ডান ও বাম বিচ্যুতির কথা

আনু মুহাম্মদ

ফরাসি মার্ক্সবাদী চার্লস বেটেলহেইম এবং চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও শিল্পায়ন নিয়ে তার লেখা বইয়ের প্রচ্ছদ

পিপলস রিপাবলিক অব চায়না। জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্র। ইরান, ভারত, ইনকা, মায়ার মতো প্রাচীন চীনের সভ্যতা। ১৯৪৯ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লবের পর এক নতুন চীনের যাত্রা হয়। নানা রকম সংস্কার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান বিশ্বে চীন অন্যতম এক পরাশক্তি। জিডিপির হিসাবে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফসল নয়া চীন এখন পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্র। ঐতিহাসিক বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে চীনের শক্তি-দুর্বলতা, সাফল্য-ব্যর্থতা ধারাবাহিক পরিবর্তনগুলো নিয়ে লিখেছেন আনু মুহাম্মদ

সাংস্কৃতিক বিপ্লব: একজন বাংলাদেশীর অভিজ্ঞতা

শুরু থেকেই চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ করেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক লেখক ফয়েজ আহমেদ। তার কাছ থেকে চীনের ইতিহাসের দুই পর্বের অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়। একটি ১৯৬৬ সাল যখন সেখানে সাংস্কৃতিক বিপ্লব চলছিল এবং আবার ১৯৮৩ সাল যখন চীন সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিমুখে সংস্কার করে অগ্রসর হচ্ছে তখন। ১৯৬৬ সালে তিনি পিকিংয়ে অবস্থান করছিলেন তত্কালীন দৈনিক আজাদের প্রতিনিধি হিসেবে। সময় ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসন চলছিল। সময় অনেকবারই মার্কিন বিমান রণতরী চীনের আকাশ সমুদ্রসীমা লঙ্ঘন করে। এসব তত্পরতার বিরুদ্ধে তখন পর্যন্ত চীনকে চার শতাধিক সতর্কতামূলক প্রতিবাদ জানাতে হয়।

সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে বলা হচ্ছিল শুদ্ধি অভিযানের আন্দোলন যা পরিচালিত হচ্ছিল চার পুরনোর বিরুদ্ধে প্রাচীন চিন্তাধারা, প্রাচীন অভ্যাস, প্রাচীন দেশাচার প্রাচীন সংস্কৃতি বিরাট আকৃতির তাজেবাও বা পোস্টারে লেখা হয়েছে—‘আমরা প্রাচীন পৃথিবীর সমালোচক, আমরা নতুন পৃথিবীর স্রষ্টা। রাস্তার নাম, ভবনের নাম পরিবর্তন হতে থাকে। ফয়েজ আহমেদ লিখছেন, পিকিংয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনবহুল সম্ভ্রান্ত বিপণি কেন্দ্রের রাস্তার নাম ছিল ওয়াং ফু চিং বা রাজকুমারের কুয়োপথ লাল প্রহরীরা নাম পরিবর্তন করে জনপথ করেছেন। শহরে প্রধান রাস্তা, যা পিকিংকে দুভাগ করে তিয়ান আনমেন স্কোয়ারের ওপর দিয়ে গেছে, তার নাম ছিল চ্যাংআন (চিরশান্তি) নতুন নাম হয়েছে এর তুং ফাং হোং’—পূর্ব দিগন্তে লাল সূর্যোদয় (ইস্ট ইজ রেড) রকম সোভিয়েত দূতাবাসের সামনের সড়ক সংশোধনবাদ বিরোধী পথ, ভিয়েতনাম দূতাবাসের সামনের সড়ক ভিয়েতনামকে সাহায্য কর স্ট্রিট ইত্যাদি।

একসময় মার্কিনদের নিয়ন্ত্রণে থাকা হাসপাতালের নাম দেয়া হয়েছে, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হাসপাতাল

পোশাক, খাবার, ফ্যাশন ইত্যাদি নিয়েও কথা বিতর্ক হচ্ছিল। বলা হয়েছে, দেশের অধিকাংশ মানুষই যখন কাপড়, ক্যানভাস, তুলো প্লাস্টিকের জুতো পরে, তখন মুুষ্টিমেয় ব্যক্তির চামড়ার দামি জুতো পরার চেষ্টা বাঞ্ছনীয় নয় (এদেশে এখন কাউকে খালি পায়ে দেখা যায় না) ছেলে মেয়েদের চুলের ফ্যাশন নিয়ে আপত্তি দেখা দেয়ায় কিছুদিনের জন্য মেয়েদের লম্বা বেণি বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। ফয়েজ আহমেদ লিখেছেন, দুমাসের মাথায় নভেম্বরে পিকিং শহরে অনেক মেয়ের মাথায় লম্বা বেণি দেখা গেছে। তাছাড়া পরবর্তীকালে সিংকিয়াং থেকে রাজধানীতে আগত মেয়ে লাল প্রহরীদের অধিকাংশেরই দীর্ঘ কেশ ছিল। সম্ভবত কর্তৃপক্ষ দীর্ঘ কেশের বিরুদ্ধে অভিযানকে লাল প্রহরীদের অতিরিক্ত তত্পরতার মধ্যে গণ্য করেছেন।

চীনের গ্রাম শহর সর্বত্র তখন তরুণ রেড গার্ড বা লাল প্রহরীদের তত্পরতা। সব অঞ্চলের চেহারাই পাল্টে গেছে তখন তাদের সক্রিয়তায়। ফয়েজ আহমেদ দেখছেন,

এখন পিকিং শহরের সর্বত্র চেয়ারম্যান মাও সে তুংয়ের চিত্র আর তার পুস্তক থেকে উদ্ধৃতি দেখা যাচ্ছে। সমগ্র শহরটা তার চিত্র বাণীতে ছেয়ে গেছে। এমন একটি প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য স্থান নেই, যেখানে চেয়ারম্যান মাওয়ের ছবি উদ্ধৃতি টাঙানো হয়নি। লাল প্রহরী আন্দোলনের প্রবাহে চিত্র বাণী টাঙানোর জোয়ার এসেছে। তবে আন্দোলনের আগেও তার চিত্র বাণী দেখা যেতএমন ব্যাপক ছিল না। কেউ কেউ অনুমান করেন, শহরে প্রায় এক মিলিয়ন সাইকেল রয়েছেএখন প্রত্যেক সাইকেলচালক তার সাইকেলের হাতলের মধ্যভাগে চেয়ারম্যান মাওয়ের বাণী লিখিত এক টুকরো বোর্ড টাঙিয়েছেন। বাস ট্রলিবাসে তার ছবি বাণী রয়েছে। আর এসব যানের সামনে বিপ্লবের চিহ্ন লাল পতাকা উড়ছে।

আগেই বলেছি, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় লিন পিয়াওয়ের গুরুত্ব দ্রুত বাড়তে থাকে। তিনি গুরুত্বের দিক থেকে মাওয়ের পরই গণ্য হতে থাকেন। মনে হচ্ছিল তিনিই মাওয়ের সবচেয়ে বেশি আস্থাভাজন। ১৯৬৬ সালে লাখ লাখ মানুষের বিভিন্ন সমাবেশে নেতাদের উপস্থিতি, বক্তৃতা অবস্থান থেকে বিষয়টিই স্পষ্ট হচ্ছিল। একই বছরের অক্টোবর চীনের জাতীয় দিবসে যথারীতি তিয়ান আন মেন স্কোয়ারে ১৫ লাখ মানুষের বিশাল সমাবেশ হয়। সমাবেশে দেশরক্ষামন্ত্রী লিন পিয়াও পার্টি সরকারের পক্ষ থেকে শোভাযাত্রায় বক্তৃতা করেন। প্রেসিডেন্ট লিউ শাও চী, প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই মার্শাল চু তে মঞ্চের ওপর চেয়ারম্যান মাওয়ের সঙ্গে থাকলেও বক্তৃতা করেননি। রেডিওতে প্রেসিডেন্ট লিউ শাও চীর নাম এবার লিন চৌয়ের পরই প্রচার করা হয়েছে। গত কিছুদিন তার নাম সপ্তম নম্বরে দেখা গিয়েছিল। লিন পিয়াওয়ের বিরুদ্ধেই এর কয়েক বছরের মাথায় বিপ্লববিরোধী সামরিক অভ্যুত্থানের চক্রান্তের অভিযোগ ওঠে।

সাংস্কৃতিক বিপ্লব: ডান বাম বিচ্যুতির কথা

রুশ চীন বিপ্লব এবং এসব দেশে বিপ্লব-উত্তর গতি-বিতর্ক-সংকট সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা গবেষণার জন্য ফরাসি মার্ক্সবাদী পণ্ডিত চার্লস বেটেলহেইম (১৯১৩-২০০৬) বিখ্যাত। রাশিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নে বিপ্লব-উত্তর বিতর্ক, ওঠানামা, শ্রেণী দ্বন্দ্ব শ্রেণী সংগ্রাম নিয়ে কয়েক খণ্ডে তার গ্রন্থ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীনের ব্যাপারেও বিপ্লব বিপ্লব-উত্তর পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা বিশ্লেষণ আছে তার। ১৯৬৬ সালে সাংস্কৃতিক বিপ্লবকালে এবং এরপর বেশ কয়েকবার তিনি চীন সফর করেন। তিনি ছিলেন ফ্রান্স-চীন মৈত্রী সমিতির সভাপতি।

সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় বেটেলহেইম বেশকিছু শিল্প এলাকা পরিদর্শন করেন এবং শ্রমিকদের ভূমিকার প্রতি বিশেষ নজর দেন। তিনি বলেন, প্রশ্ন থাকলেও শ্রমিকদের বেশ কয়েক মাস লাগল বিদ্যমান ব্যবস্থা নিয়ে সরব হতে। সব শিল্প-কারখানাতেই শ্রমিকদের ব্যবস্থাপনা কমিটি ছিল যাতে ছিলেন শ্রমিকদের নির্বাচিত প্রতিনিধি আর যাদের ওই পদ থেকে প্রত্যাহার করারও সুযোগ ছিল। তাদের দায়িত্ব ছিল প্রধানত পাঁচ ক্ষেত্রে: () মতাদর্শিক রাজনৈতিক; () উৎপাদন কারিগরি বিষয়; () ব্যয় নিয়ন্ত্রণ বিনিয়োগসহ অর্থসংস্থানের বিভিন্ন দিক; () কাজের নিরাপত্তা; () সাধারণ কল্যাণ। কমিটি ছিল বস্তুত ফ্যাক্টরি ব্যবস্থাপনা সাধারণ শ্রমিকদের যোগসূত্র। কমিটি কারখানার পার্টি কমিটির নেতৃত্বেই কাজ করত।

সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়ে পার্টি কমিটি যখন বহুস্থানে অকার্যকর হয়ে যায় তখন সংশোধনবাদী ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে অনেকগুলো কারখানায় বিপ্লবী কমিটি গড়ে ওঠে। কমিটিগুলোতে তিন অংশের প্রতিনিধিত্ব ছিলজনতা, পার্টিকর্মী পিপলস লিবারেশন আর্মির সৈন্য। তিন বয়স গ্রুপের মানুষ রাখা হতো কমিটিতে: তরুণ, মধ্যবয়সী প্রবীণ। পুরনো পার্টি কমিটিগুলো থেকে কিছু বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটে তখন। তবে বেটেলহেইম হাজার ১১৯টি কারখানায় জরিপ চালিয়ে দেখেছেন শতকরা মাত্র . ভাগ কারখানায় পার্টি কমিটিগুলোর পুরনো সদস্য বহিষ্কারের ঘটনা ঘটেছে।

বেটেলহেইম লিউ শাউ চীর বক্তব্য সম্পর্কে বলেছেন, লিউ মুনাফা, বস্তুগত প্রণোদনা বিশেষজ্ঞদের ওপর নির্ভরশীলতার ভিত্তিতে সব উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ওপর জোর দিয়েছেন। দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে মাও সে তুংয়ের লাইনকেই সঠিক বলেছেন তিনি। এর কারণটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, যদি মুনাফা প্রণোদনাই সব উৎপাদন তত্পরতার পরিচালনা শক্তি হয়, তাহলে উৎপাদন সম্পর্কের বিপ্লবীকরণের বদলে শ্রমিকরা নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থ এবং মুনাফা বৃদ্ধির উপযোগী উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে মনোযোগী হয়। ব্যক্তিগত প্রণোদনা ব্যবস্থা কার্যকর করতে গেলে পুরো ব্যবস্থার মধ্যে তত্ত্বাবধান, নিয়ন্ত্রণ হায়ারার্কির মাধ্যমে পুঁজিবাদী সম্পর্কেরই পুনরুৎপাদন ঘটায়। যদি এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম সজীব না থাকে, তাহলে পুঁজিবাদের পুনরুত্থান একটি সার্বক্ষণিক সম্ভাবনা হিসেবেই থেকে যায়।

এর পাশাপাশি ডান বিচ্যুতি বিরোধিতা করতে গিয়ে সাংস্কৃতিক বিপ্লবকালে যে বাম বিচ্যুতি ঘটনাও ঘটছিল, সে বিষয়েও বেটেলহেইম বিশেষ মনোযোগ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দুটো ঝোঁক চীনের বিপ্লবীদের মধ্যে সমস্যাজনক হয়ে উঠেছিল। একদিকে মত ছিল যে, উৎপাদিকা শক্তি যথেষ্ট বিকশিত না হওয়া পর্যন্ত সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে কোনো নতুন পরিবর্তনের চাপ তৈরি করা যাবে না। সময়ে অর্থনৈতিক দক্ষতা বৃদ্ধিকে প্রধান গুরুত্ব দিয়ে বিশেষ ধরনের শৃঙ্খলা বিধিবিধান তৈরি করতে হবে। এটাই লিউ তার সহযোগীদের লাইন ছিল। অন্যদিকে এর বিপরীতে বাম গোঁড়ামি বা উগ্রপন্থা দেখা যায়। যারা ওই মুহূর্তেই ব্যক্তি মালিকানার সব চিহ্ন মুছে ফেলার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। কমিউনগুলোতে কাজ অনুযায়ী মজুরি প্রদানকেও তারা বাধা দিচ্ছিলেন। তাদের লাইন ছিল সব ব্যক্তিগত জমি তাতে চাষাবাদ তখনই বন্ধ করে দিতে হবে। কোনো প্রস্তুতির বিষয় তাদের বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। মতাদর্শিক রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনা না করে ব্যক্তিগত আক্রমণ, সামাজিকভাবে অপদস্থ করা এমনকি শারীরিক আক্রমণের ঘটনা তারা ঘটাতে থাকেন। যেমনসাংহাইতে আয়রন অ্যান্ড স্টিল ইনস্টিটিউট মাসের পর মাস অচল থাকে ধরনের তত্পরতার জন্য। কয়েক মাস পর উগ্র বামপন্থী নেতাকে পার্টি থেকে বহিষ্কারের পরই আবার তা চালু হয়। ওই নেতা ওখানকার শ্রমিক ছিলেন না, ছিলেন বুদ্ধিজীবী।

রাজনৈতিক সংগ্রামে অর্থনৈতিক অগ্রগতি

প্রকৃতপক্ষে সাংস্কৃতিক বিপ্লবে কৃষক-শ্রমিকদের অংশগ্রহণ যত বাড়তে থাকে, ততই এর নানামুখী বিচ্যুতি কমতে থাকে। কেননা কৃষক-শ্রমিকদের বিভিন্ন ইউনিট বা সাংগঠনিক কাঠামো নির্বিচার বাড়াবাড়ির পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে কাজ করতে বেশি আগ্রহী ছিল। তাঁদের প্রয়োজন ছিল উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি নিজেদের বিপ্লবী সম্পর্কের বিষয়ে যথাযথ দৃষ্টি দেয়া। অনাবশ্যক বা ইচ্ছামতো কাউকে আঘাত করা বা তোয়াজমুখী তত্পরতা বা সে রকম মনোভঙ্গি তাদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম দেখা গেছে বলে অনেক পর্যবেক্ষক জানিয়েছেন।

উচ্চলম্ফ এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবে যে উথাল-পাথাল হয়, কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা বিন্যাসে যে রকম পরিবর্তন বা টানাপড়েন দেখা যায়, তাতে অর্থনৈতিক সূচকগুলোতে অবনতি দেখা দেয়ার কথা। কিন্তু তা ঘটেনি বরং অনেক ক্ষেত্রে তা যে সহায়ক হয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন তথ্য থেকে। ভারতের অনীক পত্রিকার সম্পাদক, লেখক গবেষক দীপংকর চক্রবর্তী বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ ঘেঁটে একই সময়ে ভারত চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতির তুলনামূলক আলোচনা করেছিলেন। তিনি পিকিং রিভিউ, জার্নাল অব কনটেমপোরারি এশিয়ায় প্রকাশিত রিপোর্ট এবং তার সঙ্গে নিকোলাস ব্রুনার, এডগার স্নো, ফেলিক্স গ্রিনের গ্রন্থ পর্যালোচনা করে তুলনামূলক চিত্রটি হাজির করেছিলেন। সময়কাল ধরা হয়েছিল ১৯৫০-৫১ থেকে ১৯৭০-৭১। দেখিয়েছেন, ২০ বছরে ভারতে জাতীয় আয় বেড়েছে শতকরা ৪১ ভাগ, চীনে ছয়গুণ; শিল্প উৎপাদন ভারতে বেড়েছে দ্বিগুণ, চীনে ২০ গুণ; কৃষি উৎপাদনে বেড়েছে ভারতে শতকরা ৮২ ভাগ, চীনে দশমিক গুণ; রেলপথ ভারতে বেড়েছে শতকরা ২০ ভাগ, চীনে চারগুণ; বিদ্যুৎ শক্তি ভারতে বেড়েছে নয়গুণ, চীনে ৩০ গুণ।

চীনের সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খুবই মনোযোগী বিশ্লেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত আরেকটি গ্রন্থে আরো সতর্কতার সঙ্গে অর্থনৈতিক অগ্রগতির হিসাব পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়েছে। গ্রন্থের সম্পাদকমণ্ডলী প্রথমেই বলেছেন, সমাজতন্ত্রে উত্তরণের প্রাথমিক স্তরে (চীনের কমিউনিস্ট) পার্টি দুটো কাজকে গুরুত্ব দিয়েছে বেশি। এগুলো হলো () দারিদ্র্য অর্থনৈতিক স্থবিরতা থেকে মুক্তির জন্য শিল্পায়নকে ভিত্তি করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন; এবং () দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদন উপায়ের ওপর ব্যক্তিমালিকানা থেকে যৌথ রাষ্ট্রীয় দুভাবেই সমাজতান্ত্রিক মালিকানায় উত্তরণ।

গ্রন্থে প্রদত্ত হিসাব অনুসারে ১৯৫২ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত শিল্প উৎপাদন বেড়েছে গড়ে শতকরা ১১ ভাগ হারে। সেই তুলনায় খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়েছে কম হারে, যদিও তা জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তুলনায় বেশি ছিল। কৃষি খাতে সেই সময় শুধু মালিকানায় পরিবর্তন আসেনি, কৃষি যন্ত্রপাতি এবং অবকাঠামোগত পরিবর্তনও হয়েছে বিস্তর। কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল বন্যা নিয়ন্ত্রণ সেচ ব্যবস্থাপনা। বলা হয়, চীনের কৃষিতে ভূমি উন্নয়ন, সেচ, পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে সময়কালে নতুন প্রায় ১০ কোটি বাড়তি কর্মসংস্থান হয়। ১৯৫০ দশকে দামস্তর মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। ৬০ দশকের প্রথমদিকে দামস্তরের কিছুটা বৃদ্ধি ঘটে, তবে ৭০ দশকের মাঝামাঝি তা আবার স্থিতিশীল হয়। গ্রন্থকারদের মতে, সময়কালে কৃষি শিল্প উৎপাদনে যে মাত্রায় অগ্রগতি হয়েছে, শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি সেই তুলনায় কম হয়েছে।

উপরোক্ত গ্রন্থভুক্ত একটি প্রবন্ধে ভিক্টর লিপ্পিট দেখিয়েছেন, সমাজতন্ত্রে উত্তরণে অগ্রগতিনির্ভর করে কতটা সাফল্যের সঙ্গে সমাজের পুরনো দ্বন্দ্ব নিরসন করা যায় তার ওপর। এগুলোর মধ্যে আছে প্রত্যক্ষ উৎপাদকদের সঙ্গে সমাজের দ্বন্দ্ব, সামাজিক চেতনা বিকাশের সঙ্গে সমাজের বিদ্যমান বিন্যাসের দ্বন্দ্ব, জনগণের সঙ্গে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব। তিনি এই সঙ্গে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে এসব দ্বন্দ্ব যথাযথভাবে নিরসন না হলে পার্টি ক্যাডার আমলাদের মধ্য থেকে একটি নতুন ক্ষমতাবান শ্রেণীর উদ্ভব ঘটা খুবই সম্ভব। যার ফলে () এরা অর্থনৈতিক উদ্বৃত্তের একটি বড় অংশ আত্মসাৎ করবে, প্রত্যক্ষ উৎপাদকদের সঙ্গে তাদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব বাড়বে। () নিজেদের জীবন তত্পরতার ওপর শ্রমজীবী মানুষের নিয়ন্ত্রণ কমবে। এবং () প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতেও নতুন শ্রেণী ক্ষমতা তৈরি হবে। এই আশঙ্কা যে খুবই সঠিক ছিল তা পরে প্রমাণিত হয়েছে।

সাংস্কৃতিক বিপ্লব চলাকালেই মাও সেতুং বলেন, বর্তমান মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লব ধরনের এটাই প্রথম। ভবিষ্যতে রকম আরো বহু সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রয়োজন হবে। কে বিজয় লাভ করবে, সমাজতন্ত্র না পুঁজিবাদ, তার নিষ্পত্তির জন্য দীর্ঘ ঐতিহাসিক পর্বের প্রয়োজন হবে। সংগ্রাম যদি সফলভাবে পরিচালনা করা না যায়, তাহলে পুঁজিবাদের পুনরুত্থান সবসময়ই একটি সম্ভাবনা হিসেবে জাগরূক থাকবে।

বলাই বাহুল্য, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির পর ৭০ দশকেই আমরা চীনে ভিন্নমুখী যাত্রার সূচনা দেখতে থাকলাম। [চলবে]

 

আনু মুহাম্মদ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন