কম্পিউটার অপারেটর থেকে ৪৬০ কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক

অঢেল সম্পদ গড়ার বাংলাদেশী স্টাইল

নিজস্ব প্রতিবেদক

র‍্যাবের হাতে আটক মো. নুরুল ইসলাম ছবি: সংগৃহীত

এক সময়ে টেকনাফ স্থলবন্দরে দৈনিক ১৩০ টাকা বেতনে কম্পিউটার অপারেটরের চাকরি করতেন মো. নুরুল ইসলাম (৪১) সে সময় দালালি চোরাকারবারিসহ বন্দরকেন্দ্রিক বিভিন্ন অবৈধ কার্যক্রমে জড়িত সিন্ডিকেটগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় তার। জড়িয়ে পড়েন স্থলবন্দরকেন্দ্রিক অবৈধ কার্যক্রমের সঙ্গে। এক পর্যায়ে চাকরি ছেড়ে নিজেই গড়ে তোলেন দালালির এক সিন্ডিকেট।

ধীরে ধীরে টেকনাফ স্থলবন্দরকেন্দ্রিক অপরাধচক্রের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে সিন্ডিকেটটি। চোরাকারবারি, শুল্ক ফাঁকি, অবৈধ পণ্য খালাস দালালিসহ সব ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েন নুরুল ইসলাম তার সহযোগীরা। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরাসরি কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা বরাবরই এড়িয়ে চলেছে সিন্ডিকেটটি। যদিও বন্দরভিত্তিক রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রায় সবার সঙ্গেই দহরম-মহরম বজায় রেখেছেন নুরুল ইসলাম। ফলে অপরাধমূলক কার্যক্রমে কখনই তেমন একটা বাধার সম্মুখীনও হতে হয়নি তাকে। নুরুল ইসলাম হয়ে ওঠেন বন্দরের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি।

অনুসন্ধানে জানা গিয়েছে, টেকনাফে তার সিন্ডিকেটের সদস্য ১২-১৫ জন। তাদের সহযোগিতায় টেকনাফ স্থলবন্দর ট্রাক স্ট্যান্ডে নানা ধরনের দালালি কার্যক্রম চালানোর পাশাপাশি বন্দরের শ্রমিক নিয়োগ, পণ্য খালাস পরিবহনের সিরিয়াল দেয়ার কাজগুলোও তার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এছাড়া প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে কাঠ, শুঁটকি, বরইয়ের আচার, মাছ ইত্যাদির আড়ালে অবৈধ পণ্য আমদানির সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েন তিনি।

এভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন নুরুল ইসলাম। এক সময়ে দৈনিক ১৩০ টাকা বেতনে চাকরি করা নুরুল ইসলাম হয়ে ওঠেন কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদের মালিক। সম্প্রতি জাহাজ কেনার পরিকল্পনাও করছিলেন তিনি। এছাড়া সাভারে একটি বিনোদন পার্ক নির্মাণের কাজেও বিনিয়োগ করেছেন তিনি।

তবে পরিকল্পনা সফল হওয়ার আগেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন নুরুল ইসলাম। সোমবার দিবাগত রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় এক গোয়েন্দা সংস্থা র‍্যাব অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে। সময় উদ্ধার করা হয় লাখ ৪৬ হাজার ৫০০ টাকার জাল নোট, লাখ ৮০ হাজার মিয়ানমারের মুদ্রা, হাজার ২০০ পিস ইয়াবা নগদ লাখ হাজার ১৬০ টাকা।

গ্রেফতারকৃত নুরুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে র‍্যাব জানিয়েছে, তার সঙ্গে স্থানীয় চিহ্নিত মাদক কারবারিদেরও যোগসাজশ ছিল। এছাড়া হুন্ডি সিন্ডিকেটের সঙ্গে সমন্বয়ের ভিত্তিতে অবৈধ ঘোষিত পণ্যের কারবার চালানোর পাশাপাশি আন্ডার ওভার ইনভয়েস কারসাজির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তিনি। এছাড়া অবৈধ আয়ের উৎসকে ধামাচাপা দিতে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে এমএস আল নাহিয়ান এন্টারপ্রাইজ, এমএস মিফতাউল এন্টারপ্রাইজ, এমএস আলকা এন্টারপ্রাইজ, আলকা রিয়েল স্টেট লিমিটেড এমএস কানিজ এন্টারপ্রাইজ।

র‍্যাবের দেয়া হিসাব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত নুরুল ইসলামের আনুমানিক ৪৬০ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গিয়েছে। রাজধানীতে তার ছয়টি বাড়ি রয়েছে, যার আনুমানিক মূল্য ৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে আদাবরে সাত কাঠা জমির ওপর সাততলা বাড়ির আনুমানিক মূল্য ১৫ কোটি টাকা। মোহাম্মদপুরে সাড়ে চার কাঠা জমিসহ সাততলা বাড়ির মূল্য ১২-১৪ কোটি টাকা। একই এলাকার ঢাকা উদ্যানে ১১ কাঠা জমিতে দোতলা বাড়ির নিচতলায় সাতটি দোকান রয়েছে তার, যার বর্তমান বাজারমূল্য ১৭-১৮ কোটি টাকা। আরেকটি তিনতলা বাড়ির আনুমানিক মূল্য সাড়ে কোটি টাকা। এছাড়া চন্দ্রিমা মডেল টাউনে সাড়ে চার কাঠা জমির ওপর সাড়ে থেকে কোটি টাকা মূল্যের দোতলা ভবন এবং ঢাকা উদ্যানে নয় কাঠা জমিতে ১৫ কোটি টাকা মূল্যের বাড়িসহ ১৭টি দোকান রয়েছে তার।

রাজধানীতে তার চারটি রিকশার গ্যারেজ ঘর রয়েছে, যার আনুমানিক মূল্য ৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানে আট কাঠা জায়গায় রিকশার গ্যারেজ ঘর দোকানের মূল্য - কোটি টাকা, একই এলাকার একতা হাউজিংয়ে আট কাঠা রিকশার গ্যারেজে ঘর দুটি দোকানের মূল্য - কোটি টাকা, আদাবরে নয় কাঠা জমিতে রিকশার গ্যারেজ সাতটি দোকানের মূল্য ১০-১১ কোটি টাকা একতা হাউজিংয়ে সাড়ে চার কাঠা জমিতে আরেক রিকশার গ্যারেজ একটি দোকানের মূল্য সাড়ে থেকে কোটি টাকা।

এছাড়া রাজধানীতে পৃথক ১৩ স্থানে জমি রয়েছে তার নিজের নামে, যার আনুমানিক মূল্য ১৬৫ কোটি টাকা। রাজধানীর উপকণ্ঠ সাভারে রয়েছে ১১৮ কোটি টাকা মূল্যের সাতটি জায়গাসহ ঘর। ঢাকার মোহাম্মদপুর সাভার ছাড়াও টেকনাফ, সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার ভোলায়ও বিপুল পরিমাণ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। এছাড়া সেন্ট মার্টিনের জিঞ্জিরা দ্বীপে রয়েছে ২০ শতাংশ জমি, যার মূল্য ১০-১২ কোটি টাকা। এছাড়া নিজ জেলা ভোলায়ও আনুমানিক ১২ কোটি টাকা মূল্যের জমির মালিক তিনি।

টেকনাফে সরেজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গিয়েছে, তাকে আটক করার পর এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। গণমাধ্যমে নুরুল ইসলাম আটক হওয়ার সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর তার সিন্ডিকেটের অনেক সদস্যই গা-ঢাকা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন বন্দরের ব্যবসায়ীরা। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক সময়ে অনেক সক্রিয় থাকলেও বর্তমানে সেখানেও তাদের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বন্দরের এক ব্যবসায়ী জানান, নুরুল ইসলামের বিষয়ে আমরা গুটিকয়েক লোক প্রতিবাদ করলেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা যোগসাজশের কারণে কিছুই করতে পারিনি। সর্বশেষ চার মাস আগে দুদকের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান শুরু হলে নুরুল ইসলাম বন্দর থেকে চলে যান। তারপর থেকে তার পুরো ব্যবসা দেখভাল করছেন শ্যালক রানা সাদ্দাম। আবার বন্দরে তার আগের চাকরির পদটিতেও নিয়োজিত রয়েছে তার সৎ ভাই রনি।

অনুসন্ধানে জানা গিয়েছে, টেকনাফ বাসস্টেশনের কাস্টমস-সংলগ্ন এলাকায় বিশাল বাড়ি গড়ে তুলেছেন নুরুল ইসলাম। সে বাড়ি এখন ভাড়া দিয়েছেন। অন্যদিকে টেকনাফ পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের দক্ষিণ পাশে একটি বিলাসবহুল বাড়ির কাজ চলছে। সেই বাড়ির ভিত্তি নির্মাণেই (ফাউন্ডেশন) কোটি টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। সব মিলিয়ে বাড়িটি নির্মাণের সম্ভাব্য ব্যয় প্রায় ২০ কোটি টাকা। এছাড়া পৌরসভার কেকে পাড়ায় তার কোটি টাকার জমি রয়েছে। টেকনাফের কায়ুকখালী পাড়ায় তার আরেকটি বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে। সেখানে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন বসবাস করেন। শ্যালক রানা সাদ্দাম সে বাড়িতে থেকেই তার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গতকাল র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, নুরুল ইসলামের নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যাংকে মোট ১৯টি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। ২০২০ সালের নভেম্বরের পর তিনি ১১টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে কোটি ৮৭ লাখ ৯৫ হাজার টাকা উত্তোলন করেছেন।

 

প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন বণিক বার্তার কক্সবাজার প্রতিনিধি ছৈয়দ আলম

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন