শেষ পাতা

বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতে অভিনব এক ব্যবসা শুরু করেছিলেন সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাসেল। পণ্য ডেলিভারির জন্য গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিতেন। গ্রাহককে পণ্য সরবরাহ করতেন এর কয়েক মাস পর। বিনিময়ে গ্রাহক পণ্যটি পেয়ে যেতেন প্রায় অর্ধেক দামে। ‘ছাড়’, ‘অফার’, ‘ক্যাশবাক’ দিয়ে দ্রুতই বিপুলসংখ্যক গ্রাহক তৈরি করতে সমর্থ হয় প্রতিষ্ঠানটি। জনপ্রিয়তার পাশাপাশি ইভ্যালির ব্যবসার ধরন নিয়ে সমালোচনাও ছিল। শেষমেশ গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছে প্রায় ৫৫০ কোটি টাকার দায় নিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাসেল। গতকাল ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসায় অভিযান চালিয়ে রাসেলের স্ত্রী ও ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকেও গ্রেফতার করেছে র‍্যাব। দুজনের বিরুদ্ধেই প্রতারণার অভিযোগে একাধিক মামলা রয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে পাস করে একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেন রাসেল। একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ ডিগ্রিও অর্জন করেন। ২০১৭ সালে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে পা রাখেন ই-কমার্স ব্যবসায়। শুরুতে অনলাইনে ডায়াপার বিক্রি করতেন রাসেল। সেখান থেকে বড় কিছু করার উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠা করেন ইভ্যালি। তিনি নিজে হন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। স্ত্রীকে করেন চেয়ারম্যান।

শুরু থেকেই মোটরসাইকেল, টেলিভিশন, ফ্রিজ, প্রাইভেট কার, ফ্যাশন পণ্য, গৃহস্থালি সামগ্রীসহ বিভিন্ন পণ্য প্রায় অর্ধেক দামে বিক্রি করতে থাকে ইভ্যালি। প্রায় অর্ধেক দামে পণ্য পেয়ে হু হু করে বাড়তে থাকে ইভ্যালির গ্রাহক। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, সারা দেশে তাদের প্রায় ৪০ লাখ নিবন্ধিত গ্রাহক বা ক্রেতা রয়েছেন। নিবন্ধিত বিক্রেতা বা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান আছে প্রায় ২০ হাজার।

শুরু থেকেই ইভ্যালির এ ‘অস্বাভাবিক’ ব্যবসার ধরন নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা হলেও সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বলতে গেলে চুপচাপই ছিল। উল্টো প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে কথা বলতে দেখা গেছে সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদেরও। আবার অনেকেই প্রয়োজনীয় আইন না থাকার কথা বলে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের করা এক প্রতিবেদনের পর ইভ্যালির বিষয়টি নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মধ্যে তোড়জোড় শুরু হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে আসে, গত ১৪ মার্চ (২০২১) ইভ্যালি ডটকমের মোট সম্পদ ছিল ৯১ কোটি ৬৯ লাখ ৪২ হাজার ৮৪৬ টাকা (চলতি সম্পদ ৬৫ কোটি ১৭ লাখ ৮৩ হাজার ৭৩৬ টাকা) এবং মোট দায় ছিল ৪০৭ কোটি ১৮ লাখ ৪৮ হাজার ৯৯৪ টাকা। এর মধ্যে গ্রাহকের কাছে ইভ্যালির দায় ২১৩ কোটি ৯৪ লাখ ৬ হাজার ৫৬০ টাকা এবং মার্চেন্টের কাছে দায় ১৮৯ কোটি ৮৫ লাখ ৯৫ হাজার ৩৫৪ টাকা। প্রতিবেদন পাওয়ার পর ইভ্যালির বিরুদ্ধে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে দুদককে অনুরোধ করা হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।

এরপর গত জুলাইয়ে ই-কমার্স খাতকে নেতিবাচক প্রভাব থেকে রক্ষায় ইভ্যালির বিরুদ্ধে কেন আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে চিঠি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি এ বিষয়ে তথ্যাদিসহ গ্রাহক ও মার্চেন্টদের পাওনা পরিশোধ ও ব্যবসার পরিকল্পনা জানানোসহ কারণ দর্শাতেও বলা হয়। পরে ইভ্যালি জানায়, গ্রাহকের কাছে অগ্রিম, সরবরাহকারীদের কাছে দেনা, ব্যবসায়িক ব্যয়সংক্রান্ত দেনাসহ অন্য সব দেনা বাবদ ইভ্যালির মোট চলতি দায়ের পরিমাণ ৫৪২ কোটি ৯৯ লাখ ৮ হাজার ৪৮২ টাকা। ইভ্যালির দেয়া তথ্য অনুযায়ী তাদের স্থাবর সম্পত্তি ১০৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকার। আর অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে ৪৩৮ কোটি টাকার। অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে ৪২৩ কোটি টাকা ইভ্যালির ব্র্যান্ড মূল্য। আর ১৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা অদৃশ্যমান সম্পত্তি। মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া ইভ্যালির সর্বশেষ চিঠিতে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল জানান, গ্রাহকের কাছে তাদের যে দেনা রয়েছে তা পাঁচ মাসের মধ্যে পরিশোধ করবেন।

এর আগে গত জুলাইয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে পণ্য বিক্রির বিষয়ে বিভিন্ন নির্দেশনা জারি করা হলে ইভ্যালির বিভিন্ন অফার বন্ধ হয়ে যায়, যেগুলোর মাধ্যমে প্রায় অর্ধেক দামে পণ্য বিক্রি করা হতো। এরপর থেকেই ইভ্যালির বিরুদ্ধে সময়মতো পণ্য না দেয়া, টাকা ফেরত না দেয়াসহ বিভিন্ন হয়রানির অভিযোগ বাড়তে শুরু করে গ্রাহকদের।

গত ১৪ সেপ্টেম্বর ইভ্যালির ব্যাপারে আর দায়িত্ব নেবে না বলে জানিয়ে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সুপারিশ করা হবে বলে জানান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) সেলের মহাপরিচালক ও ডিজিটাল ই-কমার্স সেলের প্রধান হাফিজুর রহমান।

প্রতারণা ও হয়রানির বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় রাসেল ও তার স্ত্রীর নামে একাধিক মামলাও রয়েছে। সর্বশেষ গত বুধবার ঢাকার গুলশান থানায় আরিফ বাকের নামের এক গ্রাহক প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ইভ্যালির রাসেল ও তার স্ত্রী শামীমার বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, গত ২৯ মে থেকে ১৬ জুন পর্যন্ত আরিফ বাকের বিভিন্ন সময় পণ্যের মূল্য বাবদ ৩ লাখ ১০ হাজার ৫৯৭ টাকা অনলাইন ব্যাংকিং ও একটি ব্যাংকের কার্ডের মাধ্যমে পরিশোধ করেন। পণ্য ৭ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে দিতে ব্যর্থ হলে সম্পূর্ণ টাকা ফেরতের অঙ্গীকার করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। সর্বশেষ ৫ সেপ্টেম্বর ইভ্যালির গ্রাহকসেবা শাখায় যোগাযোগ করেও তিনি পণ্য পেতে ব্যর্থ হন। পরে ইভ্যালির অফিসে প্রতিনিধিদের সঙ্গে পণ্যের বিষয়ে কথা বলতে গেলে তারা চিত্কার-চেঁচামেচি করেন। একপর্যায়ে অফিসের ভেতর থেকে ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রাসেল তাকে ভয়ভীতি দেখান ও তাদের টাকা দিতে অস্বীকার করেন। এ সময় তাকে প্রাণনাশের হুমকিও দেয়া হয় বলে অভিযোগে উল্লেখ করেছেন বাকের।

মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইভ্যালির সিইও রাসেল ও চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে র‍্যাব সদর দপ্তরে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। আজ (শুক্রবার) প্রেস ব্রিফিংয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।