বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতদের বেকারত্ব ও দরিদ্রতা বেড়েছে

যুক্তরাজ্য থেকে পাঁচ বছরে রেমিট্যান্স বেড়েছে ১৩৪%

মনজুরুল ইসলাম ও হাছান আদনান

যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত অভিবাসীদের মধ্যে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতদের পরিস্থিতি বরাবরই সবচেয়ে নাজুক। এর পরও গত কয়েক বছরে দেশটি থেকে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়েছে। রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত ছিল চলমান মহামারীকালেও। যদিও সময় দেশটিতে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অভিবাসীদের মধ্যে বেকারত্ব দরিদ্রতা দুই- উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়েছে।

অভিবাসনের জন্য বাংলাদেশীদের স্বপ্নের দেশগুলোর একটি যুক্তরাজ্য। ইউরোপের শক্তিশালী অর্থনীতির দেশটিতে কেউ যাচ্ছেন উচ্চশিক্ষার পাঠ নিতে। আবার রাজনৈতিক আশ্রয় কিংবা শ্রমিক হিসেবেও যুক্তরাজ্যমুখী হচ্ছেন কেউ কেউ। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা কারণে দেশের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর বিলাসী জীবনের তীর্থস্থানও হয়ে উঠছে ব্রিটেন। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতের সংখ্যা প্রায় ছয় লাখ। স্বপ্ন ছোঁয়ার হাতছানি নিয়ে ব্রিটেনে অভিবাসী হয়েছিলেন তারা। যদিও তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ এখন বেশ শোচনীয় অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। জীবনধারণের মৌলিক উপকরণগুলো জোগাড় করতেই হিমশিম খাচ্ছেন তারা। চলমান করোনা মহামারী তাদের আরো নাজুক পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছে।

যদিও যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধির চিত্র বিপরীতই দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে (২০২০-২১) দেশটি থেকে রেমিট্যান্স এসেছে রেকর্ড ২০২ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। কভিডের আগেও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্রিটেন থেকে দেশে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ ছিল ১১৭ কোটি ডলার। সেখান থেকে বেড়ে তা ২০১৯-২০ অর্থবছরে দাঁড়ায় ১৩৬ কোটি ডলারে। এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল প্রায় ৮৬ কোটি ৩৯ লাখ ডলার। সে হিসেবে গত পাঁচ অর্থবছরে যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশমুখী রেমিট্যান্সের পরিমাণ বেড়েছে ১৩৪ শতাংশের কিছু বেশি।

আগে থেকেই বিপদের মুখে থাকা বাংলাদেশীরা কভিডকালে গত দুই বছরে আর্থিকভাবে আরো বেশি বিপর্যস্ত হয়েছেন। করোনার আগে সেখানে বেকার ছিলেন শতাংশ বাংলাদেশী। কিন্তু গত দুই বছরে তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার সব রেকর্ড ভেঙে ৩৭ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে।

যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি মূলত পর্যটন সেবা খাতের ওপর নির্ভরশীল। দেশটির মোট জিডিপির এক-তৃতীয়াংশই সেবা খাতের। খাতের বিপুলসংখ্যক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকানা ছিল বাংলাদেশীদের। দফায় দফায় লকডাউনে এসব প্রতিষ্ঠান ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছে। এতে চাকরির পাশাপাশি ব্যবসাও হারিয়েছেন অনেক বাংলাদেশী। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি বণিক বার্তার নিজস্ব অনুসন্ধানেও সেখানকার বাংলাদেশীদের চলমান দুর্দিনের চিত্রই উঠে এসেছে।

ব্রিটিশ সরকারের পরিসংখ্যান সংস্থার ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, ওই সময় দেশটির শতাংশ নাগরিক বেকার ছিল। তবে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অভিবাসীদের মধ্যে এর হার ছিল দ্বিগুণ। তাদের মধ্যে শতাংশেরই কোনো কাজ ছিল না। পরিস্থিতি বিপর্যয়কর দিকে মোড় নেয় চলমান মহামারীর প্রাদুর্ভাবে। দফায় দফায় কঠোর লকডাউনে মাসের পর মাস স্থবির ছিল ব্রিটেনের জীবনযাত্রা। সময় দেশটির গড় বেকারত্ব বেড়েছে। তার তুলনায়ও অনেক বেশি বেড়েছে বাংলাদেশীদের কর্মহীন হয়ে পড়ার হার। রানিমেড ট্রাস্টসের কভিড-১৯ সার্ভের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, করোনা ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের মধ্যে বেকারত্বের হার বাড়িয়ে তুলেছে ৩৭ শতাংশে।

এর মধ্যেও দেশটি থেকে রেমিট্যান্স আসা বাড়ছে। কভিডকালেও যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আয় বাড়ার কারণ ব্যাখ্যা করে সম্প্রতি একটি মতামত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। সেখানে বলা হয়েছে, করোনাকালে যুক্তরাজ্য সরকার নানা ধরনের আর্থিক প্রণোদনা দিয়েছে। সে প্রণোদনার কিছুটা অংশ বাংলাদেশীরাও পেয়েছেন। সেটা অনেকেই দেশে নিজেদের পরিবারের কাছে পাঠিয়েছেন।

তবে যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী বাংলাদেশী কমিউনিটির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা ভিন্ন তথ্যও দিচ্ছেন। বণিক বার্তার সঙ্গে আলাপকালে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্রিটিশ বাংলাদেশী বলেছেন, গত দুই বছরে ব্রিটেনে অসংখ্য বাংলাদেশী চাকরি হারিয়েছেন। অনেকের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দেনার ভারে জর্জরিত হয়ে দেউলিয়া হয়েছে। অবস্থায় যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স গিয়েছে, তার কতটুকু বৈধ অর্থ সেটি নিয়ে সন্দেহ আছে। দশকের পর দশক ধরে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের দেশগুলোতে পাচার হওয়া অর্থের একটি অংশ রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে ফিরেছে বলেই মনে করছেন তারা।

ব্রিটিশ সরকারের তৈরি করা ২০১৮ সালের স্বাস্থ্য সমতা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, আর্থিক সক্ষমতায় শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশদের তুলনায় যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী কৃষ্ণাঙ্গ, এশিয়ান অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর মানুষ বেশ পিছিয়ে আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশীরা। দেশটিতে বসবাসকারী বাংলাদেশী ব্রিটিশ পরিবারের অন্তত ৫০ শতাংশ বাসস্থানের ব্যয় নির্বাহ করতেই হিমশিম খায়। যেখানে মূল ব্রিটিশ পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে হার ২০ শতাংশ।

দেশটিতে বঞ্চিত দরিদ্র পরিবারের শিশুরা স্কুলে বিনামূল্যে খাদ্য পায়। কেবল দরিদ্র পরিবারের শিশুরাই সরকার থেকে খাদ্যসহায়তা পায়। যুক্তরাজ্যের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, ব্রিটেনের ১৫ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ শিশু বিনামূল্যের খাদ্যসহায়তা নেয়। যেখানে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত শিশুদের বিনামূল্যে খাদ্যসহায়তা নেয়ার হার ২১ শতাংশ।

যুক্তরাজ্যে বসবাসকারীদের জীবনমান নির্ধারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সেবাপ্রাপ্তিকেও গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ বিবেচনা করা হয়। তার পরও অনেক ব্রিটিশ নাগরিকই অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সেবাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বঞ্চিতদের তালিকায় সবার ওপরের দিকে রয়েছে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশদের নাম। এমনকি তীব্র শীতের সময়ে গরম কাপড় সংগ্রহ করতেও ব্রিটিশ অনেক বাংলাদেশীকে হিমশিম খেতে হয়। ব্রিটিশ সরকারের তৈরি করা ২০১৯ সালের ওএনএস প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সেখানকার ২৯ শতাংশ বাংলাদেশীই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সেবা থেকে বঞ্চিত। যেখানে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে হার ২২ শতাংশ।

২০১৬-১৯ সালের তথ্য পর্যালোচনা করে ব্রিটিশ সরকার বলছে, একজন শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ সপ্তাহে ৫১৮ পাউন্ড আয় করেন। যদিও প্রতি সপ্তাহে বাংলাদেশীরা আয় করেন মাত্র ৩৬৫ পাউন্ড। সম্পদ সঞ্চয়ের দিক থেকেও বেশ পিছিয়ে আছেন বাংলাদেশী ব্রিটিশরা। ওএনএস জরিপের তথ্য অনুযায়ী, একটি শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ পরিবারের গড় সম্পদ, সঞ্চয় পেনশনের পরিমাণ লাখ ৯০ হাজার ৪০০ পাউন্ড। যেখানে পরিবারপ্রতি মাত্র লাখ ৪১ হাজার ১০০ পাউন্ড সম্পদ সঞ্চয় আছে বাংলাদেশীদের। সঞ্চয়ের দিক থেকে বাংলাদেশী পরিবারগুলো ভারতীয় পাকিস্তানিদের পাশাপাশি আফ্রিকানদের চেয়েও বেশ পিছিয়ে।

২০২০ সালে তৈরি করা যুক্তরাজ্য সরকারের জাতিগত বৈষম্য নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ব্রিটেনে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের মাত্র ৪৬ শতাংশের নিজস্ব বাড়ি রয়েছে। যেখানে ব্রিটেনে বাড়ির মালিকানা থাকা জনগোষ্ঠীর গড় হার ৬৩ শতাংশ। ৬৮ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ ৫৮ শতাংশ পাকিস্তানি পরিবারের নিজস্ব বাড়ি আছে যুক্তরাজ্যে।

যে ৪৬ শতাংশ ব্রিটিশ বাংলাদেশীর বাড়ির মালিকানা আছে তার পরিস্থিতিও খুব বেশি সুখকর নয়। যুক্তরাজ্য সরকারের তথ্য বলছে, বাংলাদেশীদের মালিকানায় থাকা বাড়িগুলোর অন্তত ২৪ শতাংশের পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত নয়। ঘাটতি রয়েছে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতদের বাড়ির নিরাপত্তা পরিস্থিতিতেও। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত এসব বাড়ি সংস্কার করে কোনো রকমে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। পুরো যুক্তরাজ্যের বাড়িগুলোর মাত্র শতাংশে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ দেখতে পাওয়া যায়। যেখানে বাংলাদেশীদের মালিকানাধীন বাড়িগুলোর শতাংশই স্যাঁতসেঁতে নাজুক। এমনকি ২৪ শতাংশ বাড়িতে ঠাসাঠাসি করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বসবাস করছেন বাংলাদেশীরা।

করোনার সময় অনেক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত চাকরি হারালেও কেউ কেউ আবার ব্যাপক মাত্রায় সরকারি সহায়তাও পেয়েছেন বলে স্থানীয় বাংলাদেশী কমিউনিটিগুলোর একাধিক নেতা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, যুক্তরাজ্যের লিভিং স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি যদি চাকরিচ্যুত হন, তবে সরকার থেকে প্রতি সপ্তাহে তিনি কমপক্ষে ৪৫০ পাউন্ড ভাতা পান। বছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ন্যূনতম ১৯ হাজার ৫০০ পাউন্ড। কভিডের সময়ে কারো কারো ক্ষেত্রে এর সঙ্গে আরো বিভিন্ন ভাতা যুক্ত হয়েছে। তারা সময় বেসিক বেতনের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ব্যয়, সামাজিক সুরক্ষা ব্যয়সহ বিভিন্ন খাতে নিয়মিত ভাতা পেয়েছেন। অনেকেই এর একটি অংশ বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন।

শুধু চাকরি হারানোরাই নন, করোনার কারণে ব্যবসায়িকভাবে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তারাও সরকার থেকে নগদ সহায়তা পেয়েছেন। প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যের উত্তর অংশের রাজধানী লিডসের ব্যবসায়ী এডুকেশন অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন ফর বাংলাদেশ লিডসের সাধারণ সম্পাদক মো. জাকারিয়া বণিক বার্তাকে বলেন, যুক্তরাজ্যে ক্ষুদ্র থেকে মাঝারি মানের যেসব বাংলাদেশী ব্যবসায়ী রয়েছেন, তারাই মূলত কভিডে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে যুক্তরাজ্য সরকার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ১৫-২০ হাজার পাউন্ড করে সহায়তা দিয়েছে। অনেক বাংলাদেশী ব্যবসায়ী তিনবার পর্যন্ত ধরনের সহায়তা পেয়েছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এসব অর্থ বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন