প্রয়াত আসলামুল হকের মাইশা গ্রুপের ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ

ব্যাংকগুলোকে অপারগতা জানিয়ে চিঠি সহধর্মিণীর

হাছান আদনান

সংসদ সদস্য আসলামুল হকের মৃত্যুর পর তার প্রতিষ্ঠিত মাইশা গ্রুপের হাল ধরেছেন স্ত্রী মাকসুদা হক। দেনায় জর্জরিত গ্রুপটির কোম্পানিগুলোর মোট ব্যাংকঋণের পরিমাণ এরই মধ্যে হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। প্রতিনিয়ত অনাদায়ী সুদ যুক্ত হয়ে ঋণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। বিনিয়োগের বিপরীতে সুদ কিংবা আসল কোনোটিই ফেরত না পেয়ে চরম উদ্বেগে রয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংকাররা। ঠিক এমন মুহূর্তে মাকসুদা হক বলছেন, ব্যাংকঋণের কোনো সুদ তিনি পরিশোধ করতে পারবেন না। শুধু আসলের সমপরিমাণ অপরিশোধিত অর্থ তিনি পরিশোধ করবেন। তবে সেজন্যও তার দীর্ঘ সময় দরকার।

মাইশা গ্রুপের ছয় কোম্পানিকে ঋণ দেয়া ব্যাংকগুলোয় সম্প্রতি এক চিঠি পাঠিয়েছেন মাকসুদা হক। বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক এক্সিম ব্যাংক এবং রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী জনতা ব্যাংককে দেয়া চিঠিতে ঋণের সুদ পরিশোধে অপারগতা প্রকাশ করেছেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের কাছেও চিঠি দিয়েছেন বলে জানা গিয়েছে।

ব্যবসায়িক বিপর্যয় নিয়ে কয়েক বছর ধরে নাজুক পরিস্থিতি পার করছিল মাইশা গ্রুপ। পরিস্থিতিতেই চলতি বছরের এপ্রিল হূদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান আসলামুল হক। এর পর থেকে মাইশা গ্রুপের কোম্পানিগুলোর ব্যবসা আরো খারাপের দিকে গিয়েছে। গ্রুপটির মূল ব্যবসা ছিল বিদ্যুৎকেন্দ্রনির্ভর। যদিও গ্রুপের উৎপাদন শুরু করা একমাত্র বিদ্যুৎকেন্দ্রটিও বন্ধ হয়ে গেছে। অন্য দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজও পুরোপুরি বন্ধ। আসলামুল হকের রেখে যাওয়া অন্য কোম্পানিগুলোরও ব্যবসা নেই বললেই চলে। অবস্থায় ব্যাংকঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপে দিশেহারা পরিস্থিতিতে পড়েছেন তার উত্তরাধিকারীরা। একই পরিস্থিতিতে রয়েছেন মাইশা গ্রুপকে ঋণ দেয়া ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারাও।

সুদ মওকুফের চিঠি দেয়ার বিষয়ে প্রয়াত আসলামুল হকের স্ত্রী মাকসুদা হক বণিক বার্তাকে বলেন, বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের পক্ষে সুদসহ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব নয়। এজন্য আমরা শুধু ব্যাংকের মূল ঋণ পরিশোধের প্রস্তাব দিয়েছি। বিষয়টি নিয়ে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে। আমাদের কোম্পানিগুলো গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি। এখনো বলার মতো কিছু হয়নি।

তবে মাইশা গ্রুপকে ঋণ দেয়া ব্যাংকগুলোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, মাকসুদা হকের চিঠিতে করা আবেদন একই সঙ্গে অদ্ভুত অবিশ্বাস্য। এরই আগে কোনো শিল্প গ্রুপ ধরনের আবেদন করেনি। কার পরামর্শে তিনি শুধু অনাদায়ী মূল ঋণ পরিশোধের প্রস্তাবটি দিয়েছেন, সেটিও বোধগম্য নয়।

অযৌক্তিক বিবেচনায় মাইশা গ্রুপের আবেদন প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করেছে ব্যাংকগুলো। এরই মধ্যে প্রস্তাবটি নাকচ করে দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক বেসরকারি খাতের মার্কেন্টাইল ব্যাংক পর্ষদ। রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের পর্ষদও আবেদনের বিষয়টি নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছে।

মাইশা গ্রুপের কাছে পাওনা সবচেয়ে বেশি ন্যাশনাল ব্যাংকের। গ্রুপটির অধীন কোম্পানিগুলোর কাছে ব্যাংকটি পাবে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। মাকসুদা হকের আবেদনের বিষয়টি নিয়ে ব্যাংকটি এরই মধ্যে একটি কমিটিও গঠন করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করেছেন।

গ্রুপটির অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠান মাইশা প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের কাছে ৩১ কোটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের গাড়ি ঋণ বাবদ কোটি টাকা পাবে মার্কেন্টাইল ব্যাংক। ব্যাংকটির পাওনা ৩৪ কোটি টাকার বিপরীতে মাত্র কোটি টাকা পরিশোধের প্রস্তাব দিয়েছে মাইশা গ্রুপ। বিষয়টি পরিচালনা পর্ষদে তুলেছিল মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। পরিচালনা পর্ষদও এরই মধ্যে আবেদনটি নাকচ করে দিয়েছে।

বিষয়ে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, মাইশা গ্রুপের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, তাতে ব্যাংকের মূল ঋণই আদায় হয় না। ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে আমরা গ্রাহকদের যে অর্থ দিই, সেটি আমানতকারীদের অর্থ। আমানতকারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত আমরা নিতে পারি না। মাইশা গ্রুপের আবেদনটি অযৌক্তিক হওয়ায় মার্কেন্টাইল ব্যাংক পর্ষদ এরই মধ্যে তা নাকচ করে দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণদাতা ব্যাংকগুলোর তথ্য অনুযায়ী, প্রয়াত আসলামুল হকের মালিকানাধীন সিএলসি পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের নামে ঋণ রয়েছে হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। ঢাকার পার্শ্ববর্তী কেরানীগঞ্জে স্থাপিত রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনক্ষমতা ১০৮ মেগাওয়াট। তার মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে এটিই শুধু উৎপাদনে আসতে পেরেছিল। যদিও বেশ কিছুদিন আগে থেকেই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ রয়েছে। এছাড়া তার মালিকানাধীন ঢাকা নর্থ পাওয়ার ইউটিলিটি কোম্পানি লিমিটেডের নামে ৩৭৮ কোটি টাকা ঢাকা ওয়েস্ট পাওয়ার লিমিটেডের নামে ৭৯ কোটি টাকার ব্যাংকঋণ রয়েছে।

আসলামুল হকের রিয়েল এস্টেট কোম্পানি মাইশা প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের নামে ঋণ রয়েছে ৬৫৬ কোটি টাকা। একই গ্রুপের কোম্পানি মাহিম রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের নামে ৩৮০ কোটি মাহিম ট্রেড লিংক লিমিটেডের নামে ১১ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। সব মিলিয়ে গ্রুপটির কাছে দেশের অর্ধডজন ব্যাংকের পাওনা প্রায় হাজার ৭৪ কোটি টাকা।

প্রয়াত সাংসদের ঢাকা ওয়েস্ট পাওয়ার লিমিটেড নামের বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অনুমোদন দেয়া হয়েছিল এক দশক আগে। দীর্ঘ সময়ে ১০৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আইপিপিভিত্তিক কেন্দ্রটির নির্মাণ অগ্রগতি কেবলই একটি সাইনবোর্ড। ঢাকা নর্থ পাওয়ার ইউটিলিটি নামে আরেকটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের অনুমোদন পেয়েছিলেন আসলামুল হক। ২০১২ সালের ১২ অক্টোবর বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (বিপিডিবি) চুক্তির পর নয় বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো দৃশ্যমান হয়নি বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অস্তিত্ব।

অথচ সাইনবোর্ডসর্বস্ব দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের নামে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে গেছে ৪৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে ৩৮০ কোটি টাকা গেছে ঢাকা নর্থ পাওয়ার ইউটিলিটিতে। আর রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) থেকে ঢাকা ওয়েস্ট পাওয়ার লিমিটেডে গেছে ৮০ কোটি টাকা।

দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ নিয়েই বিপদে আছে জনতা অগ্রণী ব্যাংক এবং আইসিবি। জীবদ্দশায় ঋণের কিস্তি কিংবা সুদ কোনোটিই পরিশোধ করেননি আসলামুল হক। এতে সুদ যুক্ত হয়ে প্রতিনিয়ত বেড়েছে ঋণের পরিমাণ। অন্যদিকে নির্মাণ শেষে বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি উৎপাদনে আসবে এমন কোনো সম্ভাবনাও দেখছে না বিপিডিবি। এজন্য দুটি কেন্দ্রেরই অনুমোদন বাতিল করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

আসলামুল হক যে জমিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেটি নিয়েও সরকারের সঙ্গে মামলা চলছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের দাবি হলো বুড়িগঙ্গা তুরাগ পাড়ের ৫৪ একর জায়গা দখল করেছেন আসলামুল হক। এজন্য কয়েক দফায় বিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকায় উচ্ছেদ অভিযানও চালানো হয়েছে। বিবদমান জমিই জামানত রাখা হয়েছে ব্যাংকের কাছে। সব মিলিয়ে মাইশা গ্রুপের কাছ থেকে ঋণ আদায়ের সম্ভাবনাও ক্ষীণ হয়ে আসছে।

নামসর্বস্ব দুই বিদ্যুৎকেন্দ্রের নামে নেয়া ঋণের সব সুদ মওকুফ করে দেয়ার জন্য চিঠি দিয়েছেন মাকসুদা হক। যদিও অগ্রণী ব্যাংক জনতা ব্যাংকের পর্ষদ আবেদনটি নাকচ করে দিয়েছে। বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শামস-উল-ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, সুদ মওকুফের জন্য ঋণ দেয়া হয়নি। মাইশা গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আনার উদ্যোগ নেয়াই ছিল উত্তম বিকল্প। অন্য কোনো কোম্পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো টেকওভার করতে চাইলে আমরা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। কিন্তু গ্রুপটি থেকে যে ধরনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, সেটি অবাস্তব। আমাদের কাছে জামানত হিসেবে ন্যাশনাল ব্যাংকের দুটি ব্যাংক গ্যারান্টি ছিল। ৩০ ৩৫ কোটি টাকার ওই দুটি ব্যাংক গ্যারান্টি নগদায়ন করার জন্য আমরা ন্যাশনাল ব্যাংককে চিঠি দিয়েছি। ব্যাংক গ্যারান্টির অর্থ সমন্বয় করা না হলে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অভিযোগ জানাব।

ঢাকা নর্থ পাওয়ার ইউটিলিটি কোম্পানির যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকে ঋণপত্র খোলা হয়েছিল। ঋণপত্রের অর্থ জার্মান একটি কোম্পানিকে পরিশোধও করেছিল ব্যাংকটি। যদিও দীর্ঘদিনেও ক্রয়কৃত যন্ত্রপাতি দেশে আসেনি বলে জনতা ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন। তারা বলছেন, মাইশা গ্রুপের আবেদনটি পর্ষদে উপস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু পর্ষদ সেটি নাকচ করে দিয়েছে।

মাইশা গ্রুপের হাজার ৭৪ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে শুধু ন্যাশনাল ব্যাংকেরই রয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকিং রীতিনীতি উপেক্ষিত হওয়ার অভিযোগ অনেক পুরনো। নিয়ে বেশ কয়েকবার পর্যবেক্ষণ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তার পরও আসলামুল হককে ঋণ দিয়েই গিয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক। এখন চেষ্টা করেও গ্রুপটির কাছ থেকে ঋণ আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। এরই মধ্যে কয়েক দফায় খেলাপি হয়েছে মাইশা গ্রুপের ঋণ। প্রতিবারই সেগুলো পুনঃতফসিল করা হয়েছে।

এসব ঋণের সব সুদ মওকুফ চেয়ে করা আবেদন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ সৈয়দ আবদুল বারী বণিক বার্তাকে বলেন, সুদ মওকুফের পাশাপাশি নতুন করে যাতে ঋণের ওপর সুদ আরোপ করা না হয়, তার আবেদন জানিয়ে মাকসুদা হক আমাদের কাছে চিঠি দিয়েছেন। আবেদনটি পর্যালোচনা করে পরামর্শ দেয়ার জন্য আমরা ব্যাংকের পক্ষ থেকে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছি। আমরা চাচ্ছি, প্রয়াত আসলামুল হকের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আসুক। বিদ্যুৎকেন্দ্র চললে আমরা ব্যাংকের টাকা ফেরত পাব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন