দেশে গাড়ি তৈরির উদ্যোগ

এখনই জোর দিতে হবে বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনে

শিহাবুল ইসলাম

কয়েকদিন ধরেই একটি খবর বেশ আলোচিত হচ্ছে। দেশে গাড়ি তৈরিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে বিশ্বের নামিদামি সব প্রতিষ্ঠান। এটি অবশ্যই আমাদের জন্য ভালো খবর। যদিও খবরে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ। দ্রুতগতিতে বাড়ছে অর্থনীতির আকার। স্বভাবতই অর্থনীতি উন্নত হওয়ার সঙ্গে বড় হচ্ছে গাড়ির বাজারও। লাভজনক ব্যবসার হাতছানি থেকেই অটোমোবাইল প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে গাড়ি নির্মাণ কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিচ্ছে।


এক্ষেত্রে অবশ্য সরকারের কৌশলগত পদক্ষেপও ভূমিকা রাখছে। দেশে গাড়ি আমদানিতে উচ্চ শুল্ক সংস্থাগুলোকে কারখানা স্থাপনের বিষয়টি ভাবতে বাধ্য করছে। যদিও উচ্চ শুল্ক নতুন কিছু নয়। একদিকে গাড়ির বাজার বড় হওয়ার বিষয়টি এবং অন্যদিকে কারখানা স্থাপনে সরকারের প্রণোদনা নীতি সহায়তার বিষয়গুলো ভূমিকা রাখছে।


বাংলাদেশে গাড়ি নির্মাণ কারখানা তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছে মিতসুবিশি। লক্ষ্যে জাপানি গাড়ি নির্মাতা সংস্থাটি গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ইস্পাত শিল্প করপোরেশনের (বিএসইসি) সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে। বণিক বার্তায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সমঝোতার আওতায় বিএসইসি মিতসুবিশি বাংলাদেশে মিতসুবিশি ব্র্যান্ডের গাড়ি তৈরির জন্য একটি যৌথ উদ্যোগের কোম্পানি স্থাপনের সুযোগ সম্পর্কে সমীক্ষা পরিচালনা করবে। আলোচনার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হবে যৌথ উদ্যোগে কারখানা স্থাপনের উপায়ও। ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালের মধ্যে জাপানি সংস্থাটির সাব-ব্র্যান্ড হিসেবেবাংলা কার ব্র্যান্ড চালুরও প্রত্যাশা করা হচ্ছে।


এদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হুন্দাইয়ের পক্ষ থেকেও দেশে যাত্রীবাহী গাড়ি তৈরির ঘোষণা এসেছে। গত সেপ্টেম্বর শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন এক অনুষ্ঠানে ঘোষণার কথা জানান। তিনি বলেছেন, ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশে হুন্দাই এর যাত্রীবাহী গাড়ি তৈরি হবে। লক্ষ্যে হুন্দাই ফেয়ার টেকনোলজি যৌথভাবে বাংলাদেশে হুন্দাই যাত্রীবাহী যানবাহন উৎপাদন কারখানা গড়ে তুলছে। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কে কারখানা স্থাপন করা হবে।


স্থানীয়ভাবে গাড়ি তৈরির উদ্যোগ বাংলাদেশের সামনে অপার সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে। হাজার হাজার যুবকের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি কমবে রফতানি-নির্ভরতা। স্বল্প দামে গাড়ি পাবে দেশের মানুষ। তবে দেশে অটোমোবাইল শিল্প বিস্তৃতির জোয়ারের শুরুতেই আমাদের বৈশ্বিক প্রবণতার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। জোর দিতে হবে বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনের দিকে। প্রচলিত জ্বালানি তেলচালিত ইঞ্জিনের গাড়ি উৎপাদনের পথে হাঁটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।


আর আমাদের এখন উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার সময় এসেছে। /১০ বছর নয়, বরং আগামী ৫০ থেকে ১০০ বছরের অগ্রযাত্রাকে মাথায় নিয়ে এগোতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নেয়া উদ্যোগও ত্বরান্বিত হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বিশ্বের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় অন্যতম বাংলাদেশ। সুতরাং আমাদের এমন উদ্যোগে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেবে বৈশ্বিক দাতাগোষ্ঠীও।


এদিকে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে আঞ্চলিক অটোমোবাইল শিল্প উৎপাদনের কেন্দ্রে পরিণত করতে চায় সরকার। এজন্য তৈরি করা হচ্ছেঅটোমোবাইল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা এতে পর্যায়ক্রমে পুরনো গাড়ি (রিকন্ডিশন্ড কার) আমদানি বন্ধ করে স্থানীয় উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। যদিও দেশের গাড়ির বাজারটির সিংহভাগই পুরনো গাড়ির দখলে। খাতসংশ্লিষ্টদের দাবি, মোট বিক্রি হওয়া গাড়ির ৮০ শতাংশই পুরনো। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির বাজারটি ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। বিপরীতে বাড়ছে নতুন গাড়ি বিক্রি।


আবার পূর্ণাঙ্গ বৈদ্যুতিক গাড়ি চলাচলের অবকাঠামো না থাকায় উন্নয়নশীল বিশ্বে ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে হাইব্রিড গাড়ি। গাড়ি জীবাশ্ম জ্বালানির পাশাপাশি বৈদ্যুতিক শক্তির সাহায্যেও চলতে পারে। বাংলাদেশেও ধীরে ধীরে চাহিদা বাড়ছে হাইব্রিডের। যদিও দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার নেই বললেই চলে। সরকার বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানিতে শুল্কছাড়ের ঘোষণা দিলেও দেশে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকায় সফলতা আসছে না। দেশে নেই বৈদ্যুতিক গাড়ির চার্জ দেয়ার ব্যবস্থা কিংবা সমস্যা হলে মেরামতের মতো দক্ষ জনবল। তবে এক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই।


কারণ দশকের মধ্যেই জীবাশ্ম জ্বালানির (পেট্রোল-ডিজেল) পরিবর্তে বৈদ্যুতিক গাড়ির যুগে প্রবেশ করবে বিশ্ব। আগামী দশক থেকেই বৈশ্বিক গাড়ির ব্র্যান্ডগুলো পুরোপুরি বৈদ্যুতিক হয়ে উঠার লক্ষ্য নিয়েছে। অর্থাৎ সংস্থাগুলো আর জ্বালানি তেলচালিত গাড়ি তৈরি করবে না। জলবায়ু মোকাবেলায় প্যারিস চুক্তির আলোকেই এমন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।


এদিকে বাংলাদেশের গাড়ির বাজার অন্যান্য দেশের তুলনায় খুব ছোট। ২০১৭ সাল পর্যন্ত নিবন্ধিত হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতি হাজারে গাড়ি কেনেন মাত্র তিনজন। অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে যেমন থাইল্যান্ডে বছরে ১৯ লাখ গাড়ি উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে দেশটির স্থানীয় বাজারেই বিক্রি হয় ১১ লাখ। বাকীগুলো রফতানি হয়।


অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের গাড়ির বাজারটি ছোট হওয়ার অন্যতম কারণ উচ্চমূল্য। দেশে আমদানিকৃত গাড়ির মূল মূল্যের চেয়ে কর দিতে হয় বেশি। এখন যদি স্থানীয়ভাবে গাড়ি উৎপাদিত হয়, তাহলে গাড়ির মূল্য অনেকটাই কমে যাবে। ধনী উচ্চমধ্যবিত্তের পাশাপাশি গাড়ি কিনতে উত্সাহিত হবেন মধ্যবিত্তরাও। ফলে দেশে উৎপাদিত গাড়ির বাজারটি দ্রুতই বড় হয়ে উঠবে।


দেশে স্বল্প পরিসরে বৈদ্যুতিক গাড়ির উৎপাদনের কার্যক্রমও চলছে। চট্টগ্রামে চীনা একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরির কাজ করছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এই গাড়ি তৈরি হলে দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির দামও কমবে এবং ব্যবহার বাড়বে বলে আশা করছেন এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।


যাইহোক বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজার তৈরিতে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। দেশজুড়ে পেট্রোল পাম্পের মতো করে বৈদ্যুতিক গাড়ির চার্জিং পয়েন্ট স্থাপন করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার উদ্যোগ নেয়া শুরু করলে বিনিয়োগে আগ্রহ পাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও। এর সুফল গিয়ে পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। এর মাধ্যমে উন্নত দেশ হওয়ার পথে আরো একধাপ এগিয়ে যাব আমরা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন