অভিমত

ইসলামী শেয়ারের বিবেচ্য মানদণ্ড

ড. মুহাম্মদ ছফিউল্লাহ

পুঁজিবাজার একটি দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি মূলধনের অন্যতম উৎস। এর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি মূলধন সংগ্রহ করে সরকার, সরকারি প্রতিষ্ঠান, আর্থিক (ব্যাংক এবং নন-ব্যাংক) প্রতিষ্ঠান এবং সব খাতের কোম্পানিগুলো। পুঁজিবাজারে বেশির ভাগ বিনিয়োগ করেন দেশী বিদেশী সাধারণ (ক্ষুদ্র) এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগ করা হয় সাধারণত সরকার কর্তৃক ইস্যুকৃত বন্ড  অথবা তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ার অথবা বন্ড ক্রয় করার মাধ্যমে।

বিনিয়োগকারীরা সরাসরি কোম্পানিকে টাকা প্রদান করার মাধ্যমে প্রাথমিক শেয়ারে বিনিয়োগ করতে পারেন। কোম্পানির মালিক হিসেবে তারা লভ্যাংশ পাবেন যদি তাদের কোম্পানি মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হন। আবার লোকসানের ভাগীদার হবেন যদি কোম্পানি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও মুনাফা অর্জন করতে না পারে। শেয়ারবাজার বা মাধ্যমিক বাজারের মাধ্যমেও অন্য বিনিয়োগকারী থেকে শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে কোম্পানির মালিকানা অর্জন করতে পারেন। সেখানে শেয়ারের দাম বৃদ্ধি হলে বিক্রয়পূর্বক মুনাফা অর্জন করতে পারেন। বিক্রি না করে বছরান্তে লভ্যাংশও ভোগ করতে পারেন। দীর্ঘমেয়াদি এবং অবমূল্যায়িত শেয়ারে বিনিয়োগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লাভজনক। লাভ অথবা লোকসানের ঝুঁকি নিয়েই শেয়ারে বিনিয়োগ করতে হয়। তবে লোকসানের ঝুঁকি না নিতে চাইলে অথবা নির্দিষ্ট লাভ করতে চাইলে বন্ডের বিনিয়োগ হলো বিকল্প উপায়। বন্ডের বিনিয়োগে কোম্পানিকে ঋণ দেয়া হয়, তাই মালিকানা অর্জন করা যায় না। সাধারণ নিয়মনীতিগুলো বিনিয়োগকারীর ধর্ম, সামাজিক মর্যাদা, আর্থিক অবস্থা যা- হোক না কেন সমানভাবে প্রযোজ্য।  

এখন প্রশ্ন হলো ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা কি শেয়ারে বিনিয়োগ করতে পারবেন? শেয়ারে বিনিয়োগ করতে হলে ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের প্রথমে বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে কোম্পানি ইসলামী কোম্পানি হওয়ার মাপকাঠি পরিপূর্ণ করে কিনা। বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো বিশ্লেষণ করে ইসলামী শেয়ার ইনডেক্স (সূচক) করে থাকে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, এমন চারটি বহুল প্রচলিত ইসলামী শেয়ার ইনডেক্স হচ্ছে ডাও জোনস ইসলামী মার্কেট ওয়ার্ল্ড ইনডেক্স (ডিজেআইএম), এসঅ্যান্ডপি শরিয়াহ ইনডেক্সফাইন্যান্সিয়াল টাইমস স্টক এক্সচেঞ্জ (এফটিএসই) ইসলামী সূচক এবং মরগান স্ট্যানলি ক্যাপিটাল আন্তর্জাতিক (এমএসসিআই) ইসলামী সূচক। চারটি প্রতিষ্ঠান অনুসারে ইসলামী কোম্পানি বা ইসলামী শেয়ার হওয়ার জন্য তিনটি মানদণ্ড পূরণ করতে হয়।

মানদণ্ড এক: গুণগত মূল্যায়ন। যে কোম্পানি তামাক, মাদক, ওষুধ, অ্যালকোহলযুক্ত পানীয়, জুয়া, শূকরের পণ্য, প্রাপ্তবয়স্কদের বিনোদন, মানবক্ষতিকর অস্ত্র শিল্প এবং এমন কোনো পণ্য উৎপাদন করে, যা সমাজ পরিবেশের ক্ষতিসাধন করে, সেই কোম্পানি অথবা কোম্পানিগুলো ইসলামী কোম্পানি হিসেবে পরিগণিত নয়। মানদণ্ড দুই: আর্থিক অনুপাত বিশ্লেষণ। ধাপে তিনটি আর্থিক অনুপাত বিশ্লেষণ করতে হয়। এক. মোট সুদভিত্তিক ঋণ এবং মোট বাজার মূলধন অনুপাত; দুই, নগদ এবং স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ বাজার মূলধনের অনুপাত; তিন, মোট দেনাদার এবং বাজার মূলধনের অনুপাত। তিনটি অনুপাতের প্রত্যেকটি ৩৩ শতাংশের কম হতে হয়। এসব অনুপাত নির্ণয়ে এফটিএসই এমএসসিআই বাজার মূলধনের পরিবর্তে মোট সম্পদ ব্যবহার করে। আবার এফটিএসই এবং এনঅ্যান্ডপি অনুসারে তৃতীয় অনুপাত যথাক্রমে ৫০ ৪৯ শতাংশের কম হতে হয়। মানদণ্ড তিন, ইসলাম অনুমোদন করে না এমন উৎস থেকে আয়ের পরিমাণ শতাংশের কম হতে হয়। তাদের পদ্ধতি অনুসারে উপরে বর্ণিত তিনটি মানদণ্ড পূরণ করতে সক্ষম কোম্পানিগুলো ইসলামী কোম্পানি এবং তাদের শেয়ার ইসলামী শেয়ার হিসেবে গণ্য হবে।

ইসলামী কোম্পানি হওয়ার জন্য যে তিনটি মানদণ্ড পূরণ করতে হয়, তার প্রথমটি অর্থাৎ গুণগত মূল্যায়ন নিয়ে সব ইসলামী শরিয়াহ ইসলামী ফাইন্যান্স বিশেষজ্ঞ একমত। তবে কিছুটা মতামতের ভিন্নতা আছে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় মানদণ্ডগুলো নিয়ে, যেগুলো আর্থিক অনুপাত বিশ্লেষণের সঙ্গে সম্পর্কিত। যেমন AAOIFI (The Accounting and Auditing Organization for Islamic Financial Institutions) অনুসারে একটি ইসলামী কোম্পানি নির্ণয় করার জন্য, সুদভিত্তিক ঋণ স্তরের প্রান্তিকতা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হয় এবং কোনো ধরনের নির্ধারিত তারল্য অনুপাত প্রয়োজন হয় না। আবার মালয়েশিয়ার সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এমএসইসি) শরিয়াহ উপদেষ্টা কাউন্সিল (এসএসি) অনুসারে কোনো আর্থিক অনুপাত বিশ্লেষণ দরকার হয় না। শুধু ইসলাম অনুমোদন করে না, এমন উৎস থেকে আয়ের পরিমাণ সহনশীল পর্যায়ে ( থেকে ২৫ শতাংশ) থাকলে ইসলামী কোম্পানি এবং তাদের শেয়ার ইসলামী শেয়ার হিসেবে গণ্য হবে। 

উল্লেখ্য, দ্বিতীয় তৃতীয় মানদণ্ডগুলো নিয়ে ভিন্নতা, শরিয়াহর ভিন্নতা নয়, বরং শরিয়াহ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ইসলামী ফাইন্যান্স নিয়ে ইন্টারপ্রিটেশন বা ব্যাখ্যা সম্পর্কিত ভিন্নতা। তবে দ্বিতীয় তৃতীয় মানদণ্ডগুলোর মধ্যে শরিয়াহ বা ইসলাম ধর্মভিত্তিক সমর্থনের অভাব আছে, ঐকমত্যের অভাব আছে এবং আরো আছে অভ্যন্তরীণ অসংগতি। যেমন ৩৩ অথবা ৩০ শতাংশ সুদভিত্তিক ঋণ এবং শতাংশ ইসলাম অননুমোদিত উৎস থেকে আয়ের যে প্রান্তিকতা নির্ধারণ করা হয়েছে তা খাঁটি (অথেনটিক) হাদিস দ্বারা সমর্থিত নয়, আল  কোরআনেও সমর্থিত নয়। আবার একদিকে ৩৩ শতাংশের কম সুদভিত্তিক ঋণ সমর্থন, অন্যদিকে শতাংশের কম ইসলাম অননুমোদিত উৎস থেকে আয়ের সমর্থন মানদণ্ডগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ অসংগতির উদাহরণ।

পরবর্তী প্রশ্ন তাহলে আসবে একটা প্রকৃত ইসলামী কোম্পানি বা ইসলামী শেয়ারের বৈশিষ্ট্য কী হবেতার উত্তর: () একটি কোম্পানি উপরে বর্ণিত মানদণ্ড এক সম্পূর্ণভাবে পূরণ করে। () কোম্পানির সুদভিত্তিক ঋণ এবং বাজার মূলধন অথবা মোট সম্পদের অনুপাত শূন্য হয়, অর্থাৎ কোম্পানি কোনো ধরনের সুদভিত্তিক ব্যাংক অথবা  নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে না। তাদের ব্যবসার মূলধন আসে উদ্যোক্তাশেয়ারহোল্ডার এবং ইসলামী ব্যাংক অথবা ইসলামী নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। পরিশেষে (ইসলাম অনুমোদন করে না এমন উৎস থেকে আয়ের পরিমাণ শূন্য হয়। 

মানদণ্ড পূরণ করতে সক্ষম কোম্পানিগুলো ইসলামী কোম্পানি এবং তাদের শেয়ার ইসলামী শেয়ার হিসেবে গণ্য হবে। ইসলামী শরিয়াহ ইসলামী ফাইন্যান্স বিশেষজ্ঞরা এসব কোম্পানিতে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করার সুপারিশ করেন। পাশাপাশি শরিয়াহ অনুযায়ী পরিচালিত ইসলামী ব্যাংক ইসলামী নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে এবং ইসলামী বন্ডেও (সুকুক) বিনিয়োগ সুপারিশ করেন। মানদণ্ড এবং বিনিয়োগ সুপারিশ প্রাথমিক বাজার মাধ্যমিক বাজারের শেয়ারে বিনিয়োগের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সুদভিত্তিক ঋণের পরিমাণ শূন্য, ইসলাম অনূমোদন করে না এমন উৎস থেকে আয়ের পরিমাণ শূন্য এবং মানুষ, সমাজ পরিবেশের ক্ষতিকারক পণ্য উৎপাদন না করাই হলো ইসলামী শরিয়াহর মানদণ্ড।

 

. মুহাম্মদ ছফিউল্লাহ: শিক্ষক রিসার্চ সেমিনার কো-অর্ডিনেটর, লা ট্রোব বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া; ইসলামী ব্যাংকিং ইসলামী ফাইন্যান্স বিষয়ের গবেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন