লাল অঞ্চলের খোঁজে এডগার স্নো

আনু মুহাম্মদ

১৯৩৬ সালে চীনের ইউয়ানে মাও সে তুংয়ের সঙ্গে মার্কিন সাংবাদিক ও লেখক এডগার স্নো

পিপলস রিপাবলিক অব চায়না। জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্র। ইরান, ভারত ইনকা, মায়ার মতো প্রাচীন চীনের সভ্যতা। ১৯৪৯ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লবের পর এক নতুন চীনের যাত্রা হয়। নানা রকম সংস্কার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান বিশ্বে চীন অন্যতম এক পরাশক্তি। জিডিপির হিসাবে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফসল নয়া চীন এখন পুঁজিবাদী বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্র। ঐতিহাসিক বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে চীনের শক্তি-দুর্বলতা, সাফল্য-ব্যর্থতা ধারাবাহিক পরিবর্তনগুলো নিয়ে লিখেছেন আনু মুহাম্মদ

১৬ অক্টোবর ১৯৩৪- শুরু হয়ে ২২ অক্টোবর ১৯৩৫ পর্যন্ত চীনা কমিউনিস্ট পার্টির লালফৌজের যে লংমার্চ কর্মসূচি চলে, তা সারা বিশ্বের বিপ্লবী আন্দোলনের জন্যই এক অনন্য অভিজ্ঞতা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে লংমার্চ পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল পশ্চাদপসরণের কৌশল হিসেবে, এর মধ্য দিয়েই উদ্ভাবিত হয়েছিল লড়াইয়ের নতুন এক পদ্ধতি। চিয়াং কাই শেকের বিশাল সেনাবাহিনীর উপর্যুপরি আক্রমণে পরাজিত-বিপর্যস্ত হয়ে পার্টি বাহিনী যখন পশ্চাদপসরণ করছে, তার এক পর্যায়ে চীনের পশ্চিম উত্তর দিকে পশ্চাদপসরণকে নতুন অঞ্চল আবিষ্কার, নতুন জনপদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন, নতুন নতুন স্থানে মুক্তাঞ্চল বা সোভিয়েত গঠনের কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত করা হয়। মাও সে তুং, চু তে এবং চৌ এন লাইয়ের নেতৃত্বে ৩৭০ দিনে লংমার্চ অতিক্রম করে ছয় হাজার মাইলেরও বেশি। কয়েকটি ভাগে যাত্রা অব্যাহত থাকে। যাত্রাপথে বেশ কয়েকবার চিয়াং বাহিনীর বড় ধরনের আক্রমণের মুখোমুখি হতে হয়েছে বিপ্লবী বাহিনীকে।

কখনো কৌশলে কখনো সম্মুখসমরে চিয়াং বাহিনীকে মোকাবেলা করেছে লালফৌজ। হতাহত হয়েছেন অনেকে। পথে অনেকে যোগ দিয়েছেন, অনেকে নিহত হয়েছেন, অনেকে কষ্টকর যাত্রা থেকে সরে গেছেন। যেখানে লালফৌজ অবস্থান নিয়েছে, সেখানে নতুন প্রশাসন, ভূমি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, নতুন আইন-কানুন চালু হয়েছে। এসব খবরাখবর বহির্বিশ্বে অজানাই ছিল। যতটুকু প্রকাশিত হতো তার বড় অংশজুড়ে ছিল লাল বর্বরতা খবর।

১৯৩৫ সালে চিয়াং কাই শেক ঘোষণা দিয়েছিলেন, কমিউনিস্ট দস্যুদের বিনাশ করা হয়েছে। কিন্তু কার্যত ততদিনে লাল অঞ্চল আরো বিস্তৃত হয়েছে। জাপান চিয়াং কাই শেককে জার্মানি জাপানসহ এশিয়ায় বলশেভিকীকরণ ঠেকাতে লালবিরোধী চুক্তি সম্পাদন করার প্রস্তাব দেয়। মাঞ্চুরিয়া দখলের পর জাপান আরো দাবি করছিল চীনকে উত্তর দক্ষিণে ভাগ করতে। অন্যদিকে কমিউনিস্ট পার্টি বরাবরই চিয়াং কাই শেককে জাপানের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট করে লড়াইয়ে আহ্বান জানিয়েছে। পার্টির অবস্থান এবং জাপানি আধিপত্যের বিরুদ্ধে তাদের একটানা লড়াই চিয়াংয়ের সেনাবাহিনীতে ছোট-বড় অনেক ভাঙনও সৃষ্টি করে।

মার্কিন সাংবাদিক এডগার স্নো সোভিয়েত বা লাল অঞ্চলের খোঁজে পিকিং (বর্তমান বেইজিং) থেকে যাত্রা করেন ১৯৩৬ সালের জুন মাসে। পিকিংয়ে এমনিতে বিদেশীদের প্রাসাদগুলোতে চীনজুড়ে এতসব যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, বিদেশী আগ্রাসনের কিছুই টের পাওয়া যেত না। কিন্তু পিকিংয়ের তরুণদের কাছে যে এসব খবর ঠিকই গেছে তার বড় প্রমাণ হাজির হয় ১৯৩৫ সালের শেষে এক তরুণ জমায়েতে। এডগার স্নো সমাবেশে হাজির ছিলেন, যেখানে জমায়েত হয়েছিল ১০ হাজারেরও বেশি তরুণ। সমাবেশে স্লোগান ছিল, জাপান রুখো! চীনকে ভাগ করার জাপান সাম্রাজ্যবাদের দাবি প্রত্যাখ্যান কর! চিয়াংয়ের আক্রমণাত্মক সেনাবাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে, মৃত্যু আর গ্রেফতারের ঝুঁকি নিয়ে তরুণরা স্লোগান দিচ্ছিল, গৃহযুদ্ধ বন্ধ কর! জাপানকে ঠেকাতে কমিউনিস্টদের সহযোগিতা কর! চীনকে বাঁচাও!

এডগার স্নোর যাত্রা হয় ট্রেনে। কাছে ছিল আত্মগোপনে থাকা পার্টির এক নেতার চিঠি। অদৃশ্য কালিতে লেখা। দুই দিন দুই রাত কষ্টকর যাত্রার পর স্নো পৌঁছান জিয়ানফু। এর থেকে ১৫০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে শুরু লাল সোভিয়েত অঞ্চল শেনসি। ট্রেনে যাত্রীদের সঙ্গে কথাবার্তার বর্ণনা দিয়েছেন স্নো। তরুণ বৃদ্ধ যাত্রী দুজন মাঝেমধ্যে কমিউনিস্টদের সমালোচনা করছিল। আবার একটি অঞ্চলে ডাকাতদের কথাও বলছিল। ডাকাতদের সম্পর্কে একজনকে স্নোর প্রশ্ন দিয়ে আলাপ শুরু হলো

: ডাকাত মানে কি লালদের কথা বলছেন?

: না, না। ওই অঞ্চলে লালরাও আছে। তবে আমি বলছি ডাকাতদের কথা।

: কিন্তু লালরাই কি ডাকাত নয়? এখানকার খবরের কাগজে তো সবসময় ডাকাত বলতে কমিউনিস্টদেরই বোঝানো হয়।

: তা ঠিক। তবে আপনার অবশ্যই জানতে হবে যে সম্পাদকরা এভাবে খবর দিতে বাধ্য, কেননা এটাই নির্দেশ। তারা যদি ডাকাত না বলে তাদের কমিউনিস্ট বা বিপ্লবী বলে তাহলে তারাই কমিউনিস্ট বলে চিহ্নিত হবে।

: কিন্তু আমি শুনেছি জিচুয়ানে মানুষ ডাকাতদের মতোই লাল বা বিপ্লবীদেরও ভয় করে।

: হ্যাঁ, এটা নির্ভর করে। ধনীরা, যেমন জোতদার-আমলারা তাদের ভয় করে। কিন্তু কৃষকরা তাদের ভয় করে না, বরং তারা চায় যে সেখানে লালরা যাক। তারা ভাবে লালরা যা বলছে তাই করবে। ওরা ওদের বিশ্বাস করে।

: লালরা কি যা বলে তা করে না?

: আমার বাবা লিখেছেন যে কমিউনিস্টরা জিচুয়ানের অনেক এলাকায় মহাজনী এবং আফিম চাষ বন্ধ করেছে, ভূমি সংস্কার করে তা গরিবদের মধ্যে বিতরণ করেছে। তার মানে তারা ঠিক ডাকাত নয়। কিন্তু তারাও দুষ্ট, অনেক মানুষ তারা হত্যা করেছে।

ঠিক সময়ে পাশে এতক্ষণ চুপচাপ থাকা পাকা চুলের আরেকজন মানুষ মুখ তুললেন এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে বললেন, শা পু কৌ মানে,

: যত করা উচিত তত তারা হত্যা করছে না!

কথা আর অগ্রসর হলো না। কেননা ট্রেন ততক্ষণে গন্তব্যে পৌঁছে গেছে।

লাল সোভিয়েতমুক্ত অঞ্চলে

লংমার্চ কালে লালফৌজের সঙ্গে চিয়াং কাই শেক বাহিনীর মুখোমুখি যুদ্ধ হয়েছে কয়েকবার। লংমার্চকে ঠেকানো যায়নি। তবে দুই পক্ষেই হতাহতের সংখ্যা অগুনতি। অগ্রগতি ঠেকাতে না পেরে চিয়াং কাই শেক যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছেন। লালফৌজ পার্টি নেতৃত্ব তখন একটি সোভিয়েত অঞ্চলে স্থিত। ১৯৩৬ সালের সময়েই এডগার স্নো সেই অঞ্চলের পথে যাচ্ছেন। যুদ্ধবিরতি চললেও সমরপ্রভু বৃহৎ জোতদারদের সশস্ত্র বাহিনীর আক্রমণ অব্যাহতই ছিল। জাপান চীনে কৃষক বিদ্রোহ দমনে সামন্তপ্রভুদের এসব বাহিনী কাজে লাগানো ছিল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।

এর পাশাপাশি কুৎসা অপপ্রচার ছিল অবিরাম। কমিউনিস্টরা ডাকাত, মাংস খায় এসব প্রচারণার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি জোরদার প্রচার চলছিল যৌনতা নিয়ে। প্রচার হচ্ছিল, সোভিয়েত অঞ্চলে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি নৈতিকতা ধ্বংস করে দিচ্ছে, সেখানে জমি যেমন যৌথ বা সাধারণ মালিকানায় আনা হয়েছে, মেয়েদেরও তেমন যৌথ মালিকানায় আটকে রেখে অবাধ যৌনাচার চালানো হচ্ছে। এসব কথাবার্তায় কুওমিনটাংয়ের সংবাদপত্রও পিছিয়ে ছিল না। এসব প্রচারে সমাজ রক্ষা করার জন্য, নারীর মর্যাদা রক্ষার জন্য, লাল দস্যুদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। নারীকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে বিচার করার কারণে তাদের অনেকে বিশ্বাসও করতনিশ্চয়ই অন্যান্য ব্যক্তিগত সম্পত্তি মতো নারীও যৌথ মালিকানায় গেছে। রকম যুক্তি মার্ক্সের বিরুদ্ধে তোলা হয়েছিল এর প্রায় ১০০ বছর আগে। মার্ক্স কমিউনিস্ট ইশতেহারে এর জুতসই জবাব দিয়েছিলেন।

যা- হোক, এসব কুৎসায় শেষ পর্যন্ত কাজ হয়নি, ধোপে টেকেনি, কারণ প্রকৃত খবরাখবর মুখে মুখে প্রবাহিত হচ্ছিল, বরং বিভিন্ন স্থানে চিয়াংয়ের সেনাবাহিনীর মধ্য থেকেই বিদ্রোহ হচ্ছিল। বিশেষত যখন জাপানি আগ্রাসন না ঠেকিয়ে জাপান আগ্রাসনবিরোধী কমিউনিস্টদের ওপর হামলা চালানোর কোনো যৌক্তিকতা তারা খুঁজে পাচ্ছিল না তখনই ক্ষোভ, প্রশ্ন থেকে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটছিল। এডগার স্নো লাল অঞ্চলের দিকে যেতে চিয়াংয়ের সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত এলাকা একের পর এক পার হয়েছেন। এর মধ্যে এক জেনারেলের সন্ধান পেয়েছেন, যিনি লালফৌজে যোগদানের জন্য তখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন, লাল কেন্দ্রের সঙ্গে তার যোগাযোগ চলছে। লাল অঞ্চলের দিকে হেঁটে যেতে যেতে দুর্গম পথে একবার চা খেতে থেমেছেন স্নো। সেখানে কয়েকজন চিয়াং সৈনিকও বিশ্রামে ছিল, তাদের নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছিল রকম,

: ওরা তো মনে হয় আমাদের থেকে ভালো আছে, ভালো খাচ্ছে।

: হ্যাঁ, ওরা খাচ্ছে জোতদারদের...

: সেটা তো খুব ভালো কথা। আমরা কেন ধনীদের জন্য নিজেরা নিজেরা খুনোখুনি করছি? কে আমাদের এর জন্য বাহ্বা দেবে?

: তাই। জাপানিদের না মেরে কেন আমরা নিজেদের মানুষদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি?

অফিসার এসে তাড়াতাড়ি কথা বন্ধ করলেও বোঝা যাচ্ছিল পুরো ভাব বদলে যাচ্ছে।

লাল অঞ্চলের শুরু থেকেই তার ভিন্ন রাজনীতি বোঝা যাচ্ছিল। দেয়ালে দেয়ালে লেখা আঁকা ছবি। বিভিন্ন স্থানে যে স্লোগানগুলো লেখা ছিল সেগুলোর মধ্যে ছিল,

: পতন হোক জোতদারদের যারা আমাদের মাংস খায়।

: পতন হোক সেই সেনাবাহিনীর যারা আমাদের রক্ত খায়।

: পতন হোক বিশ্বাসঘাতকদের যারা চীনকে জাপানের কাছে বিক্রি করে।

: জাপানবিরোধী সব বাহিনীর ঐক্যফ্রন্ট চাই।

: চীনা বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।

: চীনা লালফৌজ দীর্ঘজীবী হোক।

লাল অঞ্চলে প্রবেশ করলেও আক্রমণের ভয় ছিলই, কেননা সুযোগ পেলেই বিভিন্ন স্থানে জোতদারদের সশস্ত্র বাহিনী আক্রমণ করছিল। গ্রামের পর গ্রাম, মাঝে মাঝে ঝরনা। আবাদি জমি। তবে দুদিন এসব অঞ্চল পার হওয়ার পরও যুদ্ধের কোনো চিহ্ন দেখতে পাননি স্নো। তখন কৃষক আর লালফৌজ সদস্যদের আলাদা করার উপায় নেই। পুকুরে গোসল করা ২০-২২ বছরের এক তরুণ এসে নিজের পরিচয় দিলেন, গ্রামপ্রধান। সেখানে স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র নতুনভাবে সজ্জিত।

পথে চলতে চলতে এক গ্রামে এডগার স্নোকে দাঁড়াতে হলো দুপুরের খাবারের জন্য। শিশু-কিশোররা ভিড় করে দাঁড়াল প্রথম দেখা এক বিদেশী শয়তান দেখতে। তাদের সঙ্গে স্নোর সংলাপ চেষ্টার উত্তরে -১০ বছরের একজন এগিয়ে এল। স্নো জিজ্ঞেস করল,

: কমিউনিস্ট মানে কী?

: কমিউনিস্ট মানে সেই মানুষ যে শ্বেত দস্যু (চিয়াং বাহিনী) এবং জাপানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লালফৌজকে সহায়তা করে।

: আর কী করে?

: সে জোতদার আর পুঁজিপতির বিরুদ্ধে কাজ করে।

: পুঁজিপতি মানে কী?

চুপ করে গেল প্রথমজন। আরেকজন একই বয়সী এগিয়ে এল। বলল,

: পুঁজিপতি হচ্ছে সে রকম লোক যে নিজে কাজ করে না কিন্তু অন্যদের কাজ করায় আর নিজে পুরো লাভটা নেয়।

: অঞ্চলে কি জোতদার-পুঁজিপতি কেউ আছে?

সবাই একসঙ্গে চিত্কার করে উঠল,

: না। ওরা সব ভয়ে ভাগছে।

: কার ভয়ে?

: আমাদের লালফৌজের ভয়ে।

 [চলবে]

 

আনু মুহাম্মদ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন