আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান হবে এইচবিআরআই

মো. আশরাফুল আলম বর্তমানে মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অবকাঠামো ভবন গবেষণা প্রতিষ্ঠান হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটে (এইচবিআরআই) প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান কর্মকাণ্ড ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শামীম রাহমান

এইচবিআরআই কী ধরনের সেবা দেয়?

গৃহায়ন গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে একমাত্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এইচবিআরআই) প্রতিষ্ঠানটি মূলত বিকল্প নির্মাণসামগ্রী প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করে। পাশাপাশি ভবনের নকশার জন্য পরামর্শক সেবাও দেয়। একইভাবে বিকল্প নির্মাণ উপকরণ প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ এবং জনগণকে এসবের ব্যবহার সম্পর্কে উদ্বুদ্ধ করা, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নির্মাণসংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরামর্শক সেবা দেয়া সম্পর্কিত নীতিমালা তৈরিতে সহায়তা করে  এইচবিআরআই। আজকের এইচবিআরআই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুদূরপ্রসারী চিন্তার ফসল। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে স্বল্পতম সময়ে, স্বল্প খরচে টেকসই পরিবেশবান্ধব আবাসন গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ধারাবাহিকতায় এখন আমরা দেশের মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছি।

পরিকল্পিত নগর, নিরাপদ সাশ্রয়ী আবাসনগড়তে এইচবিআরআই কী ধরনের ভূমিকা পালন করছে?

স্বাস্থ্যসম্মত টেকসই অবকাঠামো নির্মাণ এইচবিআরআইয়ের অন্যতম লক্ষ্য। পরিবেশ দূষণের একটি বড় কারণ পোড়ামাটির ইট। এর বিকল্প হিসেবেব্লকব্যবহার শুরু করেছি। ইট যেমন পরিবেশসম্মত, তেমনি পোড়ামাটির ইটের চেয়েও শক্তিশালী। পোড়ামাটির ইটের বিকল্প নিয়ে আমাদের গবেষণা কার্যক্রম এখনো অব্যাহত রয়েছে।

বিকল্প নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার ব্যয়বহুল নাকি সাশ্রয়ী?

সাধারণ নির্মাণসামগ্রীর চেয়ে এইচবিআরআই উদ্ভাবিত নির্মাণসামগ্রী অনেক বেশি সাশ্রয়ী। ফেরোসিমেন্ট প্রযুক্তি দিয়ে এইচবিআরআই ক্যাম্পাসে একটি পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রচলিত খরচের তুলনায় ৩০ শতাংশ অর্থ সাশ্রয় হয়েছে। বিকল্প নির্মাণসামগ্রীর মাধ্যমে নির্মাণ ব্যয় আরো কমিয়ে আনতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ইটের ব্লক তৈরির ক্ষেত্রে নদীর ড্রেজড সয়েল, হাস্কিং মিল থেকে পাওয়া ধানের তুষ, সিরামিক কারখানার বর্জ্যের মতো উপকরণ নিয়ে কাজ করছি। এসব উপকরণ ব্লক উৎপাদনের খরচ আরো কমিয়ে দেবে বলে আমরা আশাবাদী।

এইচবিআরআইয়ের বিকল্প নির্মাণসামগ্রীগুলো মানুষ কতটা গ্রহণ করছে?

এটা ঠিক যে এইচবিআরআইয়ের কার্যক্রম সম্পর্কে এখনো অনেকেই ওয়াকিবহাল না। এখানে যোগ দেয়ার পর পরই বিষয়টি আমার নজরে আসে। সমস্যাটি দূর করতে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে এইচবিআরআইয়ের ওয়েবসাইটটি হালনাগাদের উদ্যোগ গ্রহণ করি। এখন বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে আমাদের কার্যক্রম সম্পর্কে ওয়েবসাইট থেকেই প্রয়োজনীয় সব তথ্য মানুষ পেয়ে যাচ্ছে। বিকল্প নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে প্রিন্ট ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমেরও সহায়তা নেয়া হচ্ছে। আগামী অক্টোবরে দুবাইয়ে অনুষ্ঠেয় প্রদর্শনীতেও এইচবিআরআই বিভিন্ন উদ্ভাবন নিয়ে অংশ নেবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৫ সালের মধ্যে পোড়ামাটির ইট ব্যবহার বন্ধের বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

আবাসন বাংলাদেশে এখনো একটি বড় সমস্যা। শহরাঞ্চলে সমস্যাটি আরো প্রকট। কীভাবে সবার জন্য সাশ্রয়ী নিরাপদ আবাসন গড়ে তোলা যায়?

প্রযুক্তি বিকল্প নির্মাণ উপকরণ দিয়ে স্বল্প মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য সাশ্রয়ী টেকসই ভবন নির্মাণ সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন। এসব পরিকল্পনা প্রণয়নে এইচবিআরআইসহ দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো কাজ করে যাচ্ছে। শুধু শহরাঞ্চল নয়, গ্রামাঞ্চলের মানুষকেও উন্নত আবাসন সুবিধার আওতায় আনার পরিকল্পনা হচ্ছে।

তাপমাত্রা সহনশীল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে এইচবিআরআই কি কোনো কাজ করছে?

আমরা জাপানের সঙ্গে যৌথভাবে একটি প্রকল্প নিয়ে কাজ করছি। এর মাধ্যমে একটি বিশেষ ধরনের ইট নির্মাণ করা হবে। ইট হবে অনেকটাই তাপমাত্রা সহনশীল। গরমের দিনে ঘর ঠাণ্ডা রাখবে আর ঠাণ্ডার দিনে গরম। পাশাপাশি আমরা ভবনের নকশা নিয়েও কাজ করছি। পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশের সুবিধা রাখা হচ্ছে এসব নকশায়। এইচবিআরআই উদ্ভাবিত প্রযুক্তি আর প্রণয়ন করা নকশার মাধ্যমে ভবনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের খুব একটা দরকার হবে না।

নিজের বাড়ি, নিজেই করিস্লোগানে এইচবিআরআই একটি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাই।

এইচবিআরআইয়ের প্রশিক্ষণগুলোর মধ্যেনিজের বাড়ি, নিজেই করিঅন্যতম সফল একটি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। এরই মধ্যে ৯৪টি ব্যাচকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণে বাড়ির ফাউন্ডেশন কেমন হবে, মাটি পরীক্ষা কেন দরকার, কোন প্রতিষ্ঠানে মাটি পরীক্ষা করা যাবে, নকশা প্রণয়নসহ নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণার্থীদের প্রয়োজনীয় ধারণা দেয়া হয়। বাড়ি নির্মাণের প্রতিটি ধাপ বা পর্যায় সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেয়া হয় এসব প্রশিক্ষণে। ফলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তার বাড়ির কাজ সঠিকভাবে প্রয়োজনীয় সব নিয়ম মেনে হচ্ছে কিনা, তা তিনি নিজেই তদারক করতে পারবেন।

বিকল্প নির্মাণসামগ্রীর জন্য তো দক্ষ নির্মাণ শ্রমিকও প্রয়োজন হয়। বিষয়টি নিয়ে এইচবিআরআই কি কোনো কাজ করছে?

দক্ষ নির্মাণ শ্রমিকের জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ। এইচবিআরআই নির্মাণকর্মীদের জন্য মেসন ট্রেনিং আয়োজন করে। প্রশিক্ষণে নির্মাণকর্মীরা পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী প্রযুক্তি সম্পর্কে হাতে-কলমে ধারণা পেয়ে যান। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অনলাইনের মাধ্যমে পরিচালনা করা হচ্ছে। টেকসই নিরাপদ আবাসনের জন্য এইচবিআরআই পাঁচ লাখ দক্ষ নির্মাণ শ্রমিক তৈরির একটি প্রকল্পও বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে।

ঢাকাসহ দেশের শহরাঞ্চলের বিদ্যমান অবকাঠামোগুলোর ভূমিকম্প সহনীয়তা নিয়েও তো এইচবিআরআই কাজ করছে। সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই।

ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক দিয়ে বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ। এমন পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বিদ্যমান অবকাঠামোগুলো কতটা ভূমিকম্প সহনীয় কিংবা কী পরিমাণ ভবন ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে, তা জানতে জাইকার সহায়তায় এইচবিআরআই একটি গবেষণা পরিচালনা করছে। যার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। এরই মধ্যে ঢাকার ৮০০ বিল্ডিংয়ের ওপর জরিপ করা হয়েছে। যেসব ভবন অত্যধিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, সেগুলোকেরেড’, তুলনামূলক কম ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোকেইয়েলোএবং নিরাপদ ভবনগুলোকেগ্রিনজোনে রাখা হয়েছে। শিগগিরই গবেষণার ফলাফল সরকারের কাছে পেশ করা হবে। যার আলোকে সরকার সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো বিভিন্ন নীতি কৌশল গ্রহণ করে নিরাপদ অবকাঠামোর বিষয়টি নিশ্চিত করবে।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর ভেঙে পড়ার বিষয়টি সাম্প্রতিককালে বেশ আলোচনায় এসেছে। এসব ঘর নির্মাণে প্রকৌশলগত দিকগুলোয় কোনো ছাড় দেয়া হয়েছে?

আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহহীনদের ঘর দেয়া সরকারের একটি মহতী উদ্যোগ। কিন্তু অনেক জায়গাতেই এসব ঘর নির্মাণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ত্রুটির বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন হয়েছে। হস্তান্তরের পর অনেকগুলো ঘর ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে। এসব ঘর নির্মাণের পরিকল্পনায় যেসব সংস্থা জড়িত ছিল, বাস্তবায়ন কাজে যেসব সংস্থা কিংবা কর্মকর্তা যুক্ত ছিলেন, তারা সতর্কতার সঙ্গে কাজ করলে আমাদের এসব বিব্রতকর খবর দেখতে হতো না।

এইচবিআরআই নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাই।

দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত থাকা প্রতিষ্ঠানটিতে যোগদানের পর নতুন সাংগঠনিক কাঠামো তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। জনবল বাড়ানোর পাশাপাশি দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে অফিস স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি। আমি স্বপ্ন দেখি, এইচবিআরআই একদিন আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠবে। দেশ-বিদেশের গবেষক-প্রকৌশলীদের জন্যসেন্টার অব এক্সিলেন্স’- পরিণত হবে। উন্নয়ন আর উদ্ভাবনে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এইচবিআরআই কাজ করবে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন