চিকিৎসা জনবলের দক্ষ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন

ডা. রশীদ ই-মাহবুব

একটা সময় আমাদের স্বাস্থ্য খাতে জনবল কম ছিল। বর্তমানে বাড়ছে। ভবিষ্যতে আরো বাড়বে। তবে কিছু সমস্যা এখনো রয়েছে। আমাদের অর্থনীতির যতটা ধারণক্ষমতা, সেখানে স্বাস্থ্যসেবাকে অন্তর্ভুক্তকরণের বিষয়টি বোঝা জরুরি। সেবা খাত অর্থনীতির বাইরে নয়। আমাদের বর্তমান মাথাপিছু আয় হাজার ডলারের কিছু বেশি। কিন্তু আমরা যেসব উন্নত দেশের চিকিৎসা সম্পর্কে বলি, তাদের কারোরই মাথাপিছু আয় হাজার ডলারের নিচে নয়, বিষয়টি আমাদের মনে রাখতে হবে। হাজার ডলার আর হাজার ডলারের মধ্যে পার্থক্য অনেক। তাই তাদের যদি আমরা মডেল ধরে নিই তাহলে হবে না।

আমাদের স্বাস্থ্য খাতে জনবল যেমন আছে, সেবা সরবরাহও আছে। কাগজে-কলমে আমাদের প্রায় ৮৬ হাজার নিবন্ধিত চিকিৎসক রয়েছেন। এদের মধ্যে কেউ হয়তো বিদেশে গেছেন, কেউ হয়তো আর বেঁচে নেই। এভাবে হিসাব করলে আমার মনে হয়, দেশে কর্মরত এখন সত্তর হাজারের মতো চিকিৎসক আছেন। স্বাধীনতাকালে সম্ভবত চিকিৎসক ছিলেন ১০ থেকে ১৫ হাজার। এখানে মানবসম্পদের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত। আমাদের সরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৩৭, বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৭০। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ছয়। এগুলোতে বছরে ১০ হাজারের ওপর শিক্ষার্থী ভর্তি হন। এছাড়া দেশের বাইরে থেকে একটি বড় সংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করতে আসেন। তাদের বাদ দিলেও আমরা ধরে নিতে পারি, বছরে ১০ হাজার শিক্ষার্থী মেডিকেল থেকে পাস করে বের হন।

একইভাবে নার্সিংয়েও আমাদের অনেক অনেক অগ্রগতি হয়েছে। তবে সন্তুষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের নার্সিং ইনস্টিটিউশন রয়েছে, সেখানে বছরে ১৬ হাজার শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। এর মধ্যে বিভিন্ন গ্রেড আছে যেমন ডিপ্লোমা, মিডওয়াইফ, ব্যাচেলর মাস্টার্স। কিন্তু সমস্যাটা কোথায়? সমস্যা হচ্ছে অনুপাতে। চিকিৎসকের চেয়ে নার্সের সংখ্যা বেশি হওয়া উচিত মানসম্মত চিকিৎসার মানদণ্ড অনুসারে। কিন্তু আমাদের এখানে দেখা যায়, দুজন চিকিৎসকের বিপরীতে একজন নার্স পাওয়া যাচ্ছে। এটা একটা সংকট। তৃতীয়ত, আমাদের অনেক প্যারামেডিকস মেডিকেল টেকনোলজিস্ট দরকার। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আছে। তবে একটা অঘটন ঘটে গেছে। পেশাদার প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হয় বাংলাদেশে স্টেট মেডিকেল কাউন্সিলের মাধ্যমে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় টেকনিক্যাল এডুকেশন কোর্সটা চালু করে, এটা নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটা দ্বন্দ্ব আছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটা মধ্যবিত্তকে আঘাত করে তা হলো, আমাদের বিশেষায়িত চিকিৎসকের সংখ্যা কম। মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে মেডিকেল স্পেশালিস্ট তৈরি হচ্ছেবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান অ্যান্ড সার্জনস। সরকার আরো কয়েকটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করেছে কিন্তু তা কবে চালু হবে, জানা নেই। 

সমস্যা হচ্ছে বিশেষায়িত চিকিৎসকরা আমাদের প্রয়োজন চাহিদা অনুসারে তৈরি হচ্ছে না, বরং এটা হচ্ছে যে পড়তে গেছে তার ইচ্ছানুসারে। কোনো দেশেই মানবসম্পদ তৈরির বিষয়টি শিক্ষার্থীদের নিজেদের ওপর ছেড়ে দেয় না। আমাদের দেশে যেমন সবাই কার্ডিওলজিস্ট কিংবা গাইনোকোলজিস্ট হতে চায়। দেখা যায় খুবই কমসংখ্যক অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট হতে চাচ্ছে। ধরনের অনেক বিষয় আছে, যেখানে আমাদের প্রয়োজন রয়েছে কিন্তু বিশেষায়িত চিকিৎসক নেই।

চতুর্থত, তাহলে আমরা চিকিৎসার জন্য কোথায় যাব? কোথায় ব্যয় করব? সরকারি খাতে না বেসরকারিতে? সরকারি খাতের ব্যবস্থাপনাগত সমস্যা থাকার কারণে তাদের থেকে পরিষেবার বিষয়টি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সরকারি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনাগত সমস্যা বিদ্যমান। যেখানে দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন সেখানে না দিয়ে অন্য জায়গায় দেয়া হচ্ছে। আমাদের দেশের জন্য প্রয়োজনীয় মানবসম্পদের চাহিদার বিষয়টি আমরা জানি না। সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজন অনুসারে মানবসম্পদের চাহিদার বিষয়টি তুলে ধরা দরকার। এর প্রেক্ষাপটে কাজগুলো করা দরকার। আগামী ১০ বছরে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে আমাদের স্বাস্থ্য খাতে কী ধরনের মানবসম্পদ প্রয়োজন হবে, তা কিন্তু নির্ণয় করা নেই। এটা যেহেতু নির্ণয় করা নেই তাই এবিষয়ক সরকারের কোনো নির্দেশনাও নেই। সুতরাং যে যেভাবে পারে ওভাবে আসছে। এটাকে যদি আমরা সুনির্দিষ্ট না করতে পারি, তাহলে দেখা যাবে জনশক্তি থাকলেও আমরা তা কাজে লাগাতে পারছি না। যেমন সরকারি হাসপাতালে অনেক স্পেশালিস্ট তার নিচের পদে কাজ করছেন। কারণ তার জন্য জায়গা তৈরি হয়নি। সুতরাং সেবা খাতে প্রয়োজনীয় জনশক্তির কথা যখন আসছে তখন কিন্তু সমস্যাটাও সামনে আসছে।

এছাড়া শহর-গ্রামভেদে আরেকটা সমস্যা রয়েছে। শহরে চিকিৎসকের সংখ্যা অনেক বেশি, গ্রামে সে তুলনায় অনেক কম। বড় ধরনের পার্থক্য থেকে যাচ্ছে, পরিকল্পনার মাধ্যমে যার সমাধান প্রয়োজন। দিনে দিনে বিশেষায়িতকরণের সংখ্যা বাড়ছে। যেমন কার্ডিয়াক, নিউরোলজির জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্সের প্রয়োজন, যা সরকারি সেক্টরে নেই বললেই চলে। দু-একটা প্রাইভেট সেক্টরে রয়েছে। আমরা প্রতি বছর ১০ হাজার চিকিৎসক ১৬ হাজার নার্স ভর্তি করি; সংখ্যাগত দিক দিয়ে এটা ভালো কিন্তু উপযোগিতা পরিকল্পনা অনুসারে তাদের ব্যবহার করতে হবে। না হলে মানুষের সেবাপ্রাপ্তিতে সমস্যা হবে। কারণ মানুষ যদি সেবা না পায় তাহলে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাবে না।

স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করাটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে কোয়াকেরা এক ধরনের পরিষেবা প্রদান করছে। একইভাবে ওষুধ বিক্রেতাও কিন্তু সেবা প্রদান করে। তাদের যদিও আমরা ওই প্রটোকলে আনতে পারি না, তবে তারা আমাদের বিদ্যমান জনশক্তির দ্বিগুণ বা তিন গুণের বেশি রয়েছে। জায়গাগুলো সমন্বিত হয়নি। কমিউনিটি ক্লিনিকে একজন প্রোভাইডার দেয়া হয়েছে কিন্তু সে কোনোভাবেই এর যোগ্য নয়। পেশাজীবী হিসেবে সে শিক্ষিত নয়। সরকারের পক্ষ থেকে কমিউনিটি হাসপাতালগুলোতে যে ১৩ হাজার প্রোভাইডার দেয়া হয়েছে তারা কোনোভাবেই চিকিৎসক হিসেবে গণ্য হবে না। ধরনের অনেক বিষয় রয়েছে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে বিষয়গুলো কেন হচ্ছে? কারণ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশে বরাদ্দ সবচেয়ে কম। অর্থ না থাকলে আমরা তো সংস্কারগুলো করতে পারব না।

তবে বাংলাদেশের অর্জনও রয়েছে। যেমন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড় আয়ু বেড়েছে, মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে। এগুলো সম্ভব হয়েছে বিশেষায়িত কর্মসূচির মাধ্যমে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরিষেবায় এগুলো অন্তর্ভুক্ত নয়। বাংলাদেশের লেখাপড়ার মধ্যে বৈষম্য রয়েছে। আর বৈষম্যটা হচ্ছে মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য যারা যায়, তারা মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত। কিন্তু নার্সিং পেশায় যারা যায় তাদের বেশির ভাগই নিম্নবিত্ত। সরকারি নার্সিং ইনস্টিটিউটগুলোতে যারা যায় তারা কিছু পয়সা পায়কিন্তু যারা বেসরকারিতে পড়তে যায় তাদের পয়সা দিয়ে পড়তে হয়, যা একটা বৈষম্য। তাই জায়গাটিতে আগ্রহ সৃষ্টি করা কঠিন। কারণ সরকার যদি শ্রেণীবিভাজন করতে চায়, তাহলে সরকারি বেসরকারি খাত যেখানেই হোক না কেন, সমর্থনটা সরকারকেই দিতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সরকার পয়সা পাবে কোথায়?

আমাদের সার্ভিস ডেলিভারি মেডিকেয়ার খানিকটা অদ্ভুত। সরকারিভাবে আছে, এছাড়া কিছু এনজিও বেসরকারিতে আছে। বেসরকারি খাতের স্বাস্থ্যসেবা জনবান্ধব নয়। আবার সরকারি খাতে আপনি উন্নত না হলেও ন্যূনতম একটা সেবা পাবেন। কিন্তু বেসরকারিতে পয়সা ব্যতীত কোনো সেবা পাবেন না। বিষয়গুলো জনশক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত। জায়গাগুলো যদি আমরা চিহ্নিত না করি তাহলে জনশক্তি তৈরি করলেও তা কাজে লাগাতে সমর্থ হব না।

ষাটের দশকে সরকারি খাতে আড়াই থেকে তিনশর বেশি চিকিৎসক ছিলেন না। জেলা পর্যায়ে পাঁচটি হাসপাতাল ছিল সরকারের আর বাকিগুলো ছিল জেলা পরিষদের আওতায়। এখন এগুলো জাতীয়করণ হয়েছে। এখানে একটা বিষয় আমরা হারিয়েছি, তা হচ্ছে জনস্বাস্থ্য।

আগে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি দেখত জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। এখন কিন্তু জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ নেই। সিভিল সার্জনরা আছেন, তারা কাজ করছেন, যা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এখানে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদেরই থাকার কথা ছিল, যা এখানে হয়নি। এখানে নীতিনির্ধারণের অভাব রয়েছে। পঞ্চম যে বিষয়টা আমরা দেখছি, তাহলো মেডিকেল কলেজ নার্সিং কলেজ প্রাইভেট সেক্টরে হয়েছে। কিন্তু সেগুলোতে গুণগত মান নিশ্চিত করা হয়নি।

সরকারি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের গুণগত মানে পার্থক্য হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ সরকারিতে যে লজিস্টিক সমর্থনটা রয়েছে, বেসরকারিতে তা নেই। দক্ষ জনশক্তি তৈরির বিষয়টি খানিকটা কঠিন। এখানে সরকারের তদারকি জোরদার করতে হবে।

আমরা যদি হাসপাতালগুলোর শয্যার দিকে নজর দিই, তাহলে দেখতে পাই বাংলাদেশে জনপ্রতি শয্যার সংখ্যা অনেক কম। চিকিৎসা ক্ষেত্রে এটাও একটা দুর্বলতা আমাদের রয়ে গেছে। তবে এগুলো সবই সরকার কতটুকু অর্থ খরচ করবে এবং সরকার কী চায় তার সঙ্গে সম্পর্কিত। আগামী ১০ বছর কিংবা ১৫ বছরে চিকিৎসা খাতে জনশক্তির উন্নয়ন হবে, কিন্তু এটি হবে নিজস্ব গতিতে। সরকার সেখানে কোনো ভূমিকা রাখছে না। সরকারকে এখানে রূপরেখা তৈরি করতে হবে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কোন জায়গায় তারা গুরুত্ব দেবে, কোন জায়গায় গুরুত্ব দেবে না।

আমরা যখন জায়গাগুলো নিয়ে কথা বলি তখন দেখা যায়, সরকার এখানে নিজস্ব স্বকীয়তা না রেখে ডোনার ড্রাইভিং হয়ে যায়। শহরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। গ্রামে এটা অনেক কম। কারণ শহরের জনগণ কিন্তু জানে না, কোন জায়গায় সে চিকিৎসাটা পাবে। গ্রামে ইউনিয়ন সাব-সেন্টার আছে, কমিউনিটি ক্লিনিক আছে, থানা হেলথ কমপ্লেক্স আছে, শহরে কিন্তু ধরনের ব্যবস্থা নেই। ১৯৯৯ সালে এটা দিয়ে দেয়া হলো স্থানীয় সরকারকে। স্থানীয় সরকার পরবর্তী সময়ে তা এনজিওগুলোর হাতে তুলে দিল এবং সেখানে তাদের দায়িত্ব দেয়া হলো তোমরা উপার্জন করবে এবং আমরা কিছু সাহায্য করব। সেজন্য শহরের দারিদ্র্যদের জন্য মেডিকেয়ারটা খুব কঠিন হয়ে গেছে। এছাড়া শহরের দরিদ্রদের স্যানিটাইজেশন বিশুদ্ধ পানির সংকটও রয়েছে। স্বাস্থ্যকে যদি আমরা সমন্বিতভাবে না করে এভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখি তাহলে সমস্যা।

আর গড় আয়ু বৃদ্ধির বিষয়টিতে ব্যক্তি নিজেও একটা বিষয়। কারণ বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাপন চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন ঘটছে। এক্ষেত্রে এনজিওগুলো একটা ভালো ভূমিকা রাখছে। মানসম্মত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কথা সরকারও বলছে, সার্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু এটি এখনো আলোর মুখ দেখতে পারেনি। জনশক্তির পাশাপাশি সমস্যাগুলোও আছে। আমি মনে করি, বেসরকারিভাবে যারা নার্সিংয়ে পড়তে আসছে তাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটা সাবসিডি দেয়া প্রয়োজন, না হলে গরিব মানুষের সন্তানরা এক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়। কার্ডিয়াক, ফিজিওথেরাপিস্ট থেকে শুরু করে বয়স্কদের জন্য নার্সিংয়ের ভূমিকা রয়েছে।  ফিজিওথেরাপিস্ট তৈরি হচ্ছে কিন্তু তাদের কাজে লাগানোর কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই। তাদের বাজার অর্থনীতির ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে, যা মেডিকেয়ারের জন্য ব্ল্যাক হোল।

তাই আগামী ১০ বছরের মধ্যে আমরা যদি স্বাস্থ্যসেবাকে ঘিরে সুবিন্যস্ত পরিকল্পনার মাধ্যমে অগ্রসর হই, তাহলে কিছুটা হলেও সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে সক্ষম হব। একটি ভালো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমরা আমাদের চিকিৎসা খাতের দুর্বলতাগুলোও কাটিয়ে উঠতে পারব।

মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের বিষয়টাও গুরুত্বপূর্ণ। তাদের বাদ দিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি সম্ভব নয়। এটা তারা ফয়সালা করছে, কোর্টে গেছে। এর আগেও আমরা ধরনের সমস্যায় পড়েছিলাম ডেন্টাল সার্জন ডেন্টাল টেকনোলজিস্টদের নিয়ে। ডেন্টাল টেকনোলজিতে দুটি কোর্স আছে  ডিপ্লোমা বিএসসি। এটাকে প্রথমে স্বীকৃতি দেয়া হতো না, কিন্তু পরবর্তী সময়ে কোর্সটিকে আপগ্রেডিং করে অধিভুক্ত করা হয়।

যারা কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে কোর্সটি করেছে, তাদের মধ্যে অনেকেই তেমন কিছুই শেখেনি, শুধু সনদটাই পেয়েছে। আমার মনে হয় এটাকে নতুন করে মূল্যায়ন করতে হবে। বিদেশের মেডিকেল কলেজ থেকে আমাদের যে ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা করে ফিরছে, আমরা তাদের একটি পরীক্ষা নিয়ে পরবর্তী সময়ে প্র্যাকটিসের সুযোগ দিয়ে থাকি। ঠিক একইভাবে মেডিকেল টেকনোলজিস্টদেরও মূল্যায়ন করা যেতে পারে। স্বাস্থ্য বিভাগ কিংবা কারিগরি বিভাগ এটা করতে পারে।

আমাদের দেশে এখনো ফার্মেসিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। এমনকি হাসপাতালগুলোতে ফার্মাসিস্ট পোস্টই নেই। মানসম্পন্ন সেবা পেতে হলে ফার্মাসিস্টদেরও এখানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এদের অনেকেই বিদেশে চলে যান। আমাদের মেডিকেল কলেজের ফার্মেসিগুলোতে গ্র্যাজুয়েটদের কাজ দিতে হবে। একটা সময় ফার্মেসি সম্পর্কে আমাদের ধারণা ছিল না। কিন্তু এখন তো হয়েছে।

এগুলো আমাদের ত্রুটিপূর্ণ দিক। স্বাস্থ্য খাতে সরকারের বরাদ্দ অনেক কম, কিন্তু সেবা নিতে ব্যক্তির খরচ অনেক বেশি, ৭০ শতাংশ। এখানে অর্থপ্রবাহ কম নয়। সুতরাং অর্থপ্রবাহটা কম করা গুরুত্বপূর্ণ এবং দরিদ্ররা কীভাবে পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবাটা পায় তা দেখা দরকার।

কভিডের প্রেক্ষাপটে আমাদের স্বাস্থ্যবিষয়ক বড় পরিবর্তন ঘটেছে। ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সামাজিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা সচেতন হয়েছি। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন যোগ হয়েছে। অবস্থায় জনস্বাস্থ্যের বিষয়গুলোকেও আমাদের নতুনভাবে সাজাতে হবে। বিষয়গুলোর আলোকে আমরা যদি পরিকল্পনা গ্রহণ করি তাহলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব।

আমাদের উচ্চ দক্ষতার বিষয়গুলোতে মনোযোগী হতে হবে। আমাদের কয়েকটি উন্নত দক্ষ প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশ থেকে কিন্তু কার্ডিয়াক রোগীদের বিদেশে যাওয়া কমে গেছে। আবার ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরা কিন্তু খুব বেশি দেশের বাইরে যায় না। আইসিডিডিআর,বি থেকে আমরা অনেক সুবিধা পেয়েছি। আমাদের দক্ষ রিসার্চ উইং প্রয়োজনযা নেই। উন্নত গবেষণা ছাড়া আমরা সামনে অগ্রসর হতে পারব না। প্রতিনিয়ত গবেষণা কাজ করার মাধ্যমে আমরা দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে পারব এবং তাদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করতে পারব।

আরো একটা ব্যাপার হচ্ছে, বর্তমানে আমাদের মেডিকেল কলেজগুলোতে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি। সুতরাং দক্ষ জনশক্তিকে কীভাবে ব্যবহার করা যায় তাও ভাবতে হবে। না হলে দেখা যাবে আমাদের অর্ধেক চিকিৎসককে আমরা কোনো কাজে লাগাতে পারছি না। শুধু দক্ষ জনশক্তি তৈরি করলেই চলবে না, তাদের কাজে লাগানোর একটা রোডম্যাপও তৈরি করতে হবে।

 

ডা. রশীদ -মাহবুব: অধ্যাপক, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহ-উপাচার্য

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন