সম্পাদকীয়

পাঁচ দশকে আমরা বাঙালি জাতি কঠিন চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ বিশ্বে একটি সম্ভাবনাময় জাতি হিসেবে এগিয়ে চলেছি। এখন বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে। এরই মধ্যে আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ। নেই অভুক্ত-অনাহারে ক্লিষ্ট কোনো মানুষ। সরকারের যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে কৃষিবিজ্ঞানী, সম্প্রসারণকর্মী, গণমাধ্যম ও কৃষকের নিরলস পরিশ্রমে দেশ আজ খাদ্যে উদ্বৃত্ত। বর্তমানে আমাদের চ্যালেঞ্জ নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ ও জনগণের পুষ্টিচাহিদা নিশ্চিতকরণ।

স্বাধীনতা-পূর্ব এবং অব্যবহিত পরও আমাদের কৃষি ছিল পরিবারকেন্দ্রিক এবং গুটিকয়েক শস্য উৎপাদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। দানাদার শস্য বলতে ছিল আউশ ও আমন ধান এবং সীমিত পরিসরে গম চাষ। নদী পয়স্তি এবং সিকস্তি এলাকায় অতি দরিদ্র কৃষক চীনা, কাউন ও মিষ্টি আলু উৎপাদন করত। খেসারি, মুগ, ছোলা, সরিষা প্রভৃতি ডাল ও তেলজাতীয় শস্য এবং অর্থকরী ফসল হিসেবে পাট ও ইক্ষু চাষে ছিল ব্যাপকতা। খুবই সীমিতসংখ্যক কৃষক উৎপাদন করত মরিচ, রসুন, পেঁয়াজ, কালিজিরা, ধনিয়া ও গুয়া মৌরি প্রভৃতি মসলাজাতীয় শস্য। গৃহস্থালির বিস্তীর্ণ বসতভিটায় হলুদ ও আদা জন্মাত অনেকটা প্রাকৃতিকভাবে। নিজ বাড়িতে অধিকাংশ কৃষক ডাঁটা ও কুমড়াজাতীয় সবজি ঋতুভিত্তিক উৎপাদন করত। সবজির বাণিজ্যিক উৎপাদনে জড়িত কৃষকের সংখ্যা তখন খুবই নগণ্য। কলা, আম, কাঁঠাল, লিচু, পেঁপে ও আনারস ছিল প্রচলিত ফল। টাঙ্গাইলের মধুপুরে আনারস এবং বৃহত্তর রাজশাহী জেলায় আম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করা হলেও অন্যান্য ফলের গাছপালা কৃষকের বসতভিটা, সুবিস্তীর্ণ মাঠ ও হালটে (প্রশস্ত মেঠো পথ) জন্মাত।

স্বাধীনতার প্রাক্কালে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে মাছ, হাঁস, মুরগি, গরু ও খাসি পালন দৃশ্যমান হয়নি বললেই চলে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী নদীমাতৃক আমাদের দেশে এক সময় প্রবাহিত ছিল ৭০০টি নদ-নদী, যার মোট দৈর্ঘ্য ২৪ হাজার ১৪০ কিলোমিটার। এছাড়া দেশে ৮০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে রয়েছে ৪৭টি প্রধান হাওরসহ ৩ হাজার ৫০০টি স্থায়ী এবং ২ হাজার ৮০০টি ঋতুভিত্তিক বিল। এসব নদ-নদী, হাওর, খাল ও বিলে প্রাকৃতিকভাবে জন্মাত বিচিত্র প্রজাতির মাছ। ‘জাল যার জলা তার’ নীতিতে সারা বছর জেলেরা সেই জলাশয়গুলো থেকে মত্স্য আহরণ করত। কৃষক গৃহস্থালি কাজে বিশেষত জমি চাষ এবং পণ্য পরিবহনের উদ্দেশ্যে বসতবাড়িতে গরু ও মহিষ এবং সেই সঙ্গে হাঁস, মুরগি, কবুতর, ছাগল ও ভেড়া পালনে ছিল অত্যন্ত আন্তরিক। দেশের কৃষক পরিবারগুলো ছিল প্রান্তিক, অত্যন্ত সীমিত আয়ের ও নিম্নমধ্যবিত্তের। গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল, হাঁস, মুরগি ও কবুতর লালন-পালন করলেও দুধ, ডিম ও মাংস বাড়িতে স্বজনের আগমন বা উৎসব ব্যতীত তাদের পক্ষে ভোজন ছিল অনেকটা অকল্পনীয়।

পরিসংখ্যানের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১-৭২ সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ১৪ লাখ। তখন দেশে মোট ৯ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন হেক্টর বিস্তীর্ণ আবাদি জমি থাকা সত্ত্বেও খাদ্য (ধান ও গম) উৎপাদন হয়েছে মাত্র ১৪ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন টন। এই সময় গড়ে একজন মানুষ দৈনিক ৪৫৬ দশমিক ২৫ গ্রাম শর্করা, ৪৫ দশমিক ৪৯ গ্রাম আমিষ এবং ১৬ দশমিক ৩৪ গ্রাম চর্বি খেতে পেরেছে। প্রতি বছর বন্যা ও খরায় ব্যাপক ফসলহানির কারণে চৈত্র ও কার্তিক মাসে মারাত্মক খাদ্যসংকট দেখা দিত। চৈত্র মাসে অতি দরিদ্র এবং হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর একমাত্র খাদ্য ছিল মিষ্টি আলু। অন্যদিকে আশ্বিন-কার্তিক মাসে এই জনগোষ্ঠীকে শাপলা, শালুক, ঢেব, কচু, ঘেচু এসব খেয়ে জীবন ধারণ করতে হতো। কার্তিক মাস ছিল মরাকার্তিক নামে অভিহিত। এ সময় অতিদরিদ্র এবং হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে বিরাজিত ছিল মৃত্যুভীতি। তারা ধারণা করত কার্তিক মাস অতিক্রম করলে আরো এক বছর বাঁচার সম্ভাবনা আছে।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষে আমাদের দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৬৬ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন এবং চাষযোগ্য জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ১২ মিলিয়ন হেক্টর। গত অর্থবছর দেশে দানাদার শস্য উৎপাদন ছিল ৩৮ দশমিক ১৪ মিলিয়ন টন, গোলআলু ৯ দশমিক ৬০ মিলিয়ন টন, ভুট্টা ৪ দশমিক শূন্য ১ মিলিয়ন টন, ডালজাতীয় শস্য দশমিক ৯৭ মিলিয়ন টন, মসলাজাতীয় শস্য ২৯ দশমিক ৯৯ মিলিয়ন টন, সবজি ৪ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন টন, চিনি দশমিক ৪৭ মিলিয়ন টন এবং ফল ৫ দশমিক শূন্য ১ মিলিয়ন টন। পুষ্টি তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে দেশের মানুষ দৈনিক মাথাপিছু শর্করা, আমিষ ও চর্বিজাতীয় খাদ্য গ্রহণ করেছে যথাক্রমে ৫১২ দশমিক ৩৩, ৬০ দশমিক ২৯ এবং ৩৩ দশমিক ৯৫ গ্রাম। গত চার বছরে দৈনিক মাথাপিছু পুষ্টি উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশের কৃষি ক্ষেত্রে উন্নয়নের ধারা সূচিত হয় ১৯৭৩ সালে। এ সময় আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবুজ বিপ্লবের জনক ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কৃষিবিজ্ঞানী ড. নরম্যান আর্নেস্ট বোরলগ অনুসৃত সবুজ বিপ্লব বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সবুজ বিপ্লব সফল করতে বঙ্গবন্ধু কৃষিশিক্ষা আধুনিকায়ন ও বিভিন্ন ফসলের গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং গবেষণায় উৎসাহ প্রদান করেন। গবেষণায় প্রাপ্ত প্রযুক্তি দ্রুত কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ কার্যক্রম ত্বরান্বিতসহ বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন গঠন করে কৃষকদের বিনামূল্যে বীজ, সার, কীটনাশক ও সেচযন্ত্র সরবরাহ এবং ব্যবস্থাপনা চালু করেন।

এখন আমাদের কৃষিকাজে ব্যবহার হয় না মান্ধাতা আমলের কাঠের লাঙ্গল। দেখা যায় না গরুর কাঁধে জোয়াল, সেচকাজে সেঁওতি-দোন, আগাছা দমন ও চারা পাতলাকরণ কাজে আঁচলা ও খুরপির ব্যবহার, ঝাড়ু দিয়ে কীটনাশক সিঞ্চন, গরু-মহিষের টানা কাঠের চাকার পণ্যবাহী গাড়ি। কৃষিবান্ধব সরকারের প্রণোদনা, কৃষিবিজ্ঞানের উত্কর্ষ আর কৃষকদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সুবাদে ফসলের মাঠে এখন দৃশ্যমান পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর, হ্যান্ড স্প্রেয়ার, ন্যাপসেক স্প্রেয়ার, পাওয়ার স্প্রেয়ার, কম্বাইন হারভেস্টার, গভীর নলকূপ ইত্যাদি। সবুজ বিপ্লবের পূর্বভাগে মূলত গরু ও মহিষের গোবর, হাঁস, মুরগি ও কবুতরের বিষ্ঠা, চুলার ছাই, ফলের খোসা, ডাল ফসলের খড়কুটা বসতবাড়ির এক প্রান্তে স্তূপাকারে রেখে বছর শেষে চৈত্র মাসে সেগুলো জমিতে ছড়িয়ে জৈব সার হিসেবে ফসলের পুষ্টি চাহিদা মেটানো হতো। অধিকন্তু জৈব সার হিসেবে ধানের নাড়া পোড়ানো, কচুরিপানা, দল, ধাম স্তূপাকারে জমা করে পচনের পর মাটিতে প্রয়োগ করা হতো। বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে রোগ ও পোকামাকড় দমনের জন্য দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ ছিল না বললেই চলে। বসতবাড়ির পাশে জন্মানো সবজির রোগ ও পোকা মাকড় দমনে কৃষক সিঞ্চন করতেন হুক্কার বাসি পানি, নিমপাতা চুবানো বাসি পানি, ভেরেণ্ডা বীজের তেলমিশ্রিত পানি বা গোবরমিশ্রিত পানি। এছাড়া ছিটিয়ে দিতেন চুলার ছাই বা বৈন্যা, আকন্দ, ধুতুরা ও গাছের শুকনো পাতার গুঁড়া ইত্যাদি।

সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে দেশে শুরু হয় বিভিন্ন ফসলের উচ্চফলনশীল জাতের চাষ। নতুন নতুন প্রজাতির ফসলের সমাগম ঘটে। আউশ ও আমন ঋতুর ধান চাষের সঙ্গে যুক্ত হয় বোরো ঋতুর ধান। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে আমদানীকৃত আইআর-৮ ধান চাষে কৃষকের মাঝে সৃষ্টি হয় সীমাহীন আগ্রহ। জাপান থেকে বিভিন্ন ফসলের বীজ আমদানি করে সেগুলো চাষে উৎসাহী করা হয়। সে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ কৃষিবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রচেষ্টায় দেশের বিভিন্ন ফসলের বিদ্যমান জাতগুলোতে সংকরায়নের মাধ্যমে নতুন নতুন জাত সরবরাহ ঘটে। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ থেকে হরেক রকমের ফল ও শাক-সবজির বীজ আমদানি করে আমাদের দেশের আবহাওয়ায় অভিযোজনের মাধ্যমে চাষযোগ্য করে তোলা হয়। প্রত্যাশিত ফলন পেতে রাসায়নিক সার ও বালাই নাশকের ব্যাপকভিত্তিক ব্যবহার শুরু হয় উচ্চফলনশীল জাতগুলোতে।

কৃষি ফসলের পাশাপাশি মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়নেও ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ মাত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ এবং মত্স্য জাত তৈরিতে ঘটে নয়াদিগন্ত। অধিকসংখ্যক ডিম ও দুধ উৎপাদন এবং মাংস সরবরাহের নিমিত্তে জাগরণ হয় প্রাণিসম্পদের উন্নয়ন। শুরু হয় বিদেশ থেকে নতুন জাতের গরু, হাঁস, মুরগি, কোয়েল আমদানি, দেশের পরিবেশে তাদের অভিযোজন এবং সংকরায়নের মাধ্যমে নতুন জাত তৈরি। নতুন প্রজাতির মাছ আমদানি ও তাদের অভিযোজন, নতুন জাত অবমুক্তকরণ এবং মুক্ত জলাশয়ের পাশাপাশি পুকুরে মত্স্য চাষের সাড়া জাগে।

আয়তনের দিক থেকে বিশ্বে আমাদের দেশ ৯১তম। মোট জনসংখ্যার বিচারে আমরা অষ্টম। বিশ্বের অন্যতম প্রধান ঘনবসতির এ দেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ২৬৫ জন লোকের বসবাস। স্বাধীনতা-পরবর্তী বছর সরকারের মোট বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। তখন কৃষিকাজে নিয়োজিত জনবল ছিল মোট জনসংখ্যার ৭৮ শতাংশ। বর্তমান অর্থবছরে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে ১৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা এবং মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। এখন কৃষিকাজে নিয়োজিত জনবল মোট জনসংখ্যার ৩৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ। স্বাধীনতার পাঁচ দশকে কৃষি জমি হ্রাস পেয়েছে ১৩ দশমিক ৫২ শতাংশ, সেই সঙ্গে কমে গেছে কৃষি, মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে নিয়োজিত জনবল। তার পরও আজ আমরা বিশ্বে ধান উৎপাদনে চতুর্থ, গোল আলু উৎপাদনে সপ্তম, আম উৎপাদনে সপ্তম, স্বাদুপানির মত্স্য উৎপাদনে দ্বিতীয়, ডিম উৎপাদনে ষষ্ঠ স্থান অধিকার করেছি।

বর্তমানে বাংলাদেশে শতাধিক প্রজাতির ফসলের চাষ করা হয়। দানাদার ফসলে যুক্ত হয়েছে ভুট্টা, তেল ফসলে সয়াবিন ও সূর্যমুখী। কমলা, মাল্টা, ড্রাগন, স্ট্রবেরিসহ বিচিত্র রকমের বিদেশী ফল, সবজি, মসলা ও নানাবিধ ফসলের চাষ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সর্বত্র। দিন দিন আরো যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন ফসল। হাটবাজারে শোভা পাচ্ছে নানা রকমের ফল, শাক-সবজি, মাছ, হাঁস, মুরগি ইত্যাদি। কৃষিতে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জিত হলেও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ, জলবায়ু মোকাবেলা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে আমরা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এখন আর আউশ ঋতুতে দুলাভোগ, চাপিলা, বালু ভুরকি ধানের চাষ নেই। আমন ঋতুতে নেই চামারা, বোরণ, কাতিজুল, কাতিকাইকা ধানের চাষ। এসব ধানের খৈ, চিঁড়া, মুড়ি ও পিঠার স্বাদ পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষের কাছে এখন শুধুই স্মৃতি রোমন্থন। গ্রামের চাষীদের মুখে প্রবাদ ছিল ‘ধানের মধ্যে চামারা—যদি থাকে পানি, আত্মীয়দের মধ্যে মামারা—বেঁচে থাকলে নানী।’ কৃষির যেমন প্রাকৃতিক পরিবেশ নেই, তেমনি এখন নেই আত্মীয়তার দৃঢ়বন্ধন।

দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্যচাহিদা মেটাতে কৃষিজমি ও বাস্তুতন্ত্রে পড়ছে বাড়তি চাপ। শস্য পর্যায় উপেক্ষা করে একই জমিতে পালাক্রমে ধানচাষ, উচ্চফলনশীল জাতের ফসল উৎপাদনে অবিবেচকভাবে রাসায়নিক সার ও বালাই নাশক ব্যবহার প্রতিবেশের ওপর সৃষ্টি করছে বিরূপ প্রভাব। এ দেশে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে ইউরিয়া সারের ব্যবহার ছিল মাত্র ২৭৭ টন। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে ইউরিয়া সারের চাহিদা হয় ২ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন টন এবং সেই সঙ্গে ১ দশমিক ৪ মিলিয়ন টন ডাইঅ্যামোনিয়াম ফসফেট। এখন প্রতি হেক্টর জমিতে বার্ষিক ৩২০ কিলোগ্রাম ইউরিয়া সার ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রয়োগকৃত ইউরিয়া সারের ৭৫ শতাংশ চলে যায় ধানের জমিতে। দেশে সরকারি প্রণোদনায় ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বিনামূল্যে বালাই নাশক সরবরাহ করা হয়। বালাই নাশকের প্রয়োগ ১৯৭৭ সাল থেকে অস্বাভাবিক বাড়তে থাকে এবং বর্তমানে এর চাহিদা প্রায় ৪০ হাজার টন।

রাসায়নিক সার ও বালাই নাশকের অবিবেচক ব্যবহারে মাটিতে বসবাসকারী অণুজীব ও কেঁচো মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন। কেঁচোকে প্রকৃতির লাঙল বলা হয়। এরা মাটি ফুটা করে বায়ু ও অক্সিজেন চলাচলের মাধ্যমে মাটির উর্বরতা সংরক্ষণে সহায়ক। মিথোজীবী ব্যাকটেরিয়া যথা অ্যানাবেনা, নস্টক, রাইজোবিয়াম, এজোটোবেক্টার ইত্যাদি শিমজাতীয় গাছের মূলে নাইট্রোজেন জমা করে মাটিতে পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে। অযৌক্তিক ও অপরিমেয় রাসায়নিক সার ও বালাই নাশক প্রয়োগের ফলে এসব উপকারী অণুজীবগুলো ধ্বংস হয়ে এরই মধ্যে মাটির স্বাস্থ্যহানি দেখা দিয়েছে। প্রয়োগকৃত বালাই নাশকের ৯৯ শতাংশই লক্ষ্যস্থিত আপদের বাইরে চলে যায়। ফলে কৃষি বাস্তুসংস্থানে বিদ্যমান পরাগী পতঙ্গ যেমন—মৌমাছি, পাণ্ডুর প্রজাপতি, ছুতোর ভোমরা ইত্যাদি এবং পরভোজী পতঙ্গ যেমন—লেডি বিটল, অমত্ত শিকারি পোকা, ঝিল্লি ডানা পোকাসহ অসংখ্য প্রজাতির মৃত্যুর ফলে কৃষি আজ বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন। পরজীবীভুক্ত শাণিত পুচ্ছ ভ্রমর, পরজীবী বোলতাসহ বিচিত্র প্রজাতির উপকারী পতঙ্গসহ পাখি, ব্যাঙ, সাপ ও অন্যান্য সরীসৃপ এবং মেরুদণ্ডী ও অমেরুদণ্ডী প্রাণীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বা মৃত্যুতে আপদের পুনরুদয় এবং গৌণ আপদের মুখ্য হয়ে আবির্ভাব দেখা যায়। বালাই নাশকের প্রতি কীটগুলো প্রতিরোধী হওয়ায় অধিকতর বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করেও প্রত্যাশিত ফল লাভ হচ্ছে না। রাসায়নিক সার ও বালাই নাশক মাটি ও পানিতে গিয়ে বিষাক্ততা সৃষ্টি করে মত্স্য ও প্রাণিসম্পদের অভূত ক্ষতির কারণ হয়েছে। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন উপসর্গ হয়ে নতুন নতুন আপদের উদয় ঘটিয়ে কৃষিকে চরম ঝুঁকিতে ঠেলছে।

কৃষিকে আরো গতিশীল করে উন্নত প্রযুক্তির সূচনা ও ব্যবহার জোরদারকরণের মাধ্যমে আগামী দিনে দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার নিরাপদ পুষ্টিচাহিদা নিশ্চিতকরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সম্ভব। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে জৈবসার ও জৈব বালাইনাশক ব্যবহার এবং আপদ দমনে কৃষ্টিগত, ভৌত ও যান্ত্রিক পদ্ধতির ব্যবহার অত্যাবশ্যক। এক ফসলি পদ্ধতি পরিহার করে শস্যের বহুমুখীকরণ ও শস্য পর্যায় অবলম্বন অনুপ্রাণিতকরণ ও শস্য সংরক্ষণে বিষাক্ত রাসায়নিক পরিহার করে সেখানে আপদ দমনে ভৌত ও যান্ত্রিক পদ্ধতির ব্যবহার হবে সমীচীন। পরিবহন ও বাজারজাতে থাকতে হবে কার্যকর তদারকির বাস্তবায়ন। কৃষকদের পর্যাপ্ত আর্থিক প্রণোদনা ও প্রশিক্ষণ প্রদান, যথাসময়ে উন্নত বীজ সরবরাহ, মাটি পরীক্ষা করে রাসায়নিক সার প্রয়োগ, শস্য বীমা চালুকরণ ও পণ্যের লাভজনক মূল্য নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে তাদের জৈব কৃষিতে উদ্বুদ্ধকরণ সম্ভব হবে।

ড. মো. রুহুল আমীন: অধ্যাপক, কীটতত্ত্ব বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়