এক মাসের মাথায়ই তালেবানদের গৃহবিবাদ

বণিক বার্তা ডেস্ক

আগস্টের ১৫ তারিখ কাবুল দখলের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেয় সশস্ত্র গোষ্ঠী তালেবান। এরপর সরকার গঠনে লাগে তিন সপ্তাহেরও বেশি সময়। দখলের পর দীর্ঘদিনেও নতুন সরকারের ঘোষণা না দেয়ায় আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা দলটির অভ্যন্তরে নেতাদের দ্বন্দ্বের বিষয় অনুমান করেছিলেন। যদিও তালেবানদের পক্ষ থেকে বলা হয়, মার্কিনসহ বিদেশী সেনা নাগরিকদের আফগানিস্তান ত্যাগের পরই নতুন সরকারের ঘোষণা দেয়া হবে। ৩১ আগস্ট ডেডলাইন মেনে বিদেশী সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন হলেও তালেবানদের সরকার গঠনে লেগে যায় আরো সাত দিন। দুই দফা ঘোষণার তারিখ পরিবর্তন করে অবশেষে সেপ্টেম্বর জানানো হয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হবেন মোল্লা মো. হাসান আখুন্দ। অনুমিতভাবেই সরকার পরিচালনায় কোনো পদেই দেখা যায়নি তালেবানদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদাকে। তবে কাতারের রাজধানী দোহায় অবস্থিত তালেবানদের রাজনৈতিক অফিস-প্রধান আবদুল গনি বারাদারকে ভাবা হচ্ছিল তালেবান প্রশাসনের সম্ভাব্য প্রধান হিসেবে। সে অনুমানকে মিথ্যা প্রমাণ করে সরকারপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করা হয় মোল্লা মো. হাসান আখুন্দকে। আবদুল গনি বারাদার হন সরকারের উপপ্রধান।

অবশেষে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের অনুমানের যথার্থতা পাওয়া গেল। শীর্ষ নেতাদের বিরোধ শেষ পর্যন্ত সামাল দিতে পারেনি তালেবান। নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাত দিয়ে গতকাল ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, তুমুল বাগিবতণ্ডায় জড়িয়েছেন তালেবান সরকারের উপপ্রধান আবদুল গনি বারাদার শরণার্থীবিষয়ক মন্ত্রী এবং হাক্কানি নেটওয়ার্ক নেতা খলিল-উর-রহমান হাক্কানি। এমনকি রাগে-ক্ষোভে বারাদার প্রেসিডেন্ট ভবন ত্যাগ করে কান্দাহারে চলে যান। ঘটনাটি খোদ প্রেসিডেন্ট প্রাসাদেই ঘটেছে।

দলটির জ্যেষ্ঠ নেতাদের বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, নতুন সরকার গঠনের পরদিন বাগিবতণ্ডার ঘটনাটি ঘটে। তারা জানান, দুই নেতার পক্ষে তাদের সমর্থকরাও বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। আফগান যুদ্ধে জয়ের কৃতিত্ব এবং সরকারের কর্তৃত্ব নিয়ে বিবাদ তৈরি হয়। গত কয়েকদিনে কাবুলে দলটির সহপ্রতিষ্ঠাতা আবদুল গনি বারাদারের রহস্যজনক অনুপস্থিতির কারণে দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের বিষয়টি সামনে আসে।

গত মাসে আফগানিস্তানের দখল নেয়ার পর দেশটিকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে তালেবান। নারীবিহীন নতুন সরকারের নেতৃত্বে আছেন আফগানিস্তানে গত দুই দশকে মার্কিনসহ বিদেশী বাহিনীকে লক্ষ্য করে পরিচালিত ভয়ংকর হামলার পেছনে জড়িত নেতারা।

তালেবানদের এক নেতা বিবিসি পশতুকে জানান, প্রেসিডেন্ট প্রাসাদেই সরকারের উপপ্রধান দলের সহপ্রতিষ্ঠাতা আবদুল গনি বারাদারের সঙ্গে হাক্কানি নেটওয়ার্কের জ্যেষ্ঠ নেতা শরণার্থীবিষয়ক মন্ত্রী খলিল-উর-রহমান হাক্কানির উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। সময় তাদের সমর্থকরাও বিবাদে লিপ্ত হন। নেতাদের বিভেদের খবরটি কাতারে অবস্থানরত তালেবান নেতা এবং ঘটনার সময় প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে উপস্থিত ছিলেন, এমন ব্যক্তিরাও নিশ্চিত করেছেন। সূত্রের বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, সরকারের নতুন উপপ্রধান আবদুল গনি বারাদার অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত কাঠামোতে সন্তুষ্ট নন। এর সঙ্গে যুক্ত হয় তালেবানদের বিজয়ে মূল কৃতিত্ব কার, প্রসঙ্গ। বারাদার মনে করেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কূটনৈতিক তত্পরতাই ছিল তালেবানদের দ্রুত অপ্রতিরোধ্য বিজয়ের প্রধান কারণ। এসব কূটনৈতিক তত্পরতায় নেতৃত্ব দিয়েছেন বারাদার। তিনি কাতারের রাজধানী দোহায় অবস্থিত তালেবানদের রাজনৈতিক অফিসের প্রধান। বারাদারই প্রথম তালেবান নেতা, যিনি ২০২০ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। এর আগে সেনা প্রত্যাহারে চুক্তি করা (যে চুক্তির ডেডলাইন মেনে মার্কিনসহ বিদেশী সেনাদের আফগানিস্তান ত্যাগ), তালেবানদের ক্ষমতা দখলের আগে চীন সফর এবং দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়াং ইর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে তিনিই তালেবান প্রতিনিধিদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এজন্য বারাদারের সমর্থকরা মনে করেন তালেবানদের জয়ের পেছনে মূল কৃতিত্ব কূটনৈতিক প্রচেষ্টার।

অন্যদিকে আফগানিস্তানজুড়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীসহ বিরোধী শক্তির ওপর নারকীয় হামলার পেছনে জড়িত সিরাজুদ্দিন হাক্কানির নেতৃত্বাধীন হাক্কানি নেটওয়ার্ক। ২০১৭ সালে কাবুলে ট্রাকবোমা হামলায় দেড়শ মানুষের মৃত্যু হয়। এছাড়া সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইকে হত্যাচেষ্টাসহ ভয়ংকর সব হামলায় নেপথ্য কুশীলব মনে করা হয় হাক্কানি নেটওয়ার্ককে।

কাবুল দখলের পর রাজধানী রক্ষার দায়িত্বও দেয়া হয় এই হাক্কানি নেটওয়ার্কের সদস্যদের। তাদের প্রধান সিরাজুদ্দিন হাক্কানি হন নতুন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আর সিরাজুদ্দিন হাক্কানির চাচা খলিল-উর-রহমান হাক্কানি হলেন শরণার্থীবিষয়ক মন্ত্রী। তাই সরকারে নেটওয়ার্কের প্রাধান্য রয়েছে বলে মনে করা হয়। গ্রুপটির নেতারা মনে করেন, আফগানিস্তানের মাটিতে হামলার পর হামলায় মার্কিন বাহিনী পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হয়েছে।

বিতণ্ডার ঘটনার পর পরই আবদুল গনি বারাদার নিহতের গুজবও ছড়ায়। যদিও তালেবানের পক্ষ থেকে বিষয়টি অস্বীকার করে বারাদারের অডিও বার্তা প্রচার করা হয়। সূত্রের বরাত দিয়ে বিবিসির দাবি, ঘটনার পর পরই আবদুল গনি বারাদার কাবুল ত্যাগ করেন এবং কান্দাহার চলে যান। তবে তালেবানদের পক্ষ থেকে দ্বন্দ্বের বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে। প্রথমে সর্বোচ্চ নেতা হাইবাতুল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের কথা বলা হলেও দলটির মুখপাত্র জানিয়েছে, আবদুল গনি বারাদারের কান্দাহার গমনের উদ্দেশ্য বিশ্রাম নেয়া।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন