উদাহরণ সৃষ্টি করা, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এটাকে অনুসরণ করে তাদের শিক্ষার মান বাড়াতে পারে।

আইবিএ প্রথম লক্ষ্য অর্জনের জন্য এমবিএ প্রোগ্রাম শুরু করে। আইবিএর নিজস্ব ভবন তৈরি হওয়ার অপেক্ষায় না থেকে কলাভবনের কয়েকটি রুম নিয়ে ১৯৬৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে তিনজন আমেরিকান শিক্ষক কয়েকজন স্থানীয় শিক্ষক এবং ৩৫ জন ছাত্র নিয়ে এমবিএ প্রথম ব্যাচের ক্লাস শুরু হয়। এমবিএ প্রোগ্রামের জন্য উপযুক্ত ছাত্র নির্বাচনের জন্য প্রথম ব্যাচ থেকেই ভর্তি পরীক্ষা চালু হয়।

এমবিএতে পড়ানোর জন্য উপযুক্ত শিক্ষক বলতে গেলে দেশে ছিল না। স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগের জন্য প্রার্থী বাছাই করে এমবিএ পড়ার জন্য ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটিতে পাঠানো হয়। একই স্কুলে এবং একই ডিগ্রি করার জন্য উচ্চমানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন দিক, শিক্ষার পরিবেশ কালচার তাদের মধ্যে অভিন্ন মূল্যবোধ দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করেছিল যা পরবর্তীকালে আইবিএর শিক্ষাব্যবস্থা উচ্চমান সংরক্ষণে খুবই সহায়ক হয়েছিল।

এমবিএর শিক্ষা পদ্ধতির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ব্যবহারিক শিক্ষা অর্থাৎ ব্যবসায় ব্যবস্থাপনার তত্ত্ব কোথায় কীভাবে কাজে লাগাতে হয় তা শেখানো। এর জন্য কেস স্টাডিসহ বিভিন্ন আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি অনুসরণ করা হতো। এছাড়া ইন্টার্নশিপে ব্যবসার ব্যবস্থাপনার কলাকৌশল স্বচক্ষে দেখে এবং হাতে-কলমে করে ছাত্রদের যে বাস্তব অভিজ্ঞতা ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জিত হতো তা এমবিএ পাস করার পর চাকরি পেতে সহায়ক হতো।

শুরু করার কয়েক বছর পর দেখা গেল এমবিএর জন্য উপযুক্ত প্রয়োজনীয় সংখ্যক ছাত্র পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের দেশে শিক্ষার্থীরা ক্যারিয়ার বেছে নেয় এইচএসসি পাস করেই। যদি ভালো শিক্ষার্থী চাই তাহলে এইচএসসি থেকে আনতে হবে। তাহলে ব্যাচেলর ডিগ্রি বিবিএ শুরু করতে হবে। তাই ১৯৮৯ সালে চার বছর মেয়াদি বিবিএ প্রোগ্রাম শুরুর ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ কিছু বাধা-বিপত্তি প্রতিবন্ধকতার কারণে বিবিএ প্রোগ্রাম শুরু করা পিছিয়ে যায় এবং এটা ১৯৯৩ সালে শুরু করা হয়। এর আগে পিএইচডি প্রোগ্রাম শুরু করা হয়। এরপর একপর্যায়ে এক্সিকিউটিভ এমবিএ প্রোগ্রাম শুরু করা হয়। ইতোমধ্যে বিভিন্ন সময়ে সার্টিফিকেট কোর্স সফলভাবে সম্পন্ন করা হয় এবং ছয় মাস মেয়াদি এসিবিএ চালু করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে এবং এখনো ম্যানেজমেন্ট ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের অধীনে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্স অব্যাহত আছে। একপর্যায়ে আইবিএ উচ্চমানসম্পন্ন ডক্টরেট ডিগ্রি ডিবিএ চালু করতে সক্ষম হয়।

আইবিএর দক্ষ ব্যবস্থাপক গ্র্যাজুয়েট তৈরির লক্ষ্যমাত্রা সফলভাবে এগিয়ে চলেছে। গত ৫৫ বছরের ১০ হাজারের বেশি গ্র্যাজুয়েট বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন এবং প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্বদানে এগিয়ে রয়েছেন। অনেক গ্র্যাজুয়েট ব্যাংকসহ অন্যান্য অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে শীর্ষপদ অলংকৃত করেছেন। অনেক গ্র্যাজুয়েট আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যেমন ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ইউনিসেফ, ডব্লিউএফপি, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ইত্যাদিতে সুনামের সঙ্গে ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করেছেন।

শত শত কর্মরত ব্যবস্থাপক সার্টিফিকেট প্রোগ্রামের অধীনে আধুনিক ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষিত হয়েছেন। গ্র্যাজুয়েট এবং এসব ব্যবস্থাপকরা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া পদ্ধতিতে গুণগত মান উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এর নজির যেকোনো স্বনামধন্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গেলেই পাওয়া যাবে। অনেক গ্র্যাজুয়েট নিজস্ব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করে অন্ট্রাপ্রেনিউর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন।

আইবিএর ছাত্ররা দেশে-বিদেশে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় শীর্ষস্থান অধিকার করে সুনাম অর্জন করেছে। অনেক গ্র্যাজুয়েট বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে সেসব দেশে অধ্যাপনা অন্যান্য পেশায় যোগ দিয়েছেন। অনেকে বিদেশে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন। ডিবিএ এবং পিএইচডি ডিগ্রিধারী গ্র্যাজুয়েটরা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ হিসেবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন। কনসালট্যান্সি সার্ভিসের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা সিস্টেম উন্নয়নেও আইবিএ অনেক অবদান রেখেছে। এক কথায় বলা যায়, আইবিএ বাংলাদেশে আধুনিক ব্যবস্থাপনা প্রচলনের পথিকৃৎ।

উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়নের পথিকৃৎ হিসেবে আইবিএ আগে যেমন নিজের অবস্থান করে নিয়েছে, তেমনি অন্যদের জন্য উদাহরণ হয়ে আছে। অ্যাডমিশন টেস্ট আইবিএর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রথমদিকে প্রথা অন্য বিভাগে গ্রহণযোগ্য না হলেও পরবর্তী পর্যায়ে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরে অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয় অনুসরণ করতে শুরু করে। বিবিএর চার বছর মেয়াদি কারিকুলাম কালক্রমে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গৃহীত হয়। একইভাবে সেমিস্টার সিস্টেম লেটার গ্রেডিং সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুসৃত হয়েছে। এসব বিবেচনা করলে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে আইবিএর ভূমিকা অনস্বীকার্য। সার্বিকভাবে বলা যায়, আইবিএ তার সব উদ্দেশ্য অর্জনে সফল হয়েছে।

 

. আবদুর রব: সাবেক অধ্যাপক পরিচালক, আইবিএ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন