দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন ও আমিষের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ১৯৫৯ সালে গড়ে তোলা হয় যশোর সরকারি মুরগি প্রজনন ও উন্নয়ন খামার। কিন্তু প্রয়োজনীয়সংখ্যক লোকবলের অভাব আর নানামুখী সংকটে মুখ থুবড়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। চাহিদা থাকলেও উৎপাদন সক্ষমতাকে কাজে লাগাতে পারছে না। প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ৪০ লাখেরও বেশি। সেখানে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র দুই লাখ বাচ্চা। সেই হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির সক্ষমতার ৯৫ শতাংশ অব্যবহূত থাকছে। তবে খামারটির কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের কাছে ২৭ কোটি টাকার চাহিদা চাওয়া হয়েছে। এ টাকা বরাদ্দ পেলে বদলে যাবে খামারের চিত্র।
৬২ বছর আগে শহরের শংকরপুর এলাকায় ২৭ বিঘা জমির ওপর যশোর সরকারি মুরগি প্রজনন ও উন্নয়ন খামার গড়ে তোলা হয়। গরমসহিষ্ণু ফাউমি জাতের মুরগির বাচ্চার চাহিদা এ অঞ্চলে বেশি। আর এ জাতের মুরগির বাচ্চা উৎপাদন হয় এ খামারে। ফলে এর বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে বিপুল। কিন্তু এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি এখন পর্যন্ত লাভের মুখও দেখেনি তারা।
জানা গেছে, খামারটিতে চাহিদা অনুযায়ী মুরগির বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছে না। যদিও যশোর অঞ্চলে এ মুরগির বাচ্চা পালনের চাহিদা রয়েছে বছরে ৩৬ লাখের বেশি। যেখানে এ খামারে বছরে মাত্র দুই লাখ বাচ্চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। অথচ ৪০ লাখ ৩২ হাজার বাচ্চা উৎপাদনের আধুনিক যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। তবে ডিম পাড়া মুরগি রাখার ঘর আধুনিকায়ন এবং প্রয়োজনীয় জনবল ও বরাদ্দ বাড়ালে বাচ্চা উৎপাদনের সক্ষমতা কাজে লাগানো সম্ভব হবে বলে মনে করছেন খামারসংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিন দেখা গেছে, খামারটিতে মুরগির বাচ্চা ফোটানোর আধুনিক যন্ত্র (ইনকিউবেটর) রয়েছে ছয়টি। এর মধ্যে একটি যন্ত্র অকেজো। প্রয়োজনীয় ডিমের জোগান না থাকায় বন্ধ রয়েছে এটি। ডিম পাড়া মুরগি ও মোরগ পালনের জন্য ২২টি শেড (ঘর) রয়েছে। এর মধ্যে ১৪টিই ব্যবহারের অনুপযোগী। এ শেডগুলোর চাল টিনের, মেঝে নিচু। ফলে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে থাকে না। আবার যে শেডগুলোতে মুরগি পালন করা হচ্ছে, সেগুলোও আধুনিক পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়নি। মুরগির বিষ্ঠা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার জন্য নেই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা। নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা।
কর্মকর্তারা বলছেন, উষ্ণ জলবায়ুতে খোলা পদ্ধতি ফাউমি জাতের মুরগির বাচ্চা পালনের উপযোগী। এ মুরগির রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বেশি। খাদ্য কম লাগে। একদিনের মুরগির বাচ্চা উৎপাদনে খরচ হয় ২২ টাকা। তবে সরকারি ভর্তুকি মূল্যে ১২ টাকা দরে বিক্রি হয়। এ কারণে এই বাচ্চার চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। তবে তারা চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে পারছেন না।
জানা গেছে, ২০২০ সালের জুন থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত তিন মাসে ৮৯ জন উদ্যোক্তা ৫ লাখ ৬৩ হাজার ৭৩০টি মুরগির বাচ্চার চাহিদা দিয়ে আবেদন করেন। তবে খামারের বাচ্চা উৎপাদন সীমিত থাকায় এসব আবেদন নাকচ করে দেয়া হয়। বন্ধ রয়েছে ক্রয়াদেশ নেয়াও।
এ ব্যাপারে খামারের উপপরিচালক কৃষিবিদ সফিকুর রহমান বলেন, বছরে মাত্র দুই লাখ বাচ্চা উৎপাদনের অনুমোদন রয়েছে তাদের। এর মধ্যে ১ লাখ ২৫ হাজার বাচ্চা আবার সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা ও যশোরের নিজস্ব খামারে পালনের জন্য রাখতে হয়। অবশিষ্ট ৭৫ হাজার বাচ্চা বিক্রির সুযোগ রয়েছে। অথচ বছরে বাচ্চার চাহিদা রয়েছে ৩৬ লাখের বেশি। বর্তমান উৎপাদন দিয়ে একদিনের মুরগির বাচ্চার চাহিদার ৩ দশমিক ১৪ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। সক্ষমতা না থাকায় মুরগির বাচ্চার চাহিদার আবেদন বন্ধ রাখা হয়েছে। আমাদের এখানে বছরে সরকারের ব্যয় হচ্ছে ১ কোটি টাকা। আয় হচ্ছে ৭০ লাখের মতো।
খামারটিতে ডিম পাড়া আড়াই হাজার মুরগি পালন ও দুই লাখ বাচ্চা উৎপাদনের জন্য সরকারি বাজেট বরাদ্দ রয়েছে বলে জানান এ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ডিম ফোটানোর আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকলেও মুরগি রাখার ঘরসহ অন্যান্য অবকাঠামো অতি পুরনো। এজন্য আমরা ২৭ কোটি টাকার বরাদ্দ চেয়েছি। এটি পাওয়া গেলে উন্নত খামার হিসেবে এটিকে প্রতিষ্ঠা করা যাবে। তাছাড়া ২৮ জন জনবলের বিপরীতে রয়েছেন মাত্র সাতজন। কোনো রকমে কাজ চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। খামারটি পূর্ণভাবে চালু করা সম্ভব হলে বছরে ৪০ লাখ ৩২ হাজার মুরগির বাচ্চা উৎপাদন হবে।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ প্রতিষ্ঠানে যে সামান্যসংখ্যক বাচ্চা উৎপাদন হয়, এর বেশির ভাগ আবার চলে যায় কালোবাজারে। ১২ টাকা দামের একদিনের মুরগির বাচ্চা দ্বিগুণ দামে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কিনতে হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ঝিকরগাছা উপজেলার উদ্যোক্তা আবিদুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, সরকারি খামারের ফাউমি জাতের মুরগির বাচ্চা নেয়ার জন্য গত বছর আবেদন করেছি। কিন্তু এখনো সেই বাচ্চা হাতে পাইনি। ১২ টাকা দামের মুরগির বাচ্চা ২২-২৪ টাকা দামে কিনতে হয়েছে।