সড়কের বড় প্রকল্পের সিংহভাগেই চীনা ঠিকাদার

জেসমিন মলি ও শামীম রাহমান

সড়ক, সেতু, বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটিসহ বর্তমানে সড়ক জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) ১০টি বড় প্রকল্পের বিভিন্ন প্যাকেজে কাজ করছে ২০টি বিদেশী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ১০টিই চীনের। পায়রা সেতু, ঢাকা বিআরটি, টাঙ্গাইল-রংপুর চার লেন মহাসড়ক, ক্রস বর্ডার সড়ক উন্নয়ন, শীতলক্ষ্যা সেতুসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চীনের এসব প্রতিষ্ঠান। চীনের বাইরে দক্ষিণ কোরিয়ার চারটি, ভারতের তিনটি, জাপানের দুটি মালয়েশিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে সওজের বড় উন্নয়ন প্রকল্পে।

যে ১০টি উন্নয়ন প্রকল্পে বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে, সেগুলো বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৩৯ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা। প্রকল্পগুলোর বিভিন্ন প্যাকেজে বিদেশী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বাংলাদেশেরও একাধিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।

জাতীয় সংসদের সড়ক পরিবহন সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সড়ক পরিবহন মহাসড়ক বিভাগ এবং সেতু বিভাগের অধীনে বিভিন্ন সংস্থায় বিদেশী কোন কোম্পানি কোন প্রকল্পের ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে সে বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে সুপারিশ করে। সেই সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি সংসদীয় কমিটির বৈঠকে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করে মন্ত্রণালয়। প্রতিবেদনে সওজের বিদেশী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন প্রকল্পের তথ্য তুলে ধরা হয়।

বিষয়টি নিয়ে সংসদীয় কমিটির সভাপতি মো. একাব্বর হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, বিভিন্ন প্রকল্পে বিদেশী ঠিকাদার হিসেবে যারা কাজ করছেন তাদের বিষয়ে জানতেই সংসদীয় কমিটির বৈঠক থেকে সুপারিশ করা হয়। তবে প্রতিবেদনটি নিয়ে কোনো আলোচনা এখনো সংসদীয় কমিটির বৈঠকে হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সওজের উন্নয়নকাজে বিদেশী ঠিকাদার যুক্ত থাকলেও অভিযোগ রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের স্থানীয় ঠিকাদারদের দিয়েই কাজ করিয়ে নেয়। চলমান ঢাকা-টাঙ্গাইল চার লেন মহাসড়কের কাজে এমন অভিযোগ এসেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ মূল্যায়ন বিভাগে (আইএমইডি) আইএমইডির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশী চার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে প্রকল্পে কাজ করছে আরো চারটি বিদেশী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। চুক্তি অনুযায়ী দেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বিদেশী প্রতিষ্ঠানের যৌথভাবে কাজ করার কথা থাকলেও মহাসড়কটি পরিদর্শনে গিয়ে কোনো বিদেশী প্রকৌশলী বা শ্রমিকের দেখা পাননি আইএমইডির কর্মকর্তারা। পরিদর্শনে গিয়ে আইএমইডির কর্মকর্তারা আরো জানতে পারেন, শুরু থেকেই মহাসড়কটির নির্মাণকাজে বিদেশী ঠিকাদারেরা অংশ নেননি। আবার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে যেসব দেশ বা উন্নয়ন সহযোগী ঋণসহায়তা দেয় ঠিকাদার নিয়োগে তাদেরও ভূমিকা থাকে।

প্রকল্পগুলোর মধ্যে ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (বাংলাদেশ) ওয়েস্টার্ন বাংলাদেশ ব্রিজ ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টে কাজ করছে চায়না রেলওয়ে ২৪ ব্যুরো গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড (সিআর২৪বি) সওজের তথ্য বলছে, প্রতিষ্ঠানটির চলমান কাজের চুক্তিমূল্য ৪৭৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পায়রা সেতুর কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লংজিয়ান রোড অ্যান্ড ব্রিজ কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড। আগামী মাসে সেতুটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার পরিকল্পনা করছেন সওজের কর্মকর্তারা। প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু নির্মাণে খরচ হয়েছে হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা।

গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্টের মাধ্যমে ঢাকার বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে বিআরটি লেন। চীনের তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। চীনা গেঝুবা গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড (সিজিজিসি), জিয়াংসু প্রভিন্সিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড (জেটিইজি) ওয়েহাই ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিকস অ্যান্ড টেকনিক্যাল কোঅপারেটিভ কোম্পানি লিমিটেড বাস্তবায়ন করছে হাজার ২৬৮ কোটি টাকার প্রকল্প।

সওজের হাজার ৫৯২ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ বাস্তবায়ন করছে চায়না কনস্ট্রাকশন সেভেনথ ইঞ্জিনিয়ারিং ডিভিশন করপোরেশন লিমিটেড। সাসেক সংযোগ প্রকল্প--এর মাধ্যমে এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের একটি অংশে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। একই প্রকল্পের অন্য একটি অংশে কাজ করছে হেগো নামে চীনের আরেকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

১১৬ কোটি টাকায় মাতারবাড়ী কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সংযোগ সড়ক নির্মাণ করছে উহান মিউনিসিপ্যাল কনস্ট্রাকশন গ্রুপ। সওজের তথ্য বলছে, সংযোগ সড়কটি নির্মাণকাজের অগ্রগতি ৫৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ সরকার সৌদি উন্নয়ন তহবিলের (এসএফডি) যৌথ অর্থায়নে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নারায়ণগঞ্জ বন্দর উপজেলায় তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ পেয়েছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড। এর বাইরে কচা নদীর ওপর অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু নির্মাণ করছে চায়না রেলওয়ে ১৭ ব্যুরো গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড। দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটি নির্মাণে খরচ হচ্ছে ৯০০ কোটি টাকার মতো।

চীনের বাইরে বাংলাদেশে বিদেশী ঠিকাদারদের মধ্যে সওজে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় কাজ করছে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্যে সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্প--এর মাধ্যমে জয়দেবপুর-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পে যৌথভাবে কাজ করছে তিনটি কোরীয় প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো কেরইয়ং কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোম্পানি লিমিটেড, স্যামওহান করপোরেশন গেনন ডানকেরলে অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড (জিএইচসিএল) একই প্রকল্পে এইচসিএম ইঞ্জিনিয়ারিং নামে একটি মালয়েশিয়ান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও কাজ করছে। এর বাইরে হাল্লা গ্রুপ নামের একটি কোরীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাতারবাড়ী কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করছে।

সওজের দুটি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে জাপানের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টে ২২৩ কোটি টাকার কাজ করছে টেক্কেন করপোরেশন অ্যান্ড ইয়োকোগোয়া ব্রিজ করপোরেশন। কোমাইহালটেক ইনকরপোশেন নামে আরেকটি জাপানি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে ওয়েস্টার্ন বাংলাদেশ ব্রিজ ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্পে।

সওজের সঙ্গে কাজ করা তিন ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তানতিয়া কনস্ট্রাকশন কেএমসি নামের দুটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে সাসেক সংযোগ প্রকল্প--এর মাধ্যমে এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পে। এর মধ্যে কেএমসি ৩১৯ কোটি তানতিয়া কনস্ট্রাকশন বাস্তবায়ন করছে ১৯৭ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ। এফকনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড নামে আরেকটি ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে আশুগঞ্জ নদীবন্দর-সরাইল-ধরখার-আখাউড়া স্থলবন্দর মহাসড়ক চার লেন জাতীয় মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন