দেশজুড়ে ব্রডব্যান্ড: খুলে যাচ্ছে সম্ভাবনার দুয়ার

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছেছে ইন্টারনেট সুবিধা ছবি: সংগৃহীত

বাড়িতে ইন্টারনেট সংযোগ হঠাৎ নেইকী হবে? মুহূর্তেই থমকে যাবে সন্তানের অনলাইন ক্লাস। অফিসের ফাইলগুলো হবে না আপলোড। আর মা-বাবা চাইলেও অনলাইনে ভিডিও কলে  দেখতে পাবে না দূরদেশের সন্তান স্বজনকে। ডিজিটালাইজেশনের যুগে ইন্টারনেটের গুরুত্ব নতুন করে কাউকে বোঝানোর দরকার নেই। তবে এখনো হাজারো মানুষ আজকের দিনটিতেও ইন্টারনেটের অগণিত সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক জরিপে দেখা গিয়েছে যে প্রান্তিক অঞ্চলে বসবাসরত ৫৪ শতাংশ মানুষের কাছে এখনো পৌঁছেনি ইন্টারনেটের আলো। বছর এশিয়ান প্যাসিফিক ম্যাথমেটিকস অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করা বাংলাদেশ দল থেকে যারা মেডেল পেয়েছেন, তাদের মধ্যে দুজন ঢাকার অধিবাসী এবং আরেকজন ময়মনসিংহের। দেশজুড়ে আজ ইন্টারনেট প্রযুক্তির অসমতা থাকায় অনেক প্রতিভা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

ডিজিটাল বিভাজন দূরীকরণের লক্ষ্যে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে শুরু হওয়া বহুজাতিক টেকনোলজি গ্রুপ ডটলাইনস। ২০১৬ সালে শুরু হওয়া ডটলাইনসের কার্নিভাল ইন্টারনেট আজ দেশজুড়ে বিভিন্ন গ্রামের ছয় লাখ মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সুবিধা। গত কয়েক বছরে কার্নিভাল ইন্টারনেটের সব সাফল্যের গল্পগাথার শিকড়ে ওঠে আসে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকের এক প্রচেষ্টার কাহিনী। সেই গল্পটি বাংলাদেশের গ্রামগুলোর সহজ-সরল মানুষের হাতে ইন্টারনেটের ভুবন পৌঁছে দেয়ার।


সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলায় অবস্থিত মানিক মিয়ার ছোট্ট, ছিমছাম টং দোকান। দোকানের সামনে গেলেই চোখে পড়বে কার্নিভাল পয়েন্টের ব্যানার। বছরখানেক আগে কার্নিভাল পয়েন্টের মাধ্যমে ইন্টারনেট কার্ড বিক্রি করা শুরু করেন তিনি। আস্তে আস্তে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করায় ইন্টারনেট কার্ড এখন তার উপার্জনের এক বড় উৎসেপরিণত হয়েছে। লোকজন এখন চা খেতে এসে কার্ড কিনে ঘণ্টা দুয়েক ইন্টারনেট চালায়। স্কুল শেষে শিক্ষার্থীরা তার দোকানে বসে চালাচ্ছে ইন্টারনেট, জানছে বিশ্বের নানা খবরাখবর, শিখছে নতুন অনেক কিছু। কার্ডও বিক্রি হয়, সঙ্গে দোকানের পণ্যও। তার ব্যবসার প্রসার দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে মানিক মিয়ার চাচাতো ভাইও মাস দুয়েক আগে যশোরে কার্নিভাল পয়েন্টের উদ্যোক্তা হয়েছেন।

গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের আয় বৃদ্ধি ছাড়াও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের জীবনযাত্রায়ও আসছে আমূল পরিবর্তন। কীভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে মানুষের জীবনমান বদলে যাচ্ছে, সে বিষয়ে ডটলাইনস গ্রুপের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হাসান মেহেদী বলেন, আমরা বরাবরই চেয়েছি আমাদের গ্রাহকদের সত্যিকার ইন্টারনেটের স্বাদটি দিতে। তাই দূরবর্তী কোনো গ্রামের টং দোকানে বসে কার্নিভাল ইন্টারনেট চালালেও সেখানে নেই স্পিডের কমতি কিংবা ব্যবহারের লিমিট। শহরের ওয়াইফাইয়ের মতোই সেখানেও বাধাহীনভাবে সবাই ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে। এতে যেমন আমাদের গ্রাহকরা উপকৃত হচ্ছেন, তেমনি গ্রাহক সমাগম বাড়ায় কার্নিভাল পয়েন্টের দোকানদারদের আয় যথারীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে দেশজুড়ে আরো দুই লাখ নতুন কার্নিভাল পয়েন্ট স্থাপন করা সম্ভব হবে। 

প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ছাড়াও কার্নিভাল ইন্টারনেটের এই গ্রামভিত্তিক প্রকল্প টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো কৃষি প্রযুক্তির এক সংমিশ্রণ। আগে যেখানে শুধু এক প্রজাতির ধান হতো, সেখানে এখন সারা বছরব্যাপী ফলনশীল ধানের চাষ হচ্ছে। সঙ্গে এখন উন্নত মানের স্ট্রবেরি, ব্রোকলি চাষও হচ্ছে। চাষাবাদের বিভিন্নতা জানার জন্য কৃষক চাষীরাও এখন তাদের স্মার্টফোনের সদ্ব্যবহার করছেন।

কার্নিভাল ইন্টারনেটের সাহায্যে রংপুরের বাসিন্দা রাতুল সাহার মতো কৃষকও আজ মুহূর্তেই জেনে যাচ্ছেন নানা কৃষি সারের ব্যাপারে। তার ছেলের সহযোগিতায় জানছেন বিশ্বের নতুন সব কৃষি-কৌশলের বিষয়ে।

অর্থনীতির এই যুগান্তকারী পরিবর্তনে গ্রামের নানা পেশার মানুষের সম্মিলিত ভূমিকা এবং জীবনমানের পরিবর্তনের বিষয়ে ডটলাইনস গ্রুপের ডিরেক্টর চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার মহিউদ্দিন মোর্শেদ রাস্তি বলেন, কার্নিভাল পয়েন্ট এমন একটি অভিনব উদ্যোগ, যার সাহায্যে আমরা গ্রামের প্রতিটি পাড়ায় নিয়ে যাচ্ছি শহরের আধুনিক যাবতীয় সুবিধাগুলো। আমাদের কার্নিভাল পয়েন্টগুলোয় গেলে একজন গ্রাহক খুব সহজেই পাবেন নানা ডিজিটাল সার্ভিস। দারুণ ইন্টারনেটের পাশাপাশি যে কেউ চাইলে কার্নিভাল পয়েন্টগুলো থেকে কিনতে পারবেন ঘুড়ি লার্নিংয়ের -লার্নিং কুপন কিংবা পরিবারের সুস্বাস্থ্যের জন্য করে ফেলতে পারবেন কার্নিভাল অ্যাসিউরের মাইক্রো-ইন্স্যুরেন্স। এমনকি টেকনাফের একটি কার্নিভাল পয়েন্ট থেকে -কুরিয়ারের মাধ্যমে দেশের আরেক প্রান্তে যেকোনো পণ্য পাঠাতে পারবেন উঠতি উদ্যোক্তারা। শহর-গ্রামের সংযোগ প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যে কার্নিভাল পয়েন্টগুলোকে আমরা প্রতিনিয়ত আরো সমৃদ্ধ করে তুলছি। গত পাঁচ বছরে প্রকল্পে আমরা বিনিয়োগ করেছি ১০০ কোটি টাকারও বেশি। আগামীতেও আমরা পয়েন্টগুলোয় বিশ্বমানের আরো নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আসব।

প্রতিষ্ঠানটির সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে কার্নিভাল সেবা নিয়ে পৌঁছে গেছে দেশের ৫৬ জেলার ২৩০ উপজেলার ১৯ হাজার গ্রামে। দেশজুড়ে প্রায় দেড় লাখ গ্রামীণ ঘরে ফাইবার অপটিক কেবল দিয়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চলে। আর প্রায় ১০ হাজার দোকানে ওয়াইফাই হটস্পট চলে। দশ লাখেরও বেশি মানুষকে সত্যিকার ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের সুবিধা পৌঁছে দেয়া সম্ভব হযেছে।

কার্নিভাল ইন্টারনেটের বর্তমান প্রকল্প ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিয়ে ডটলাইনস গ্রুপের চেয়ারম্যান মাহবুবুল মতিন বলেন, কার্নিভাল পয়েন্ট হচ্ছে কার্নিভাল ইন্টারনেটের গো রুরাল নামক একটি মেগা প্রজেক্টের অংশ। উন্নয়নভিত্তিক প্রজেক্ট তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশ সরকারের রূপকল্প-২০২১-এর ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লিখিত গ্রাম হবে শহর চিন্তাধারা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। বর্তমান সরকার উপজেলা ইউনিয়ন লেভেল পর্যন্ত ইন্টারনেট সেবার জন্য যে অবকাঠামো তৈরি করেছে, তার ওপর ভিত্তি করেই কার্নিভাল ইন্টারনেট প্রকল্প চালু করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের পথে আমরা অনেকটা পথ পৌঁছে গেছি। পরীক্ষামূলক প্রকল্প থেকে আমাদের যে স্বপ্নের শুরু হয়েছিল, সে স্বপ্নকে আমরা ছড়িয়ে দিতে চাই বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রামকে শহরে রূপান্তর করার যাত্রা মোটেও সহজ নয়। তবে এর মাঝেও খোলা যায় হাজারো সম্ভাবনার দুয়ার। তার জন্য প্রয়োজন দূরদর্শিতা সঠিক নেতৃত্বের সমন্বয়। ডটলাইনস গ্রুপের কয়েকশ দক্ষ কর্মী সম্মিলিতভাবে কাজ করছেন।  অচিরেই প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক গ্রাম থেকে উঠে আসবেন তুখোড় সব ফ্রিল্যান্সার কিংবা প্রতিভাবান উদ্যোক্তা। এভাবেই গ্রামের ঘরে ঘরে জ্বলে উঠবে প্রযুক্তির আলো। যে আলোয় দেখা মিলবে অসীম সম্ভাবনার নতুন এক বাংলাদেশের।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন