মুদ্রাবাজারে দ্রুত পতন ঘটছে বর্মি কিয়াতের

বণিক বার্তা ডেস্ক

মিয়ানমারে সামরিক জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ দিন দিন আরো সহিংস রূপ নিয়েছে ফাইল ছবি: এপি

কভিডের অভিঘাতে আগে থেকেই ধুঁকছিল অর্থনীতি। ফেব্রুয়ারিতে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখলের পর অর্থনৈতিক সব সূচকেই মিয়ানমারের পতন আরো ত্বরান্বিত হয়। দেশটিতে চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির ধাক্কা মুদ্রাবাজারেও স্পষ্ট। মিন অং হ্লাইংয়ের ক্ষমতা দখলের পর গত সাত মাসে বর্মি মুদ্রা কিয়াতের বিনিময় হার কমেছে ৬৫ শতাংশেরও বেশি।

মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা দিন দিন চরম আকার ধারণ করেছে। বিভিন্ন প্রদেশে এরই মধ্যে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়েছে অভ্যুত্থানবিরোধীরা। অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে বড় শহরগুলোয় রাস্তায় নেমেছে বিক্ষোভকারীরা। একই সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি দপ্তরগুলোয় চলেছে অসহযোগ আন্দোলন। বিক্ষোভ প্রতিবাদ থামাতে দমন-পীড়নের পথ বেছে নিয়েছে সামরিক জান্তা। তাতে ফল হয়েছে উল্টো। জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ রূপ নিয়েছে সশস্ত্র সংঘাতে। বর্তমানে গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে দেশটিতে। অন্যদিকে টেলিযোগাযোগ, ব্যাংকিং, স্বাস্থ্য শিক্ষার মতো অপরিহার্য সেবা ব্যবস্থাগুলো ভেঙে পড়েছে। একই সঙ্গে মিয়ানমার থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিতে থাকে বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও। রফতানি নেমে আসে শূন্যের কোঠায়। সব মিলিয়ে মিয়ানমারের অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের অশনিসংকেত নিয়ে এসেছে তাতমাদোর (বর্মি সামরিক বাহিনীর আনুষ্ঠানিক নাম) অভ্যুত্থান।

মুদ্রাবাজারে কিয়াতের বিনিময় হারেও রাজনৈতিক গোলযোগ অস্থিরতার প্রভাব স্পষ্ট। সর্বশেষ গতকালের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশটির মুদ্রাবাজারে বৈধভাবে বিনিময়ের জন্য প্রতি ডলারের মূল্যমান ধরা হচ্ছে হাজার ৮৬৩ কিয়াতের কিছু বেশি। তবে দেশটিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট চরমে ওঠায় মুদ্রাবাজারে ডলারের বৈধ বিনিময় পুরো মাত্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। এর বিপরীতে রমরমা হয়ে উঠেছে ডলারের কালোবাজারের ব্যবসা। রেডিও ফ্রি এশিয়া জানাচ্ছে, মিয়ানমারের কালোবাজারে প্রতি ডলার বিনিময় হচ্ছে হাজার ২০০ কিয়াতের বিনিময়ে। জানুয়ারি শেষে অভ্যুত্থানের আগেও দেশটির কালোবাজারে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল হাজার ৩০০ কিয়াত। সে হিসাবে গত সাত মাসে কালোবাজারে মুদ্রাটির অবমূল্যায়নের হার ৬৫ শতাংশেরও বেশি।

এছাড়া দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেন্ট্রাল ব্যাংক অব মিয়ানমারেরও (সিবিএম) এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রয়েছে বলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। একসময় মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে নির্দিষ্ট একটি রেফারেন্স প্রাইসের দশমিক শতাংশের মধ্যে কিয়াতের বিনিময় হার ধরে রাখার নীতি হাতে নিয়েছিল সিবিএম। তবে গত কয়েক বছরে সিবিএম সে নীতি থেকে বেরিয়ে এসেছে। গত মাসে দেশটির সামরিক জান্তা সিবিএমকে নীতি পুনর্বহালের নির্দেশনা দিয়েছিল। সিবিএমও বলছিল, মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য পদক্ষেপ জরুরি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো ধরনের ব্যাখ্যা ছাড়াই ১০ সেপ্টেম্বর সিবিএম নীতি গ্রহণের পথ থেকে সরে আসে বলে নিক্কেই এশিয়ার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

মিয়ানমারের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, কিয়াতের দ্রুত পতন ঠেকাতে অভ্যুত্থানের পর পর্যন্ত বাজারে প্রায় ১২ কোটি ডলার ছেড়েছে সিবিএম। কিন্তু দেশটিতে ডলারের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে অর্থ খুব একটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি।

কিয়াতের ক্রমহ্রাসমান বিনিময় হারে বর্মি অর্থনীতির দুর্দশা আরো গভীর হওয়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। সহসাই পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসার কোনো সম্ভাবনাও নেই। অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটি থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন প্রচুর বিদেশী ব্যবসায়ী। প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের (এফডিআই) পাশাপাশি ধস নেমেছে দেশটির রফতানি খাতেও। উপরন্তু যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটিতে ডলারের আন্তঃপ্রবাহও এখন প্রায় বন্ধ। অথচ অভ্যুত্থানের আগেও কভিডের অভিঘাত কাটিয়ে দেশটির অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির ধারা ফিরে আসার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিলেন পর্যবেক্ষকরা।

ঋণমান সংস্থা ফিচ রেটিংসের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান ফিচ সলিউশন্সের এক সংশোধিত পূর্বাভাস বলছে, চলতি বছর ২০ শতাংশ হারে সংকুচিত হতে পারে মিয়ানমারের অর্থনীতি। অথচ অভ্যুত্থানের আগেও চলতি বছর দেশটিতে শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল ফিচ সলিউশন্স।

নিয়ে দ্য ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত এক সাম্প্রতিক নিবন্ধে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, কিয়াতের অবমূল্যায়নের কারণে মিয়ানমারে জ্বালানিসহ আমদানীকৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার ক্রমেই আকাশচুম্বী হয়ে উঠবে। অনিয়ন্ত্রণযোগ্য মূল্যস্ফীতি জনসাধারণের ব্যয় বাড়িয়ে তুলবে। বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের মিয়ানমার ইকোনমিক মনিটরের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতির কারণে দেশটির জনগণের জীবনধারণের ব্যয় বেড়ে গিয়ে সামরিক জান্তার জন্য রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তীব্রতর হয়ে উঠবে। অন্যদিকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ক্ষমতা ধরে রাখতে গিয়ে জেড কাঠের মতো পরিবেশবিধ্বংসী ব্যবসার ওপর আরো নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। একই সঙ্গে তারা সেনা নিয়ন্ত্রিত মাদক পাচারের মাত্রাও আরো বাড়িয়ে দিতে পারে। দেশটিতে এরই মধ্যে এসব কার্যক্রম জোরালো হয়ে ওঠার বেশকিছু লক্ষণ দেখা গিয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন