ভুলের ফাঁদে দেশের জ্বালানি খাত

অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সঙ্গে জ্বালানি ব্যবস্থাপনা সংগতিপূর্ণ করা হোক

দেশের অর্থনীতির দ্রুত উন্নয়নে শিল্পায়নের বিকল্প নেই। ২০০৯ সালে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পর উপলব্ধি থেকেই সরকার বলেছে তারা দেশজুড়ে শিল্পবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে আগ্রহী। তারা চায় কোনো বাধা ছাড়াই শিল্পের বিস্তার ঘটুক। শুধু তা- নয়, কলকারখানায় দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ১০০টি অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার পথেও অনেকটাই এগিয়েছে সরকার। কিন্তু শিল্প-কলকারখানার মূল চালিকাশক্তি জ্বালানির ব্যয়সাশ্রয়ী নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের নিশ্চয়তা সরকার এখনো দিতে পারেনি। এর জন্য দায়ী ভ্রান্ত জ্বালানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জ্বালানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে সরকার ক্রমেই আমদানির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশে এখন ব্যয়বহুল তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আনা হয়েছে ব্যয়বহুল জ্বালানি তেল। সরকারের যে পরিকল্পনা তাতে ভবিষ্যতে এলএনজির আমদানি আরো বেড়ে যাবে। শুধুু গ্যাসই নয়, তেল কয়লাসহ অন্যান্য জ্বালানিতেও আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে। অথচ দেশের মূল ভূখণ্ডে গ্যাস কয়লার খনি থাকার সম্ভাবনা সত্ত্বেও এসবের অনুসন্ধানে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। সব মিলিয়ে সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সঙ্গে জ্বালানি ব্যবস্থাপনা সংগতিপূর্ণ নয়।

স্বল্পমূল্যের প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় অর্থনীতির চাকা স্বচ্ছন্দে চালু রেখেছে। ২০১০ সালে এসে গ্যাস সংকট জ্বালানি খাতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সময়ে আমদানি করা জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে যায়। ২০১৫ সালে জ্বালানি সরবরাহের ভবিষ্যৎ রূপরেখা প্রণয়নকালে নির্ধারিত হয় যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অন্যতম প্রধান ভূমিকা রাখবে কয়লা, যার প্রায় পুরোটাই আমদানি করা হবে। এটা উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম বাড়ার একটি ধাপ বলে বিবেচিত হচ্ছে এখন। সর্বশেষ ২০১৮ সালে দেশে প্রথমবারের মতো এলএনজি আমদানির মাধ্যমে গ্যাস সংকট অনেকটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এলএনজি ব্যয়বহুল, এর ওপর ব্যাপক নির্ভরশীলতা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এরই মধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে, এলএনজি সরবরাহ করতে গিয়ে সরকারকে ব্যাপক ভর্তুকিও দিতে হচ্ছে। জ্বালানি পরিকল্পনাও সংশোধন করা হয়েছে। কিন্তু এতেও জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় কোনো উন্নতি লক্ষ করা যায়নি। কারণ স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাস, কয়লার অনুসন্ধানে গভীর দৃষ্টি দেয়া হচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশ ক্রমে ব্যয়বহুল আমদানিনির্ভর জ্বালানি খাতের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। দেশে গ্যাস অনুসন্ধানে এখনো পরিপক্ব হয়নি, বরং প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। দেশের ভূখণ্ডের অনেক অংশই এখনো অনুসন্ধানের আওতায় আনা হয়নি; বিশাল সমুদ্র এলাকায় অনুসন্ধান ন্যূনতম পর্যায়ে রয়ে গেছে। সুতরাং দেশের সব গ্যাস ফুরিয়ে যাচ্ছে ধারণা থেকে জ্বালানি আমদানির ওপর সর্বতোভাবে ঝুঁকে পড়া যৌক্তিক নয়। আমদানিনির্ভর জ্বালানির ওপর নির্ভর করে পরিকল্পনা প্রণয়নের নানামুখী ঝুঁকি থাকে। আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি, উৎপাদন দাম নিয়ে কারসাজিসহ বিভিন্ন কারণে জ্বালানির বাজার সারা বছরই দোদুল্যমান থাকে। মাঝে মাঝেই দাম বেড়ে রেকর্ড করে। ফলে আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারের ওপর নির্ভর করে পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা কঠিন।

বৈশ্বিক তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ দেশীয় উৎস থেকে জ্বালানি জোগানোতেই বেশি দৃষ্টি দিয়েছে। ভিয়েতনাম বর্তমানে নিজস্ব প্রাকৃতিক গ্যাস কয়লা ব্যবহারের মাধ্যমে মোট বিদ্যুতের যথাক্রমে ৩১ ২৬ শতাংশ উৎপাদন করছে। দেশটিতে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনে জলবিদ্যুতের অবদান ৪১ শতাংশ। বাকি শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে খুব সামান্য পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি করে। এখন দেশটি নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন ব্যবহারে আরো বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। একইভাবে কম্বোডিয়াও গতানুগতিক অনবায়নযোগ্য জ্বালানির পাশাপাশি সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ জলবিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে শিল্প খাতের জ্বালানি চাহিদা মেটাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ায়ও সমরূপ অবস্থা। দেশটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস কয়লার প্রাধান্য থাকলেও ধীরে ধীরে জলবিদ্যুৎ জিওথার্মালের ব্যবহার বাড়ছে। এসব ক্ষেত্রে তারা দেশীয় উৎসনির্ভর। ফলে সেসব দেশে জ্বালানি ব্যয় আপেক্ষিকভাবে কম। এসব দেশের অভিজ্ঞতা অনুসরণ করে আমাদেরও দেশীয় জ্বালানিতে মনোযোগ দিতে হবে।

সরকার বলছে, দেশীয় উৎস কমে আসায় গ্যাসভিত্তিক শিল্পায়নের চাকা সচল রাখতে ব্যয়বহুল এলএনজি জ্বালানি তেল আমদানির বিকল্প কোনো রাস্তা খোলা নেই। দেশের শিল্পায়নে চাহিদা পূরণ করতে গ্যাস সরবরাহ করতে হবে। এখন যেহেতু আমাদের নিজস্ব গ্যাসের উৎস সীমিত, ফলে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করে শিল্প-কারখানায় গ্যাস সরবরাহ করা হবে। সরকার এরই মধ্যে কাতার, ওমানসহ কয়েকটি দেশ থেকে এলএনজি আমদানি করে সরবরাহ করছে। সামনের দিকে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কিনে তা সরবরাহ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা যে গতিতে বাড়ছে, উৎপাদন সেই গতিতে বাড়ছে না। ফলে আমদানি করা ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় নেই। শুধু গ্যাস নয়, চাহিদা দেশের সব প্রাথমিক জ্বালানিই আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। যার মধ্যে রয়েছে কয়লা, জ্বালানি তেল, এলএনজি এমনকি পারমাণবিক ফুয়েলও। স্বল্প সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান করতে গিয়ে জ্বালানি তেলভিত্তিক ভাড়া দ্রুত ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ছাড়া উপায় ছিল না। দীর্ঘমেয়াদে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর মাধ্যমে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনার পরিকল্পনাও হাজির করা হয়। স্থানীয় উৎস থেকে কয়লা উত্তোলন সময়সাপেক্ষ বলে এক্ষেত্রে আমদানিনির্ভর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।

আন্তর্জাতিক জ্বালানির বাজার সবসময়ই দোদুল্যমান। ফলে কোনো পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় বিষয়টি বিবেচনায় রেখে একক জ্বালানিনির্ভরতা এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধান আহরণকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিতে হবে। বাংলাদেশে জল স্থলভাগে আরো গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জ্বালানি ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা নিশ্চিত করতে হলে গ্যাস অনুসন্ধান উত্তোলনের কাজ বেগবান করতে হবে। সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোকে আকর্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক বিশেষায়িত কোম্পানির সাহায্যে একটি সিসমিক জরিপ ডাটা প্যাকেজ তৈরি করা আবশ্যক। কারণ সাগরের গ্যাস দেশের জ্বালানি সংকট লাঘবে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। মিয়ানমার ভারত তাদের সমুদ্রসীমায় গ্যাস সম্পদ আবিষ্কার আহরণ করে চলেছে। বাংলাদেশ তার সমুদ্রসীমায় আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোকে আকর্ষণ করতে না পারার অন্যতম কারণ মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভেনির্ভর ডাটা প্যাকেজের অভাব। বিষয়ে সরকারের উচ্চমহলের হস্তক্ষেপ আবশ্যক।

আমদানীকৃত এলএনজির কারণেই গ্যাসের দাম দফায় দফায় বাড়ছে। এছাড়া দেশের অধিকাংশ জ্বালানি যেমনকয়লা, জ্বালানি তেলসহ সবকিছু আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ায় ভবিষ্যতে জ্বালানি খাত আরো ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে। এরই মধ্যে এলএনজির দাম পরিশোধ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সরকারি গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো। এর আগে সঞ্চিত কোষাগারে হাত দিতে হচ্ছে তিতাসকে এলএনজির মূল্য পরিশোধে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। প্রতিষ্ঠানকে উদ্ধারে সরকারকে অর্থের জোগান দিতে হচ্ছে। সর্বোপরি ব্যয়বহুল আমদানিনির্ভর জ্বালানিনির্ভরতা টেকসই অর্থনীতি উন্নয়নের সহায়ক নয়। সরকার যেখানে রফতানিনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছে, সেখানে উৎপাদন ব্যয়কে আন্তর্জাতিক মানের পর্যায়ে রাখতে হবে। আর সেটি অর্জন করতে অবশ্যই প্রতিযোগিতামূলক দামে নিরবচ্ছিন্ন মানসম্পন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, যা আমদানিনির্ভরতার মাধ্যমে সম্ভব নয়। বাংলাদেশকে যদি এলএনজি আমদানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হতে হয়, নির্মিতব্য বৃহৎ কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যদি শুধু আমদানি করা কয়লার ওপর নির্ভরশীল হয়, যদি আমদানি করা তেলের ওপর বাড়তি নির্ভরশীলতা কমানো না যায় এবং যদি নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে না বাড়ানো যায়, তাহলে নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের ৯০ শতাংশের বেশি হবে আমদানিনির্ভর। এতে জাতীয় অর্থনীতির ওপর যে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে, তা নিঃসন্দেহে উদ্বেগের বিষয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন