উচ্চমূল্যের কারণে বাড়ছে না বিদ্যুতের ব্যবহার

ব্যবহার বাড়ানো না গেলে বাড়তি উৎপাদন সক্ষমতা বোঝায় পরিণত হবে

দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে। রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টায় উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু সক্ষমতার সঙ্গে চাহিদার বিস্তর ফারাক বিরাজমান। বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনার প্রাক্কলন বলছে, চলতি বছরের শুরুতে বিদ্যুতের চাহিদা ১৭ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হবে। বাস্তবে সেটি -১২ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে সীমিত থাকছে। এটা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে জনপরিসরে আলোচনা চলছে। সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে প্রতিবেদন। সম্প্রতি বণিক বার্তায়ও একটা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। তাতে বিদ্যুৎ খাতে চাহিদাজনিত ভারসাম্যহীনতার চিত্রটি নতুন করে সামনে এসেছে। ব্যবহার বাড়ানো না গেলে বাড়তি উৎপাদন সক্ষমতা ভবিষ্যতে বোঝায় পরিণত হবে বৈকি। কাজেই উল্লিখিত সংকট নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।

অর্থনৈতিক পরিধি বড় হওয়ার সম্ভাবনাকে সামনে রেখে দেশে নতুন অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। কয়েক দফায় বাড়ানো হয়েছে রেন্টাল কুইক রেন্টালের মেয়াদ। স্বভাবত বেড়েছে উৎপাদন সক্ষমতা। অথচ তার সঙ্গে সংগতি রেখে বাড়ছে না বিদ্যুতের ব্যবহার। এক্ষেত্রে কয়েকটি ফ্যাক্টর দায়ী। একে তো সঞ্চালন ব্যবস্থায় দুর্বলতা রয়ে গেছে। অপরিকল্পিত বিচ্ছিন্নভাবে অনেক বিনিয়োগ করা হলেও দেশে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি একটি টেকসই সঞ্চালন ব্যবস্থা। ফলে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ এখনো বেশ চ্যালেঞ্জিং। তদুপরি রয়েছে বাড়তি খরচের চাপ। আমদানি উচ্চব্যয়ের জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর অদূরদর্শী পরিকল্পনার খড়্গ চেপেছে গ্রাহক শিল্প মালিকদের কাঁধে। উৎপাদকদের কাছ থেকে উচ্চদামে সরকারের বিদ্যুৎ ক্রয় এবং লোকসান পোষাতে দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির চাপে গ্রাহক-শিল্পোদ্যোক্তারা রীতিমতো বিপর্যস্ত। উচ্চমূল্যের কারণে গ্রাহক বিদ্যুতের ব্যবহার যথাসম্ভব সীমিত রাখছেন। আর শিল্পোদ্যোক্তারা এখনো নির্ভর করছেন ক্যাপটিভ বিদ্যুতের ওপর; পারতপক্ষে জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত হতে চাইছেন না। এতে দেশ ভুগছে একদিকে অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা, অন্যদিকে চাহিদাজনিত ভাটার সংকটে। থেকে পরিত্রাণে একটি শিল্প গ্রাহকবান্ধব মূল্যনীতি প্রবর্তনের বিকল্প নেই।

বিদ্যুৎ আধুনিক জীবনের অত্যাবশ্যকীয় উপযোগ। শিল্প অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। সেদিক থেকে এটি একটি নিত্যব্যবহার্য গুরুত্বপূর্ণ জনস্বার্থগত ইস্যু বৈকি। সেজন্য প্রায় প্রতিটি দেশেই বিদ্যুতের দাম জনসাধারণের আর্থিক সাধ্যের মধ্যে রাখা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইডেন, ফ্রান্স, জার্মানিসহ পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোয় আমাদের তুলনায় বিদ্যুতের দাম কম। তারা এটা নিশ্চিত করেছে একটি গ্রাহক শিল্পবান্ধব মূল্যনীতি গ্রহণের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে তারা বিবেচনায় নিয়েছে গ্রাহক পর্যায়ে ভর্তুকি, শিল্প উৎপাদনে মৌসুমভিত্তিক প্রণোদনা, সামাজিক কল্যাণ, অর্থনৈতিক সুফল এবং ব্যক্তির আয়ের মতো বিষয়গুলো। বেশি দূরে যেতে হবে না। এশিয়ার উন্নত অর্থনীতি দক্ষিণ কোরিয়ায়ও ব্যক্তির আয়শ্রেণীর ভিত্তিতে বিদ্যুতের মূল্যহার নির্ধারণ করা হয় বলে খবর মিলছে। ফলে সেখানে একদিকে শিল্প উৎপাদনে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা যেমন বজায় থাকছে, তেমনি গ্রাহককেও বাড়তি আর্থিক চাপের মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। কাজেই উল্লিখিত দেশগুলোর নীতি অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য অনুসরণীয়।

বিশ্বে কয়েক ধরনের মূল্যহার নির্ধারণ মডেলের চল থাকলেও দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশের বিদ্যুৎ খাতে টাইম অব ইউজ ((টিওইউ) মূল্যনীতিরই প্রাধান্য। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এখানে বিশ্বব্যাংক আইএমএফের নির্দেশনায় ধরনের ব্যবহারনির্ভর ট্যারিফ ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে। মডেলে ব্যবহার যত বেশি হবে, ব্যয় হবে ততধিক। তার ওপর দফায় দফায় দাম বাড়ানোর কারণে বিদ্যমান ব্যবস্থায় গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ ব্যবহারে ব্যয় বেড়েছে আরো বেশি। যার কারণে গৃহস্থালি থেকে শিল্প গ্রাহক সবাই হিসাবি ভূমিকায় অবতীর্ণ। ফলে বাড়ছে না বিদ্যুতের ব্যবহার। প্রেক্ষাপটে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়াতে বিশেষজ্ঞরা গ্রাহক পর্যায়ে ভর্তুকির কথা বলছেন। ট্যারিফ নীতির সংস্কারের কথা বলছেন। এটা আমলে নেয়া যেতে পারে।

বিদ্যুৎ খাতে এখনো বিপুল রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু তার সুফল যাচ্ছে বেসরকারি বিদ্যুৎ উদ্যোক্তাদের পকেটে। অসম চুক্তির কারণে অলস বসিয়ে রেখেও ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ বড় অংকের অর্থ দিতে হচ্ছে তাদের। এতে একদিকে বিদ্যুৎ খাতের লোকসান বাড়ছে, অন্যদিকে গ্রাহকও এর সুফল থেকে বঞ্চিত। কাজেই তার পরিবর্তে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের ব্যয় যদি কম রাখা যেত, তাহলে ফল হতো উল্টো। মূল্য সহনীয় রাখা হলে আপনাআপনিই গ্রাহক বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াত। শিল্পোৎপাদন অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য আরো বেগবান হতো। এর সামাজিক অর্থনৈতিক প্রভাব হতো গুণিতক। তখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের উল্লেখযোগ্য সক্ষমতা অব্যবহূত থাকত না। আজকের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অর্জনের পেছনে বিপুল রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ হয়েছে। কিন্তু তার একটি বড় অংশ অব্যবহূত থাকায় এর কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক সুফল মিলছে না। এটিও ভেবে দেখা জরুরি। বর্তমানে ক্যাপটিভ বিদ্যুতে প্রতি ইউনিটের গড়ে দাম পড়ছে সাড়ে টাকা। আর জাতীয় গ্রিডের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ছে থেকে সাড়ে টাকা। জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ নিলে শিল্প উৎপাদনে খরচ পড়বে বেশি। ফলে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে। এছাড়া নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের নিশ্চয়তা নেই। সব দিক  বিবেচনায় জাতীয় গ্রিড থেকে তাই বিদ্যুৎ নেয়া শিল্প খাতের জন্য মোটেই প্রতিযোগিতামূলক নয়। শুধু শিল্প নয়, ব্যক্তি গ্রাহকের জন্যও বিদ্যুতের বর্তমান মূল্যহার বাড়তি বোঝাস্বরূপ। সুতরাং বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বিদ্যমান ট্যারিফ নীতিমালায় সংস্কার এখন সময়ের দাবি।

বিদ্যুতের দাম বিচ্ছিন্ন কোনো ইস্যু নয়। এটি দেশের জ্বালানি পরিকল্পনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। আগে বিদ্যুতের প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রাধান্য থাকলেও দৃশ্যপট অনেকটা পাল্টেছে। প্রাকৃতিক গ্যাসের অপ্রতুলতায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখন সরকার ঝুঁকছে আমদানিনির্ভর জ্বালানিতে। আন্তর্জাতিক বাজারের উদ্বায়িতাসহ নানা বহিস্থ ফ্যাক্টরে ওইসব জ্বালানির সরবরাহ আমাদের সাধ্যের মধ্যে থাকছে না। জ্বালানি আমদানিতে খরচ পড়ছে বেশি। তার পরোক্ষ চাপটা গিয়ে পড়ছে গ্রাহকের ওপর। ক্রমেই বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুতের দাম। বিশেষজ্ঞরা অনেক আগে থেকে জ্বালানি রূপান্তর তথা নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো এবং দেশীয় উৎসের জীবাশ্ম জ্বালানির অনুসন্ধান কার্যক্রমের ওপর জোর দিলেও তাতে অগ্রগতি সামান্য। বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশীয় উৎসের জ্বালানি কাজে লাগানো না গেলে ভর্তুকি দিয়েও বিদ্যুতের দাম কমিয়ে রাখা সম্ভব নয়। প্রাথমিক জ্বালানির প্রাপ্যতা বিদ্যুতের মূল্যনীতিকে বরাবরই প্রভাবিত করে। তাই দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিকল্প নেই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন