ড্রেজার দিয়ে অবাধে বালি তুলছে প্রভাবশালীরা

ভোলায় মেঘনা-তেঁতুলিয়ার ভাঙনে দিশেহারা নদীতীরের মানুষ

বণিক বার্তা প্রতিনিধি, ভোলা

ভোলা সদরের রাজাপুর ইউনিয়নের জোড়াখাল এলাকায় মেঘনার ভাঙন ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

ভোলায় অবাধে বালি উত্তোলনের কারণে মেঘনা তেঁতুলিয়া নদীতে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। প্রতি বছরই ভাঙনের কবল থেকে ভোলাবাসীকে রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মাধ্যমে বেড়িবাঁধ, ব্লকবাঁধ, জিওব্যাগ, বালির বস্তা ফেলাসহ করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের কাজ। পাঁচ বছরে পাউবোর ডিভিশন- ডিভিশন--এর মাধ্যমে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বেড়িবাঁধ, সিসি ব্লক, জিও ব্যাগ, বালির বস্তা ফেলাসহ প্রায় হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের কাজ হয়েছে। এখনো প্রায় হাজার ৭০০ কোটি টাকার কাজ মন্ত্রণালয়ে রয়েছে অনুমোদনের অপেক্ষায়। অথচ এত টাকা ব্যয় করেও ঠেকানো যাচ্ছে না ভাঙন।

স্থানীয়রা বলছে, একদিকে বাঁধ নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে কোটি কোটি টাকা, অন্যদিকে বাঁধের কাছে নদী থেকে অবাধে বালি তোলা হচ্ছে। এতে হুমকির মুখে পড়ছে বেড়িবাঁধসহ নদীতীরের বিভিন্ন স্থাপনা।

ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা ইউনিয়নের বাসিন্দা ওমর ফরুক বলেন, প্রতিদিন মেঘনার তীরসংলগ্ন স্থান থেকে প্রভাবশালী বিভিন্ন মহল ড্রেজার দিয়ে বালি উত্তোলন করছে। আনোয়ার হোসেন নামের পাউবোর এক ঠিকাদার বলেন, গত বছর পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে আমিসহ বিভিন্ন ঠিকাদার ইলিশাকে ভাঙন থেকে রক্ষায় প্রায় ৫০০ কোটির টাকার সিসি ব্লকের কাজ করেছি। শুধু নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালি উত্তোলনের ফলে কোটি কোটি টাকা ব্লক আজ হুমকির মুখে। অধিকাংশ স্থানেই ব্লক দেবে যাওয়ার পাশাপাশি কয়েকটি স্থানে ব্লক ধসে ভেঙে গেছে বেড়িবাঁধ। তাছাড়া নতুন নতুন এলাকায়ও দেখা দিয়েছে ভাঙন।

এদিকে দীর্ঘদিন ধরে নদী থেকে বালি উত্তোলনের ফলে ইলিশা ব্লকবাঁধের পাশেই বর্তমানে ভোলা সদরের রাজাপুর ইউনিয়নে দেখা দিয়েছে ভাঙন। তীব্র স্রোতের তোড়ে ভেঙে পড়ছে নদীতীর। রাজাপুর ইউনিয়নের জোড়খাল পয়েন্ট থেকে চর মোহাম্মদ আলী পয়েন্ট পর্যন্ত চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে চলছে ভাঙন। এরই মধ্যে সেখানে সাড়ে ৭০০ মিটার এলাকা বিলীন হয়ে গেছে। প্রায় ৫০টি বসতঘর নদীতে চলে গেছে। অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে শতাধিক ঘরবাড়ি। এখনো ঝুঁকির মুখে বড় দুটি মসজিদ, দুটি স্কুলসহ বিভিন্ন স্থাপনা।

স্থানীয়রা বলছে, ভোলার বিভিন্ন স্থানে নদীভাঙন দেখা গেলেও রাজাপুরের জোড়খাল এলাকায় তেমন ভাঙন ছিল না। কয়েক মাস ধরে প্রভাবশালীরা নদীতীরসংলগ্ন এলাকায় দিনরাত সমান তালে বালি কাটছে। এতে পুরো এলাকা ভাঙন ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

জোড়খাল এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত রুব্বান রওশন বিবি বলেন, আমরা গরিব, নতুন ঘর তোলার সামর্থ্য নেই। নদী বসতভিটা কেড়ে নিছে, এখন কোথায় যাব?

. রশিদ . হাই বলেন, কয়েক দিনের ভাঙনে নদীপারের অনেক ঘর বিলীন হয়ে গেছে। এখন খোলা আকাশের নিচে আছি।

অন্যদিকে চর মোহাম্মদ আলী পয়েন্টে ভাঙনের মুখে দিশেহারা সেখানকার বাসিন্দারা। ভাঙনে অন্তত অর্ধশতাধিক ঘর বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া বসতভিটা, ফসলি জমি রাস্তাঘাট ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে মেঘনা।

রাজাপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, যেভাবে ভাঙন চলছে, তাতে পুরো ইউনিয়ন বিলীন হয়ে যেতে পারে। এমনকি শহর রক্ষাবাঁধও ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এর পেছনে একটাই কারণ নদী থেকে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন। ভোলা ভাঙনকবলিত এলাকা হওয়ায় জেলার কোনো স্থানে নেই বালুমহল। এমনকি বালি উত্তোলনের জন্য কোনো জায়গা ইজারাও দেয়া হয়নি। অথচ জেলার অধিকাংশ স্থানেই নদী থেকে অবাধে বালি উত্তোলন করছে প্রভাবশালীরা।

তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তারা বলছেন, নদীর গতিপথ পরিবর্তন, তীব্র স্রোত, উজানের পানি বেড়ে যাওয়া ডুবোচরের কারণে ভাঙন বেড়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালি উত্তোলন কার্যক্রম। তবে ভাঙনরোধে জরুরি ভিত্তিতে ৪৮০ মিটার এলাকায় জিও ব্যাগ (বালিভর্তি বিশেষ ব্যাগ) টিউব ফেলার চেষ্টা করছেন তারা।

বিষয়ে ভোলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, নদীতে স্রোত আগের চেয়ে অনেক বেশি। কারণে ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। তবে ভাঙন রোধে জরুরি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। জোড়খাল পয়েন্টে ২০০ মিটার এবং চর মোহাম্মদ আলী পয়েন্টের ২৮০ মিটার এলাকায় জিও ব্যাগ টিউব ফেলা হচ্ছে। দুটি পয়েন্টে প্রায় ৭৬ লাখ টাকার কাজ চলছে। পরে চার কিলোমিটার এলাকায় নদীতীর সংরক্ষণকাজ শুরু হবে।

এরই মধ্যে মেঘনা থেকে বালি উত্তোলন বন্ধ করার পাশাপাশি চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা জানালেন ভোলা জেলা প্রশাসক মো. তৌফিক--লাহী চৌধুরী। তিনি বলেন, মেঘনা তেঁতুলিয়া নদী থেকে বালি উত্তোলন বন্ধে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারি রয়েছে। এরই মধ্যে আমরা বেশ কয়েকটি স্থানে বালি উত্তোলন কার্যক্রম বন্ধ করার পাশাপাশি কয়েকটি ড্রেজার বাল্কহেট আটক করতে সক্ষম হয়েছি। চক্রটির বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন