ভুল মূল্যনীতির কারণে বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ছে না

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের অর্থনীতির কলেবর বাড়লেও সে মাত্রায় বাড়েনি বিদ্যুতের ব্যবহার। চলতি বছরের শুরুতে বিদ্যুতের চাহিদা ১৭ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশিতে উন্নীত হবে বলে বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনায় প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল। চাহিদা এখনো অর্জন করা সম্ভব হয়নি। এখন পর্যন্ত পিক-আওয়ারেই তা অর্জন করা গিয়েছে ১২ হাজার মেগাওয়াটের মতো। অফপিক-আওয়ারে তা নেমে আসে সাড়ে হাজারের কাছাকাছি। উচ্চমূল্যের কারণে বিদ্যুৎ ব্যবহারে হিসেবী আচরণ করছেন ভোক্তারা। একই কারণে শিল্প মালিকরাও এখন জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ নিতে আগ্রহী নন। প্রতিযোগী সক্ষমতা হারানোর আশঙ্কায় ক্যাপটিভ বিদ্যুতেই বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠেছেন তারা। বিষয়টিকে সামনে এনে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভ্রান্ত মূল্যনীতির কারণেই দেশে বিদ্যুতের চাহিদা কাঙ্খিত মাত্রায় বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না।

এশিয়ার অনেক দেশই এখন মূল্যনীতির ভ্রান্তিজনিত সমস্যায় ভুগছে। দক্ষিণ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এখন বিদ্যুৎ খাতের ট্যারিফ সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে নতুন করে ভাবতে বসেছে। বিশেষ করে পাকিস্তানে এখন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। ভোক্তাদের হিসেবী আচরণের পাশাপাশি সঞ্চালন ব্যবস্থার দুর্বলতা বাড়তি খরচের কারণে দেশটির শিল্প মালিকরাও সেখানকার জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ নিতে আগ্রহী নন। চাহিদাজনিত অতিরিক্ত সক্ষমতার সংকটে পাকিস্তানেও বিদ্যুৎ খাত আটকে রয়েছে লোকসানের বৃত্তে। পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণে এরই মধ্যে ট্যারিফ নীতিমালায় সংস্কারের দাবি তুলেছেন দেশটির খাত সংশ্লিষ্টদের অনেকেই। তারা মনে করছেন, ব্যবহার বাড়াতে গ্রাহক পর্যায়ে ভর্তুকি সুবিধা দেয়া প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে দেশটিতে বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানো সম্ভব হবে, যার অনেক সামাজিক অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া সম্ভব।

বিভিন্ন দেশের বিদ্যুৎ খাতে কয়েক ধরনের ট্যারিফ নির্ধারণ করতে দেখা যায়। এর অন্যতম হলো গ্রাহক পর্যায়ে ভর্তুকিনির্ভর ট্যারিফ। এক্ষেত্রে গৃহস্থালী পর্যায়ের খুচরা গ্রাহকদের বিদ্যুতের মূল্য পরিশোধে ভর্তুকি দিয়ে থাকে সরকার। সামাজিক কল্যাণমুখী ট্যারিফ ব্যবস্থায় বাণিজ্যিক মুনাফার সুযোগ কম। তবে সমাজ অর্থনীতিতে এর অনেক সুফল পাওয়া যায়। এশিয়ার সমৃদ্ধ অর্থনীতি দক্ষিণ কোরিয়ায় আবাসিক খাতে বিদ্যুতের ট্যারিফ নির্ধারণ করা হয়ে থাকে গ্রাহকদের আয়ের শ্রেণীভেদে।

পাকিস্তান বাংলাদেশে মূল্য নির্ধারণের অনেকটা একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। টাইম অব ইউজভিত্তিক (টিওইউ) মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় পিক আওয়ার অফ-পিক আওয়ারের ভিত্তিতে বিদ্যুতের দাম ওঠানামা করে। এক্ষেত্রে অফ-পিক ডে আওয়ার, রাত্রীকালীন, ছুটির দিন ইত্যাদি বিষয়ও মূল্যের ওঠানামায় প্রভাব ফেলে। বর্তমানে বাংলাদেশ পাকিস্তানে বিদ্যুতের মূল্যনির্ধারণে পদ্ধতিটিই ব্যবহার করা হচ্ছে। টিওইউর পরিবর্তে গ্রাহক পর্যায়ে ভর্তুকিনির্ভর ট্যারিফ অনুসরণ করা গেলে বিদ্যুতের ভোক্তা ব্যবহার অনেকটাই বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আরেক ধরনের মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া রয়েছে, যা শিল্প খাতে প্রণোদনাকেন্দ্রীক। অগ্রসর অর্থনীতির দেশগুলোয় ধরনের ট্যারিফ নির্ধারণ করতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে শিল্প খাতে বিদ্যুতের দাম গৃহস্থালী পর্যায়ের চেয়েও কমিয়ে ধরা হয়। অল্প মূল্য ধরা হলেও শিল্প খাতে বিপূল মাত্রায় ব্যবহারের সুবাদে এখান থেকে মুনাফা পাওয়া সম্ভব বলে বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞদের মতামতে উঠে এসেছে। তারা বলছেন, বাংলাদেশের মতো দেশেও পদ্ধতি লাভজনক হতে পারে। এক্ষেত্রে শিল্প খাতে শীতকাল অফপিক আওয়ারে উৎপাদনে প্রণোদনা দেয়ার পাশাপাশি সাধারন গ্রাহক পর্যায়েও ভর্তুকি দেয়া হলে তা সার্বিকভাবে বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।

জাতীয় পর্যায়ে উৎপাদন সক্ষমতা না থাকায় এক সময় শিল্পোদ্যোক্তাদের ক্যাপটিভে ঝুঁকতে উৎসাহ দেয়া হয়েছিল। বর্তমানে সক্ষমতা তৈরি হলেও জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে শিল্প কলকারখানাগুলোকে সংযুক্ত করা যাচ্ছে না। শিল্পখাতের মালিকদের অভিযোগ, এখনও গ্রিডের বিদ্যুৎ নিরবিচ্ছিন্ন নয়। এছাড়া ট্যারিফও শিল্পবান্ধব নয়। কারখানায় উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিতের জন্য তারা ক্যাপটিভ বিদ্যুতে ঝুঁকেছেন। এর মাধ্যমে অর্ধেক খরচেই সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারছেন শিল্প মালিকরা। যদিও বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, পরিমাণ বিদ্যুৎ তাদের গ্রিড থেকে সরবরাহ করার কথা। কিন্তু ট্যারিফ নীতি শিল্পবান্ধব না হওয়ায় সেখান থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন উদ্যোক্তারা।

বিদ্যুত্চালিত গাড়ির ব্যবহার বাড়ানো গেলে সমস্যা কিছুটা হলেও লাঘব করা যেত বলে মনে করছেন অনেকে। কিন্তু শুল্ক বাধার কারণে সেটিও প্রত্যাশিতভাবে বাড়ানো সম্ভব হয়নি। ব্যবহার না বাড়ায় একদিকে বিদ্যুত খাতের লক্ষ্যগুলো অর্জন হচ্ছে না, অন্যদিকে খাতটিও লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারছে না। লোকসান সমন্বয় করতে গিয়ে দফায় দফায় দাম বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুতের। অন্যদিকে বিদ্যুৎ ব্যবহারে আরো হিসেবী হয়ে উঠছেন গ্রাহকরা। দেশে এখনো বিদ্যুতের মাথাপিছু ব্যবহার ঘণ্টায় ৬০০ কিলোওয়াটের ওপরে তোলা সম্ভব হয়নি।

ব্যবহারনির্ভর ট্যারিফ ব্যবস্থা দেশে গ্রাহক চাহিদায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দেশে অর্থনৈতিক পরিধি বড় হওয়ার সম্ভাবনাকে সামনে রেখে নতুন অনেকগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু বিদ্যুতের চাহিদা ব্যবহার সে অনুপাতে বাড়ানো যায়নি। গ্রাহক পর্যায়ে ব্যয় কমানো গেলে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুতের চাহিদা ব্যবহার বাড়তো। তখন অলস বসে থাকা বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকেও একে একে সচল করে তুলতে হতো। এর বিপরীতে জোরদার হয়ে উঠতো অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য। সব মিলিয়ে সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে দেশ আরো অনেক বেশি লাভবান হতে পারতো।

বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এজাজ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রেখে বিপূল পরিমাণে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হচ্ছে। খরচ সমন্বয় হচ্ছে বিদ্যুতের দামে। যদি সরকার গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম কমাতো, তাহলে স্বাভাবিকভাবে এর ব্যবহারও বাড়তো। আমরা যে হারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি, সে হারে ব্যবহার করতে পারছি না। পায়রার মতো বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দিচ্ছি। বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিয়ে সমন্বয় করতে হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রেও এটা বিবেচনায় নেয়া হয়।

অন্যদিকে, বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে চুক্তি অনুযায়ী সরকারের পরিশোধিত অর্থের পরিমাণও রেকর্ড ছাড়িয়েছে। গত অর্থবছরে (২০২০-২০২১) বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ১৩ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত ১০ অর্থবছরে শুধু অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকেই সরকারকে গুণতে হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে না পারায় বর্তমানে উৎপাদনে যাওয়া পায়রার মতো হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্ধেক প্রায় অলস বসে আছে। এছাড়া রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র রূপপুর পারমাণিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে গেলে সক্ষমতার মাত্রা আরো অনেকখানি বাড়বে।

দেশে বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে ট্যারিফের চেয়েও জ্বালানিতে আমদানিনির্ভরতাকে বেশি দায়ি করছেন খাতটির বেসরকারি উদ্যোক্তারা। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র কনফিডেন্স পাওয়ার রংপুর লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান ইমরান করিম বণিক বার্তাকে বলেন, ট্যারিফ পলিসির কারণে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে বিষয়টি এমন নয়। বরং আমদানিনির্ভর জ্বালানির কারণে আমাদের বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। ব্যয়ের ৬০-৭০ শতাংশই খরচ হয় জ্বালানিতে। আমদানিনির্ভর জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমরা সবচেয়ে বেশি ব্যয় করছি। অন্যদিকে শিল্প কলকারখানাগুলো বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে না, বিষয়টি এমন নয়। মূলত কারখানার উৎপাদনে নিরবিচ্ছিন্নতা মাথায় রেখেই তারা এখনও গ্রিডের বিদ্যুতে নির্ভরশীল হতে পারছে না।

সার্বিক বিষয়ে বিদ্যুতের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেশি হলেও ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রেখেই সরকার বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। এর বাইরে গ্রাহকের বিদ্যুৎ ব্যবহার বাড়ানো যায়নি তার প্রধানতম কারণ নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ। বিশেষত বিদ্যুৎ ব্যবহারের যে বড় উৎস শিল্প কলকারখানা, তাদেরকে আমরা গ্রিডের বিদ্যুতে যুক্ত করতে পারিনি। সেটি করা গেলে বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়তো।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন