জার্মানির মধ্য বার্লিনে কিছুদিন ধরে বিশালায়তনের নতুন এক বিলবোর্ড দেখা যাচ্ছে। বিলবোর্ডের শিরোনাম ‘চুস মুট্টি’। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় ‘বিদায় মা’। বিলবোর্ডটিতে মুখাবয়বহীন এক নারীর ছবি। চেহারা না দেখালেও আইকনিক জ্যাকেট ও দুই হাত পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত করে রাখার ভঙ্গিমাতেই পথচারীরা বুঝে নিচ্ছেন, কাকে বিদায় জানাচ্ছে জার্মানি।
দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকার পর জার্মানির চ্যান্সেলর পদে আর নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অ্যাঙ্গেলা মেরকেল। টানা দেড় দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতাসীন থাকাকালে জার্মানির সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। জার্মানদের একের পর এক সংকটে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। একই ভূমিকা রেখেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নেও (ইইউ)। ব্রেক্সিট, কভিড-১৯, শরণার্থীসহ আরো অনেক সংকটেই তার ভূমিকা ছিল নেতৃস্থানীয়। গোটা ইইউতেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা।
মেরকেলের উত্তরসূরি নির্বাচনে গোটা জার্মানিতে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে আগামীকাল। তবে নতুন নেতা নির্বাচনের চেয়ে পুরনো চ্যান্সেলরের বিদায়ের বিষয়টিই জার্মানদের এখন আলোড়িত করছে বেশি। মেরকেলের উত্তরসূরি সংকটকালে তার মতো শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবেন কিনা, সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠছে সবখানেই। একই প্রশ্ন উঠে আসছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও।
গত দেড় বছর একের পর এক বড় সংকটের মুখোমুখি হয়েছে জার্মানি। ক্ষমতায় বসার তিন বছরের মাথায় প্রথম বড় পরীক্ষার সম্মুখীন হন মেরকেল। সে পরীক্ষায় উতরে গিয়েছিলেন তিনি। তার নেতৃত্বে ২০০৮ সালের মহামন্দা ভালোভাবেই মোকাবেলা করেছে জার্মান অর্থনীতি। এর পর পরই আসে ইউরোজোনের ঋণ সংকট। জার্মানির অর্থনীতিকে এর অভিঘাত থেকে সুরক্ষা দিতে মেরকেলের গৃহীত পদক্ষেপগুলো ওই সময় বেশ প্রশংসিত হয়। ২০১৬ সালে তুরস্কের সঙ্গে এক চুক্তির মাধ্যমে বর্ষব্যাপী শরণার্থী সমস্যার সমাধান ঘটান তিনি। বিষয়টি নিয়ে নিজ দেশের ডানপন্থী দলগুলোকেও মোকাবেলা করতে হয়েছে তাকে।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বেশ শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছেন মেরকেল। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সংঘাত চলাকালে দুই দেশের মধ্যে শান্তি স্থাপনে মধ্যস্থতা করেছেন তিনি। এ শান্তি ক্ষণস্থায়ী হলেও বিষয়টি মেরকেলকে আরো প্রভাবশালী করে তুলেছিল। ব্রেক্সিট প্রক্রিয়ায়ও বড় ভূমিকা রেখেছেন তিনি। ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইইউভুক্ত দেশগুলোর দীর্ঘদিনের মিত্রতা নড়বড়ে হয়ে ওঠে। ওই সময় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই সামাল দিয়েছেন অ্যাঙ্গেলা মেরকেল।
তার শাসনামলে জার্মানির রফতানি উদ্বৃত্ত পৌঁছেছে সর্বকালের সর্বোচ্চে। ২০১৯ সালে কভিডের আগে দেশটির জিডিপিও বেড়ে দাঁড়িয়েছিল রেকর্ড সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
তবে তার পদক্ষেপ নিয়ে বিতর্কও রয়েছে। অনেকেই বলেন, তার কৃচ্ছ্র নীতির ফলে লাভের চেয়ে ক্ষতি হয়েছে বেশি। ডানপন্থী সমালোচকরা এখনো বলেন, ২০১৫ সালে মেরকেলের উচিত ছিল জার্মানির সীমান্ত শরণার্থীদের জন্য বন্ধ করে দেয়া। তবে একটি বিষয়ে সবাই একমত, ১৬ বছরের শাসনামলে জার্মানিকে সমৃদ্ধির দিকেই নিয়ে গিয়েছেন অ্যাঙ্গেলা মেরকেল।
অন্যদিকে পরিবেশ সুরক্ষায় ভূমিকার কারণে ‘ক্লাইমেট চ্যান্সেলর’ হিসেবে পরিচিতি পেলেও জার্মানির গাড়ি শিল্পকে ছাড় দিয়েছেন তিনি। এছাড়া নিজ দেশেই কার্বন নিঃসরণ যথাযোগ্য মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি তিনি। সেক্ষেত্রে ২০৪৫ সালের মধ্যে জার্মানিকে কার্বন নিঃসরণকারী দেশের তালিকা থেকে বের করে আনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে কিনা, সে বিষয়েও সন্দেহ রয়ে গিয়েছে।