কভিড-১৯ পরিবর্তিত ব্যবসায়িক সংস্কৃতি ও অনলাইন ব্যবসার বিস্তৃতি

আয়েশা সিদ্দিকা শেলী

কভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারী সারা পৃথিবীতে সব ক্ষেত্রে এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যে আধুনিক সভ্যতার ইতিহাসে হয়তো এমনতর দুঃসময় আর আসেনি। বিশ্বব্যাপী সমাজ, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতিতে একটি আমূল পরিবর্তন এনেছে; যা মানুষকে  পারস্পরিক দূরত্ব তৈরি এবং সামাজিকভাবে সতর্ক থাকার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে।

সামাজিক দূরত্ব বাশারীরিক দূরত্ব, যা বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে নিশ্চিত করা যেমন দুরূহ, তেমনি অর্থনীতি সচল রাখা অত্যন্ত কঠিন।

এতদিন বিশ্ব অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি ছিল শিল্প উত্পাদন এবং দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল কৃষি। আমাদের দেশে শিল্প বিপ্লব তেমনভাবে না ঘটলেও গত ৪০ বছরে গার্মেন্ট শিল্প বিকাশ লাভ করেছে এবং বিপুলসংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। ধারণা করা হয়েছিল বিদেশে রফতানি বন্ধ হয়ে গেলে খাতের ছোট ছোট কোম্পানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যা নিম্ন আয়ের মানুষের কর্মসংস্থানে প্রভাব ফেলতে বাধ্য। কিন্তু ধারণা ভুল প্রমাণিত করে গার্মেন্ট শিল্প অত্যন্ত দাপটের সঙ্গে চালু আছে সরকারি প্রণোদনা উন্নত বিশ্বের চাহিদা থাকার কারণে। মূলত করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাঝারি শিল্প ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। এছাড়া যোগাযোগ, পরিবহন, সিনেমা, শিল্পজগত্সহ অন্যান্য খাতও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবসাও নিম্নমুখী। আর ব্যাংকিং খাত সবসময় দেশের অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল। প্রেক্ষাপটে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা অপরিহার্য। তাই সংগত কারণেই শুরু হয়েছে অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা। এরই ধারাবাহিকতায় করোনা মহামারী পরিস্থিতিতে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে এসেছে নানা পরিবর্তন। করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমাতে টিকাদানে অধিক গুরুত্ব দিয়ে মহামারীকালে জরুরি প্রয়োজন মেটাতে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে এবং স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি হয়েছে লাখ হাজার কোটি টাকা। মোট বাজেটের ১৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ বিভিন্ন ভাতার আওতা বেড়েছে। যেমন দরিদ্র, প্রবীণ, বিধবা প্রতিবন্ধী ভাতা প্রবর্তন হয়েছে। কৃষিতে ভর্তুকি বাবদ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কৃষি যন্ত্রপাতি উত্পাদনে বিনিয়োগে ১০ বছর করমুক্তির সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। কৃষি খাতের প্রধান উপকরণগুলো, যেমন সার, বীজ, কীটনাশক আমদানিতেও শূন্য শুল্কহার অব্যাহত রাখা হয়েছে। কৃষি, ফিশারিজ, বিজ্ঞান, আইটি, পোলট্রি, ফার্মিং খাতে ১০ বছরের জন্য কর অব্যাহতির সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। করপোরেট কর কমেছে, যেমন পুঁজিবাজারে তালিকাবহির্ভূত বা সাধারণ কোম্পানির করহার ৩২ দশমিক শতাংশ থেকে বাজেটে দশমিক শতাংশ কমিয়ে ৩০ শতাংশ এবং পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের কর কমিয়ে ২২ দশমিক শতাংশ করা হয়েছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বাজেটে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, চট্টগ্রাম জেলার বাইরে অন্যান্য শিশু এবং নবজাতক, নারী মাতৃমঙ্গল, অনকোলজি, ওয়েলবিং প্রিভেনটিভ মেডিসিন ইউনিট থাকা সাপেক্ষে ন্যূনতম ২৫০ শয্যার সাধারণ  হাসপাতাল এবং ন্যূনতম ২০০ শয্যার বিশেষায়িত হাসপাতাল স্থাপিত হলে ১০ বছরের জন্য কর অব্যাহতি পেয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে আইটি খাতে কর অব্যাহতি সুবিধা সম্প্রসারণ করা হয়েছে। আইটি হার্ডওয়্যার বাংলাদেশে উত্পাদন করলে ১০ বছর কর অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। কমেছে খাতে ন্যূনতম কর। পাইকারি, ব্যবসায়ী, পণ্য পরিবেশক, ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতি টার্নওভার কোটি টাকার বেশি হলে বিদ্যমান দশমিক ৫০ শতাংশ কর দশমিক ২৫ শতাংশ করা হয়েছে এবং নতুন শিল্পের ক্ষেত্রে উত্পাদন শুরুর পরবর্তী তিন বছর ন্যূনতম কর দশমিক ১০ শতাংশ করা হয়েছে। নারী উদ্যোক্তাদের ওপর কর ছাড় ৫০ লাখ থেকে শূন্য ছিল, যা ৭০ লাখ টাকা পর্যন্ত শূন্য করা হয়েছে।

করোনা মহামারীকালে বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তারা কতখানি ব্যবসা করতে পেরেছেন, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে করোনা মোকাবেলায় যা আছে

. ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ; . স্বাস্থ্য খাতে মোট ব্যয়ের দশমিক শতাংশ বরাদ্দ; . করোনার টেস্টিং, কিট, মাস্ক, ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীর কাঁচামাল সম্পূর্ণ শুল্কমুক্ত; . চিকিত্সাসামগ্রী জীবাণুমুক্তকরণে স্থানীয়ভাবে উত্পাদনে কাঁচামাল আমদানিতে কর রেয়াত; . করোনায় দায়িত্ব পালনে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় বিশেষ বরাদ্দ; . বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে হাজার ১২৭ কোটি এবং এডিবির অর্থায়নে হাজার ৩৬৬ কোটি টাকার প্রকল্প; . লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ; . পল্লী সমাজসেবা কার্যক্রমের জন্য ১০০ কোটি টাকা প্রণোদনা।

নানা সুযোগ-সুবিধা সংবলিত বাজেটে অনলাইনভিত্তিক ব্যবসার ক্ষেত্রে কোনো দিকনির্দেশনা দেয়া হয়নি। কিন্তু পরিস্থিতিতে অনলাইন ব্যবসা সব সেক্টরে বিরাজমান। অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা কীভাবে সর্বজনীনভাবে পরিবর্ধন সহজ করা যায় এবং এটিকে কীভাবে আয়করের আওতাভুক্ত করা যায়, সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা জরুরি।

বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের কারণে দেশের অর্থনীতিতে যেমন এক ধরনের ধস নেমেছে, তেমনি ছোট-বড় অনেক ব্যবসায়ী লাভও করেছেন। বাজারে নতুন তৈরি হওয়া চাহিদা মাথায় রেখে কিছু ক্ষুদ্র মধ্যম উদ্যোক্তাও ভালো ব্যবসা করেছেন। সবজি, ফল, নাশতা, সুরক্ষাসামগ্রীসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় যাবতীয় জিনিসের খুব ভালো মুনাফা হয়েছে। সুপারশপ আর পাড়া বা মহল্লার দোকানে যখন সংক্রমণের ভয়ে মানুষ যেতে ভয় পেয়েছে তখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ফেসবুকে পেজে বিজ্ঞাপন দিয়ে অনেক আইটেমের অনেক ভালো ব্যবসা করেছে। কুরিয়ার সার্ভিসগুলো ব্যস্ত ছিল ব্যবসার সঙ্গে। মহামারীর কারণে যখন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা স্বল্প পুঁজির ব্যবসায়ীদের টিকে থাকাটা বড় চ্যালেঞ্জ তখন প্রযুক্তিনির্ভর অনলাইন ব্যবসা অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। এর ইতিবাচক দিক হচ্ছে, এর সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে যেমন ডেলিভারি, পরিবহন খাতে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে এবং সেই সঙ্গে তৈরি হয়েছে ঘরে বসে সেবা প্রাপ্তির সুবিধা। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর এসব উদ্যোগকে যেমন নিষ্ঠার সঙ্গে পণ্যের মান নিশ্চিত করতে হবে, সেই সঙ্গে তাদের সফল উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য সহজ শর্তে ব্যাংকঋণ যেমন প্রয়োজন, সেই সঙ্গে তাদের আয়করের আওতাভুক্ত করাও প্রয়োজন। দেশের অর্থনীতি মূলত সব ক্ষেত্রে অপ্রাতিষ্ঠানিক থেকে প্রাতিষ্ঠানিক করা প্রয়োজন। দুই বছর আগে বাংলাদেশ সরকার ব্যাংকের মাধ্যমে প্রবাসী আয় আনার জন্য শতাংশ প্রণোদনা দেয়, ফলে বিদেশ থেকে প্রবাসীরা আগের চেয়ে বেশি টাকা পাঠাচ্ছেন। তারা আগেও পাঠাতেন কিন্তু হুন্ডির মাধ্যমে। সরকার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সেই অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে নিয়ে এসেছে। অনলাইন কেনাকাটা ব্যবসার ক্ষেত্রে সরকারিভাবে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। হোটেল-রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন ধরনের ফাস্টফুডের দোকানের আয় ব্যয় নিরূপণ করে তাদের আয়করের আওতায় কীভাবে আনা যায়, সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা প্রয়োজন। ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু এরা করদাতা শনাক্তকরণের আওতায় এখনো আসেনি। মূলত তারা বড় অংকের কর ফাঁকি দিচ্ছে। অনলাইন ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা আবশ্যক। করোনা মহামারীতে অনলাইনে মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। অন্যান্য দেশে অনলাইনে পণ্য কিনলে মূল্য কম পড়ে। আর আমাদের দেশে বেশি। এটির মূল কারণ হচ্ছে ভ্যাট। ২০১৮ সালে অনলাইন কেনাকাটায় শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়। অন্যদিকে দেশের ৯০ শতাংশ দোকানপাটের ভ্যাট দিতে হয় না। এজন্য দোকানপাটের চেয়ে অনলাইনে কেনাকাটায় বেশি খরচ হয়।

ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ সাভারের আটটি বিপণিবিতানে ভ্যাট গোয়েন্দা তদন্ত অধিদপ্তরের এক জরিপে দেখা গেছে, ৮৮ শতাংশ দোকান ভ্যাট দেয় না। ঢাকা তার আশপাশের এলাকায় অবস্থা হলে মফস্বলের চিত্র আরো করুণ হবে। সে কারণে অনলাইন কেনাকাটায় আগামী দু-তিন বছরের জন্য ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হলে খাতটি বেড়ে ওঠার সুযোগ পাবে।

জানা যায়, দেশে ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা তিন লাখের বেশি। এগুলোর মধ্যে ৫০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী নারী। প্রতিষ্ঠানগুলো মাসে ১০ হাজার থেকে লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করে। সব মিলিয়ে ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসার পরিমাণ বর্তমানে ৩৫০ কোটি টাকার বেশি। অন্যদিকে -কমার্সভিত্তিক ব্যবসার আকার ২০৭ কোটি ডলারের বা ১৭ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকার। এখানে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি। তারা সম্মিলিতভাবে প্রতিদিন ৩০ হাজার ক্রয়াদেশ সরবরাহ করছে সারা দেশে। -কমার্সের ক্রেতাদের ৮০ শতাংশ শহরকেন্দ্রিক। বর্তমানে অনেক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানও অনলাইন ব্যবসা চালু করেছে। বছর  কোরবানির পশুও অনলাইনভিত্তিক কেনাকাটা হয়েছে।

করোনাভাইরাসের শুরুতে ঘরবন্দি মানুষ চাল-ডাল-মাছ-মাংসের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি সুরক্ষাসামগ্রী, ওষুধ, ইলেকট্রনিক পণ্য অনলাইনে কিনতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এতে অনলাইনভিত্তিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবসাও বাড়তে থাকে। করোনা পরিস্থিতির ওঠানামার ওপর অনলাইনভিত্তিক বেচাবিক্রিও ওঠানামা করে। তবে অনলাইনে কেনাকাটায় মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। এতে খাতের সম্ভাবনাও বাড়ছে। তাই অনলাইন ব্যবসা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ অপরিহার্য করা জরুরি।

উদ্যোক্তারা বলছেন, করোনাকালে অনলাইনভিত্তিক ব্যবসার যে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেটি ধরে রাখতে বাজেটে কর অবকাশ সুবিধা, কয়েক বছরের জন্য ভ্যাট অব্যাহতির মতো নীতি সহায়তা দেয়া দরকার। তাহলে পুরনোদের পাশাপাশি নতুন উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করবেন। তাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ উন্নয়নের সব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

আয়েশা সিদ্দিকা শেলী

অতিরিক্ত কর কমিশনার প্রধান উপদেষ্টা

দ্য ব্লু স্কাই চ্যারিটেবল ফাউন্ডেশন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন