চিকিৎসা পর্যটন

বড় করতে হলে সরকারের নীতি সমর্থন প্রয়োজন

মঈনউদ্দিন হাসান রশীদ

চিকিৎসা পর্যটন নিয়ে আমরা খুব বেশি চিন্তা করিনি। কারণ আমাদের দেশে চাহিদা জোগান এত বেশি যে এটা নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ নেই। প্রবাসীরা অবশ্য ডেন্টিস্ট্রি বা স্কিন, লেজার চিকিৎসা বাংলাদেশে এসে করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বিশেষ করে ডেন্টিস্ট্রির কাজ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে অনেক ব্যয়বহুল। সেজন্য ওখানকার প্রবাসী বাঙালিরা এখানে এসে সে ধরনের কাজগুলো করতে পছন্দ করে। আমার মনে হয় সাধারণভাবে পর্যটনের উন্নয়ন হলে চিকিৎসা পর্যটনেরও উন্নতি হবে। এখন যেমন কক্সবাজার পায়রা নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা হচ্ছে। সেখানে স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন ঘটালে তাহলে চিকিৎসা পর্যটনেরও বিকাশ ঘটবে।

আমাদের দেশে একটা জায়গায় চিকিৎসা পর্যটনের অনেক সম্ভাবনা আছে। সেটি হলো ওল্ড হোম ফ্যাসিলিটিজ। বিদেশে এখন জেরিয়াটিক সার্ভিসগুলো এখন ভালো হচ্ছে। দেশে ওল্ড হোমের সুযোগ অনেক বেশি। এটা সরকার পরিবারের সদস্যদের ব্যয়ের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ। যদিও বলা হয়, তারা সারা জীবন কাজ করেছে। তাদের অনেক অবদান আছে। প্রভাবও আছে। কিন্তু যেভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে, জীবনযাত্রায় পরিবর্তন ঘটছে, তার মাধ্যমে ব্যয় মেটানো অনেক ব্যয়সাধ্য। আমাদের দেশে ঢাকার বায়ুর মান নিয়ে অনেকেই কথা বলে। সিলেটে, রংপুরে বা উত্তরবঙ্গে যেখানে বায়ুর মান তুলনামূলক ভালো, যেখানে এয়ারপোর্ট আছে। যেখান থেকে কলকাতা, দিল্লি, ঢাকা হোক; কিংবা কক্সবাজারে এয়ারপোর্ট, সেখান থেকে থাইল্যান্ডসহ সব জায়গার সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে। তাহলে ওল্ড হোম সেবা বাংলাদেশে নিয়ে আসা যাবে। কারণ আমাদের তরুণ জনগোষ্ঠী রয়েছে। নার্সিং জেরিয়াটিক সার্ভিস, ফিজিওথেরাপি অন্য সেবা যদি বাড়ায়, ওল্ড হোমের সার্ভিসগুলো যদি বাংলাদেশে দিতে পারি তাহলে দেশে আসতে অনেকেই আগ্রহী হবে। বাংলাদেশে রোগীর ব্যয় অন্য দেশের তুলনায় অনেক কম হবে। জাপানের চেয়ে কম, কারণ সেখানে জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেশি। ভিসা নাগরিকত্ব ইস্যুর কারণে দেশে চিকিৎসা পর্যটন বিকাশের সুযোগ কম। অন্যথায় সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যসেবা খাতে ফোকাস হওয়া উচিত বাংলাদেশ থেকে বাইরে যাওয়া রোগীদের ধরে রাখা। এখনো দেখা যায় যে উচ্চবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী গর্ভাবস্থার শেষের দিকে ডেলিভারির জন্য বিদেশে যায়। সেবা কেন আমরা উন্নত করতে পারিনি? আমাদের লোকজনের আস্থা নেই যে এখানে সার্ভিসটা পাওয়া যাবে।

আমাদের পরিচিতদের অনেককেই বলতে শুনেছি, কভিডের আগে তারা জানত না বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা রয়েছে। কারো শরীর খারাপ হলে বলত সিঙ্গাপুর যাই। ওখানে খুব ব্যয়বহুল। তাহলে থাইল্যান্ড যাই। ব্যয় ক্ষমতা একদম কম হলে ভারতে যাই। অবচেতনে যুক্তিটা পর্যায়েরই ছিল। এখন কিন্তু এটা প্রমাণিত যে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা অনেক ক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে ভালো। কভিড পরিস্থিতিতে তা আরো বেশি প্রমাণিত। ওইদিক থেকে আমি মনে করি, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার ওপর মানুষের একটা আস্থা এসেছে। এখন আমাদের হাসপাতাল অপারেটর, চিকিৎসক, স্বাস্থকর্মীসহ পুরো কমিউনিটিকে আস্থা ধরে রাখতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের আরো উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এখানে আমাদের সরকারি বেশকিছু গঠনমূলক নীতি দরকার। নিয়মিতভাবেই আমরা একটা সমস্যা নিয়েই হিমশিম খাচ্ছি। সেটি হলো আমাদের এখান থেকে অনেক নার্স চলে গেছে। তিন-চার বছরে আমাদের এখান থেকে ১৫০০ নার্স চলে গেছে। যেখানে আমাদের ক্যাপাসিটি কম। তার মানে একটা সুনির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী নিয়মিত টার্নওভারে ছিল। আমরা তাদের প্রশিক্ষিত করতে পারিনি। যে কারণে তারা সেবা দিতে পারেনি। তারা আমাদের কথা চিন্তা করছে না।

সরকারের মাথায় রাখা উচিত পাবলিক ইনস্টিটিউটগুলো যেমন ন্যাশনাল অ্যাসেট, তেমনি প্রাইভেট ইনস্টিটিউটও ন্যাশনাল অ্যাসেট। আমাদের একটু ব্যয় বেশি। আর সরকারি হাসপাতালগুলোয় ভর্তুকি দেয়া হয় বিধায় নো লস নো প্রফিটে কাজ করে। আমাদের যেহেতু বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা নেই, সেহেতু রেভিনিউ থেকে কস্ট রিকভার করতে হয় বিধায় আমাদের ব্যয়টা বেশি। এটাই মৌলিক পার্থক্য। কেউ এসি রুম চাইলে এর ভাড়া যা হবে না আর কেউ নন-এসি রুম চাইলে এর ভাড়া আরো কম হবে। সরকার বড় জমি পায়, ব্যক্তি খাত বড় জমি পায় না। আমি মনে করি, সরকার সরকারি হাসপাতালকে যে সুযোগ-সুবিধা দেয়, প্রাইভেট হাসপাতালকেও একই সুযোগ-সুবিধা দেয়া উচিত। সরকার যদি আমাদের ন্যাশনাল অ্যাসেট, জাতীয় সক্ষমতা ন্যাশনাল ফোর্সের একটা অংশ মনে করে সাপোর্টটা দেয় আমরা আরো গুণগত সেবা দিতে পারব। জনগণেরও আমাদের প্রতি প্রত্যাশা আস্থা দ্রুততম সময়ের মধ্যে বেড়ে যাবে। প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য, নিজেদের পরিপক্বতা অর্জনের জন্য একটু সময় লাগবে। কভিডে দেখিয়েছি আমরা কী করতে পারি। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে আমরা আরো ভালো করতে পারব।

একটু দৃঢ়তার সঙ্গে বলব, আমাদের চেয়ারম্যান, পরিচালকবৃন্দ ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পরিবারগুলো ইউনাইটেড হাসপাতালের বাইরে দেশে-বিদেশে আর কোথাও চিকিৎসা নেয়নি। আমাদের দেশের চিকিৎসার মান বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের সঙ্গে আমরা তুলনা করতে পারি। অন্যদের চেয়ে আমাদের মান কোনো অংশে কম নয়। দেশের মানুষ বাইরে গিয়ে ভুল চিকিৎসায় অনেকেই মারা গেছে। সেটি খুব একটা প্রচার হয় না। আমাদের দেশে যদি কখনো চিকিৎসায় ব্যর্থ হয়, সেটা যেভাবে প্রচার পায়, বাইরে ভুল চিকিৎসা হলে কিংবা ভুল চিকিৎসায় মারা গেলে সেটি তেমন একটা প্রচার হয় না।

জন হপকিন্সের ২০১৮ সালের গবেষণা অনুযায়ী আমেরিকায় প্রতি বছর দুই লাখ রোগী ভুল চিকিৎসায় মারা যায়। তাই আমাদের প্রত্যাশার জায়গাটিতে অনেক বেশি সচেতন হতে হবে। আমরা অনেক সময় শেষ মুহূর্তে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে আসি। বিদেশে যদি এমন অবস্থায় কোনো রোগীকে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানের চিকিৎসক তখন দেখেই বলে দেয় যে আমাদের দেশে রোগীর ভালো চিকিৎসা হয়নি। যদি দেশে ভালো চিকিৎসা দেয়া হতো তাহলে রোগীকে বাঁচানো যেত। বিদেশের ওই চিকিৎসক কিন্তু তার দেশের মার্কেটিং করলেন। আমার দেশের চিকিৎসক তখন অপরাধী হয়ে গেলেন। অথচ ওই রোগীকে হয়তো তার পরিবারের সদস্যরা একদম শেষ মুহূর্তে চিকিৎসার জন্য নিয়ে এসেছে। তারা আগে থেকে সচেতন ছিল না।

অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের চিকিৎসার তুলনা করার জন্য কভিড একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা অনেক উন্নত। ব্রেইন-ড্রেইনের বিষয় রয়েছে। আমাদের দেশের মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা পাস করার পর বিদেশে চলে যাচ্ছেন। যারা সাধারণ মানুষের করের টাকায় পড়াশোনা করছেন তারা কেন বিদেশে থেকে যাবেন? তাদের অনেকেই বলেন, দেশে তাদের কাজের সুযোগ নেই। মেধাবী শিক্ষার্থীরা যদি বাংলাদেশে থাকেন তাহলে যেকোনো কিছুই সম্ভব। কারণ আমাদের দেশের লোকজন বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় অনেক ভালো ভালো পদে রয়েছেন, ভালো কাজ করছেন। আমেরিকায় বাংলাদেশের অনেক চিকিৎসক রয়েছেন। তারা যদি আজ বাংলাদেশে থাকতেন, তাহলে আমাদের স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা বদলে যেত।

তাছাড়া বাংলাদেশেও কিন্তু বাইরে থেকে মানুষ চিকিৎসা নিতে আসছে। বিশেষ করে ডেন্টিস্ট্রি চিকিৎসার কথা যদি বলি। যারা বাইরে থাকে, তারা যখন দেশে আসে, তখন কিন্তু তারা চিকিৎসাগুলো দেশ থেকে করে যায়। যেসব সেবা বিদেশে ব্যয়বহুল তারা সেগুলো বাংলাদেশ থেকে নেয়।

চিকিৎসায় আস্থা অর্জনের বিষয় রয়েছে। আমরা যদি বাইরের দেশের লোকের আস্থা অর্জন করতে পারি তাহলে অনেকে চিকিৎসার জন্য এখানে আসবে। আবার কিছু ভাষাগত সুবিধাও রয়েছে আমাদের। বাংলাদেশের যশোর, খুলনা বা রংপুর থেকে অনেকেই ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নেয়। আবার ভারতের আসাম থেকে কিন্তু বাংলাদেশের সিলেটে আসে চিকিৎসার জন্য। কারণ আসামের লোকেরা যখন পশ্চিম বাংলায় যায় চিকিৎসার জন্য, তখন কিন্তু তারা ভাষাগত কিছু সমস্যায় পড়ে, তারা সিলেটে এসে চিকিৎসা নিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তাই আমরা যদি আস্থা অর্জন করতে পারি তাহলে নেপাল, ভুটান কিংবা সেভেন সিস্টারস থেকে অনেকে আসবে। মেডিকেল ট্যুরিজমের মাধ্যমে আমাদের দেশ থেকে যে নগদ অর্থ বাইরে চলে যাচ্ছে তা আমরা ধরে রাখতে পারি। খুব ছোট ছোট কারণে এটা হচ্ছে। এজন্য আমাদের কিছু নিয়ন্ত্রণ কাঠামো প্রয়োজন। দেশ থেকে ১০০ রোগী চিকিৎসা নিতে বাইরে যাওয়ার চেয়ে বিদেশ থেকে ভালো মানের একজন চিকিৎসক এখানে আনাটা অর্থবহ। আমাদের এখানে নিয়ম রয়েছে যে একজন নতুন চিকিৎসক এসে যদি কিছু নতুন শেখাতে না পারে তবে তাকে আনতে দেয়া হবে না, যা সংগত। তবে আমি মনে করি, যতদিন আমাদের দেশে চিকিৎসকের চাহিদা-জোগানের পার্থক্যটা বেশি থাকবে ততদিন আমাদের জন্য বিষয়টি যথাযথ নয়।

ধরা যাক, আমাদের ১৭ কোটি মানুষের জন্য এক হাজার কার্ডিয়াক সার্জন প্রয়োজন, কিন্তু আছে ৯০০ জন। তখন বাইরে থেকে বাকি ১০০ জন হৃদরোগ চিকিৎসক আনার অনুমতি থাকা উচিত। যাতে রোগীদের চাহিদা পূরণ সম্ভব হয়। যখন আমাদের দেশের মেডিকেল কলেজ থেকে প্রয়োজনীয় এক হাজার চিকিৎসক আমরা পাব তখন আমরা বাইরের দেশ থেকে চিকিৎসক আনা বন্ধ করে দেব। কিন্তু আমরা যতদিন না স্বয়ংসম্পূর্ণ হচ্ছি ততদিন এটা করতে হবে।

বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে মোট খরচের এক-তৃতীয়াংশ চিকিৎসা বাবদ ব্যয় হলেও বাকি খরচটা যায় বিমান ভাড়া অন্যান্য আনুষঙ্গিক খাতে। এভাবে কিন্তু দেশ থেকে অনেক টাকা বাইরে চলে যায়। আমরা মনে করি, বিদেশের চিকিৎসকেরা আমাদের এখান থেকে বেশি অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি কিন্তু তেমন নয়। আবার অনেকে আজীবন বিদেশে গিয়ে হার্ট চেকআপ করিয়ে আসে। কিন্তু তার যখন হার্ট অ্যাটাক হয় তখন কিন্তু আর বিদেশে যাওয়ার সুযোগ থাকে না। অবস্থায় আমাদের দেশে ইমারজেন্সি সার্ভিসটাকে উন্নত করতে হবে।

চিকিৎসার জন্য আমাদের দেশের লোকজন বাইরে গিয়ে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে ওই অর্থটা যদি আমরা আমাদের দেশে রাখতে পারতাম তবে অনেক বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হতো। কয়েক লাখ নার্সের কাজের সুযোগ হতো। আমাদের মেডিকেল ট্যুরিজম বা সার্বিকভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি-নির্দেশিকা দরকার, যেখানে সরকারি বেসরকারি খাতে অংশগ্রহণকে সুনির্দিষ্টভাবে একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে নিয়ে আসতে হবে। করের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা করপোরেট কর দিচ্ছি। একটা ব্যাংককে যে পরিমাণ কর দিতে হয়, বেসরকারি হাসপাতালকেও সে পরিমাণ কর দিতে হয়। ধরনের কিছু বিষয় রয়েছে যা বিবেচনা করা জরুরি। বেসরকারি খাতকে যদি জাতীয় সম্পদের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাহলে ৯০ শতাংশ সমস্যার সমধান হবে বলে আমি মনে করি। এভাবে রোগীদেরও আমরা ভালো চিকিৎসা দিতে সমর্থ হব।

 

মঈনউদ্দিন হাসান রশীদ: চেয়ারম্যান ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজেস অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের (ইউনাইটেড গ্রুপ)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন