সুইজারল্যান্ডে পুঁজিবাজার নিয়ে সম্মেলনে বক্তারা

দেরি হওয়ার আগেই বিনিয়োগ করুন বাংলাদেশে

মেহেদী হাসান রাহাত, সুইজারল্যান্ড থেকে

সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের জুরিখ জেনেভায় বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ আকর্ষণে রোড শোর আয়োজন করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) জেনেভায় সম্মেলনের শেষ দিনে বক্তারা দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন।

দেশের পুঁজিবাজারকে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে তুলে ধরতে বিশ্বের অন্যতম প্রধান আর্থিক কেন্দ্রগুলোতে ধারাবাহিক রোড শোর আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি। এরই মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে রোড শো সম্পন্ন করেছে বিএসইসি। তৃতীয় দেশ হিসেবে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ জেনেভায় রোড শোর আয়োজন করে কমিশন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান জাভেদ বলেন, কভিডের আগে আমাদের অর্থনীতির ভালোই শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছিল। তবে মহামারীর কারণে এর স্বাভাবিত গতি বিঘ্নিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও আমাদের ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বর্তমানে আমরা যে প্রবৃদ্ধি দেখছি এতে বেসরকারি খাতের অবদান রয়েছে। কভিড-১৯-এর কারণে কখন লকডাউন দিতে হবে, আবার জীবন-জীবিকার তাগিদে কখন সেটি তুলে নিতে হবে, সে বিষয়ে আমরা ভারসাম্য বজায় রাখতে পেরেছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দক্ষ নেতৃত্বের কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। বর্তমান সময় হচ্ছে এশিয়ার। আমাদের প্রবৃদ্ধির মূলে রয়েছে কৃষি খাত। যদিও স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে আমাদের শিল্পায়নের দিকে ঝুঁকতেই হবে। পুঁজিবাজারকেও বিকশিত হতে হবে। আমাদের এখানে স্যামসাংয়ের মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। তাই আমি বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশ থেকে ঘুরে যাওয়ার আহ্বান জানাব। এজন্য এখনই তাদের বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে না। তবে দেরি হওয়ার আগেই তাদের বিনিয়োগে এগিয়ে আসা উচিত বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে বিএসইসির সাবেক কমিশনার শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান আরিফ খান বলেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার লুক্কায়িত রত্ন। দারিদ্র্যের হার, নারী কর্মসংস্থান, গড় আয়ু সাক্ষরতার হার সব সূচকেই এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পাট রফতানি করে বাংলাদেশ। এছাড়া দেশটি দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রফতানিকারক। সবজি উৎপাদনের দিক দিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। মাছ চাল উৎপাদনের দিক দিয়ে চতুর্থ স্থানে রয়েছে দেশটি। রেমিট্যান্স, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঋণের দিক দিয়েও প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় ভালো অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের পুঁজিবাজার আকারে ছোট হলেও এর বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার তার বক্তব্যে বলেন, কভিডের সময় মাত্র আটটি দেশ ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছে, যার মধ্যে বাংলাদেশও অন্যতম। এর মধ্যে আবার বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি হয়েছে। এর মানে হচ্ছে আমরা মহামারী পরিস্থিতিকে ভালোভাবে মোকাবেলা করতে পেরেছি। বাজেট ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির শতাংশের মধ্যে রাখতে সক্ষম হয়েছিলাম আমরা। বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য সুইজারল্যান্ডের কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. নজরুল ইসলাম জানান, বর্তমানে ইপিজেডে ৪৬০টি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। জাতীয় রফতানির ১৭ দশমিক ১৪ শতাংশই আসে ইপিজেডের প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। গত বছর প্রতিষ্ঠানগুলো দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলারের রফতানি করেছে। এখানে মোট দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ রয়েছে। ইপিজেডের প্রতিষ্ঠানগুলোতে লাখ ৬৭ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, যার ৬৭ শতাংশই নারী। এখানে ইউরোপীয় অন্যান্য মিলিয়ে ৩৮টি দেশের প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ রয়েছে।

সময় তিনি ইপিজেডে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক -আর্থিক সুবিধার বিষয়টি তুলে ধরেন।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য (করনীতি) মো. আলমগীর হোসেন স্বাধীনতার পর থেকে পর্যন্ত প্রত্যক্ষ করের পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ ছিল ৯০ দশমিক ২৮ শতাংশ, যা সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসে ৬৪ দশমিক শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মূলধনি মুনাফার ক্ষেত্রে বিভিন্ন করছাড়ের সুবিধার বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের কাছে তুলে ধরেন তিনি।

বিএসইসির কমিশনার অধ্যাপক . শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ তার বক্তব্যে বিদেশী অনিবাসী বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের প্রক্রিয়াসহ সুরক্ষার দিকটি তুলে ধরেন।

সুইজারল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান একোমার প্রধান নির্বাহী বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করছে বলে জানান।

তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সিনিয়র সচিব এনএম জিয়াউল আলম বলেন, বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে অন্যান্য উদীয়মান বাজারের তুলনায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে আছে। বাংলাদেশ হাই-টেক পার্কে সম্পন্ন হওয়া আটটি প্রকল্পে এখন পর্যন্ত সরকার ৯৫০ কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ করেছে। হাই-টেক পার্কে ৫৭০ কোটি টাকারও বেশি বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ প্রত্যাশা করছে সরকার। পর্যন্ত পার্ক কর্তৃপক্ষ প্রায় ৪৫ কোটি টাকার রাজস্ব আয় করেছে। ২০২৫ সালের মধ্যে হাজার কোটি টাকারও বেশি বেসরকারি বিনিয়োগ আসবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। দেশে বর্তমানে স্বনামধন্য বেশকিছু বৈশ্বিক ব্র্যান্ড তাদের পণ্য উৎপাদন করছে।

সুইজারল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জেনেভায় অবস্থিত জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের প্রধান মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে এবং অর্থনীতি ভালো অবস্থানে রয়েছে। দেশকে উন্নত করতে আমাদের অনেক বেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। বর্তমানে ব্যবসা করার জন্য বাংলাদেশ আদর্শ স্থান। পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক সংস্কারের ফলে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরো বাড়বে। আমি আশা করছি, সুইজারল্যান্ডের স্থানীয় অনিবাসী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন।

বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম সমাপনী বক্তব্যে বলেন, অতীতেও বাংলাদেশের প্রতি বিদেশীদের আকর্ষণ ছিল। পাট, তুলা, মসলা মসলিনের মতো পণ্য এখান থেকে বিনিয়োগ হতো। অনুষ্ঠানে এতসংখ্যক সরকারি কর্মকর্তা আসার কারণ হচ্ছে তারা সবাই বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানাতে চান। স্বাধীনতার পর থেকে সুইজারল্যান্ড আমাদের পরিক্ষীত বন্ধু। ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য অর্জনে বন্ধুপ্রতিম সুইজারল্যান্ডকে পাশে পাব বলে আশা করছি।

অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে সমবায় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হারুন-অর-রশিদ বিশ্বাস, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মফিজ উদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) প্রেসিডেন্ট শেখ কবির হোসেন, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবুল হোসেনসহ কমিশনের কর্মকর্তা বিনিয়োগকারীরা উপস্থিত ছিলেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন