ফুডগ্রেডেড পাত্র ছাড়া ভোজ্যতেল বাজারজাত নয়

দ্রুত বাস্তবায়ন হোক

গুণগত মান নিশ্চিতে ভোগ্যপণ্যের প্যাকেজিং একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। রান্নার নিত্যব্যবহার্য উপাদান হওয়ায় বিশেষত ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে এটি আরো বেশি জরুরি। দেশে ভোজ্যতেল সংরক্ষণ, প্যাকেজিং বাজারজাতে এখনো অযথাযথ অস্বাস্থ্যকর চর্চাগুলোরই প্রাধান্য। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, মাত্র ৩৫ শতাংশ ভোজ্যতেল বোতলের মাধ্যমে বাজারজাত করা হয়। বাকি ৬৫ শতাংশই বাজারজাত হচ্ছে নোংরা ড্রামের মাধ্যমে। ছয় মাসের মধ্যে রিফাইনারিগুলোকে শতভাগ ভোজ্যতেল ফুডগ্রেডেড বোতল বা পাত্রে বাজারজাত করার নির্দেশ দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। নিরাপদ খাদ্য জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এটি দ্রুত বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

প্রায় তিন বছর ধরে ড্রামে ভোজ্যতেল বাজারজাত বিক্রি বন্ধের আলোচনা চলছে। তেল স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বিপণন বিক্রির ব্যাপারে কথা হচ্ছে। এক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। এখনো দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ভোজ্যতেল বাল্ক আকারে অনিরাপদভাবে বিক্রি হচ্ছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা এসব তেল সারা দেশে সরবরাহ করছেন। ড্রামে পরিবহন করে গ্রাম-গঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছেন। সেখানে পুনরায় অন্য কোনো ড্রাম কিংবা আলাদা পাত্রে ভরে বিক্রি করা হচ্ছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, কেমিক্যাল, লুব্রিক্যান্ট, মবিল বা অন্য পণ্যের ব্যবহূত ড্রামগুলোই এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে পরিষ্কার না করেই একই ড্রাম দীর্ঘদিন বারবার ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার ড্রামের তেলে অনেক ধরনের অনিয়মও হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পাম কিংবা সুপার পাম তেল বিক্রি করা হচ্ছে সয়াবিন বলে। তেলের মেয়াদ সম্পর্কেও পাওয়া যাচ্ছে না সঠিক ধারণা। ড্রামে ব্যবহার করা হচ্ছে না কোনো লেবেল। ভিটামিন- ফর্টিফিকেশন আইনত বাধ্যতামূলক হলেও ড্রামের তেলে সঠিক মাত্রার ভিটামিন পাওয়া যাচ্ছে না বলে নানা সমীক্ষায় উঠে আসছে। তদুপরি ড্রাম বা খোলা তেলে অন্য ক্ষতিকর উপাদানও মিশে যাওয়ার খবর মিলছে। সব মিলিয়ে অস্বাস্থ্যকরভাবে বাজারজাত করা ভোজ্যতেল পরিভোগে হুমকিতে পড়ছে জনস্বাস্থ্য। অবস্থায় ড্রামে তেল বাজারজাত পরিবহন বন্ধের বিকল্প নেই।

জাতিসংঘের খাদ্য কৃষি সংস্থা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যৌথভাবে ভোজ্যতেল সংরক্ষণ পরিবহনের একটি বৈশ্বিক চর্চা বিধি বেঁধে দিয়েছে। সেখানে কীভাবে ভোজ্যতেল সংরক্ষণ, পরিশোধন, পরিবহন, বাজারজাত করতে হবে, সেটি বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে। এতে কোন ধরনের পাত্র ব্যবহার করবে, পাত্র কোন উপকরণের তৈরি হতে হবে, তেলে ভেজাল বা অনাকাঙ্ক্ষিত দূষণ এড়াতে কী করতে হবে, কত তাপমাত্রায় রাখতে হবে প্রভৃতি বিষয় স্পষ্টভাবে বিধৃত। প্রতিটি দেশই বৈশ্বিক চর্চাবিধি মেনে চলছে। পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোয় এখন খোলা তেল বা ড্রামে ভোজ্যতেল পরিবহন এখন একটা কল্পনাতীত ব্যাপার। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশ পরিশোধন থেকে শুরু করে বাজারজাত সব ধাপেই অত্যাধুনিক প্রক্রিয়া পদ্ধতি অনুসরণ করছে। ভারতেও এক্ষেত্রে লক্ষণীয় উন্নতি ঘটেছে। দেশটিতে পরিশোধন কোম্পানিগুলো সর্বসাম্প্রতিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভোজ্যতেল পরিশোধন করছে এবং স্বাস্থ্যসম্মত প্যাকেজিংয়ের মাধ্যমে বাজারজাত করছে। ফলে নাগরিকদের কাছে নিরাপদ মানসম্মত ভোজ্যতেল সরবরাহ করতে অনেকাংশে সমর্থ এখন দেশটি। উল্লিখিত দেশগুলোর পথ আমাদের জন্য অনুসরণীয়।

বিশেষজ্ঞরা অনেক আগে থেকেই দেশে ভোজ্যতেলের নিরাপদ স্বাস্থ্যসম্মত প্যাকেজিংয়ের কথা বলে আসছেন। সেজন্য তারা ড্রামের পরিবর্তে প্লাস্টিক বোতল, পলিপ্যাক প্লাস্টিক ফয়েলের বিভিন্ন আকৃতির ফুডগ্রেডেড পাউচপ্যাকের মাধ্যমে বাজারজাত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করেছেন। সুপারিশের আলোকে রিফাইনারি সংশ্লিষ্ট সমিতিকে জনস্বাস্থ্য জনস্বার্থ বিবেচনায় ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ড্রামে ভোজ্যতেল বাজারজাত বন্ধ করে ফুডগ্রেড প্যাকে ভিটামিন- মিশ্রিত ভোজ্যতেল বাজারজাত নিশ্চিত করতে বলা হয়। রিফাইনারিগুলোও ব্যাপারে আগ্রহী। বারবার ব্যবহারের ফলে অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়া ড্রাম, উৎপাদন মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ না থাকা এবং ভিটামিন- ফর্টিফিকেশন না করার দোষ তাদের ওপর পড়ে বিধায় তারাও ড্রামে তেল বাজারজাত করা থেকে সরে আসতে চায়। কিন্তু নানা কারণে তা আর বাস্তবায়ন হয়নি। এখন শিল্প মন্ত্রণালয় ফুডগ্রেডেড ড্রাম, বোতল বা প্যাকেটে শতভাগ ভোজ্যতেল বাজারজাত করতে ছয় মাস সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। রিফাইনারিগুলোর এক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকাই বাঞ্ছনীয়।

সরকারি কর্তৃপক্ষগুলো একটি সিদ্ধান্ত কিংবা নির্দেশনা দিয়েই অনেকটা দায়সারার একটি প্রবণতা দেশে বিদ্যমান। সুনির্দিষ্ট নির্দেশ বা সিদ্ধান্তটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা, অগ্রগতি কতটুকু, সেটি খুব একটা নজরদারি করা হয় না। ড্রামে ভোজ্যতেল বাজারজাত বন্ধের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় আশা করব। এখন একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে রিফাইনারিগুলো স্বাস্থ্যসম্মত বোতল বা প্যাকেটে ভোজ্যতেল বাজারজাত করতে পারছে কিনা, তা নিয়মিত তদারক করতে হবে। খুচরা পর্যায়ে বোতল বা প্যাকেটের মাধ্যমে ভোজ্যতেল বাজারজাত করতে কিছু কোম্পানি ভালো করছে। পাইকারি পর্যায়েও ফুডগ্রেডেড পাত্রে তেল বাজারজাত করা অসম্ভব নয়। এক্ষেত্রে রিফাইনারিগুলোকেও আরো সক্রিয় হতে হবে। ব্যর্থ হলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। ভোজ্যতেল একটি জনস্বাস্থ্যগত ইস্যু। এক্ষেত্রে ন্যূনতম শৈথিল্যের সুযোগ নেই।

নিরাপদ পুষ্টিমানসমৃদ্ধ খাদ্যপ্রাপ্তি মানুষের মৌলিক মানবাধিকার। আর সেটি নিশ্চিতের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। যেভাবে ভোজ্যতেল বাজারজাত বিক্রি হচ্ছে, তা অনিরাপদ স্বাস্থ্যহানিকার। ফলে মানুষ নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। এভাবে আর চলতে পারে না। দেশে প্যাকেজিং আইন আছে, রয়েছে নিরাপদ খাদ্য আইনও। দুটো আইনের মানদণ্ডেই ভোজ্যতেল বাজারজাতের বর্তমান চর্চা বেআইনি। একই সঙ্গে অস্বাস্থ্যকরও। আইনের কঠোর প্রয়োগ, রাষ্ট্রীয় নজরদারি, সংশ্লিষ্টদের সক্রিয়তায় নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে শতভাগ ভোজ্যতেল স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বাজারজাত হবে, এটিই প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন