পর্যালোচনা

কভিড-১৯: ব্যবস্থাপনার সংকট ও করণীয়

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান

বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ। প্রায় প্রতি বছর বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগ যেন এখানে নিয়মিত ঘটনা। এসব দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমরা দক্ষতা দেখিয়েছি, সহজেই দক্ষতা দেখাতে পারি। এটি বিশ্বব্যাপী প্রশংসিতও হয়েছে। কিন্তু চলমান করোনা ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বাংলাদেশে একটা ---- অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এখানে কেন দক্ষতা দেখাতে পারছি না? প্রশ্নের প্রেক্ষাপটে মনে হয়, রাজনৈতিক মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে করোনা ব্যবস্থাপনাটা নেই। করোনা ব্যবস্থাপনাকে নিছক একটা বিভাগীয় দায়িত্ব পর্যায়ে রেখে দেয়া হয়েছে। দায়িত্ব পালনের নেতৃত্বে যারা আছেন, তাদের ধারাবাহিক অক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, সেটি নিয়ে প্রতিকারমূলক কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। সেজন্য মনে হচ্ছে সার্বিক বিষয়টি রাজনৈতিক গুরুত্বের জায়গায় নেই। 

করোনা ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দিয়ে যেভাবে দক্ষতা দেখানোর একটা তাগাদা তৈরি হতো, ঘাটতি থাকলে সেটি মেটানোর তাগাদা তৈরি হতো, সেটা নেই। রাজনৈতিক গুরুত্বের জায়গা থেকে করোনাকে দেখার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এটাকে শুধু বিভাগীয় দায়িত্ব হিসেবে দেখা হয়েছে। সেজন্য লোক দেখানো বিভিন্ন পদক্ষেপ আছে বটে, কিন্তু ঘাটতি পূরণে, ব্যর্থ হলে শাস্তি দেয়ার পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়।

করোনা মোকাবেলাকে রাজনৈতিক গুরুত্বের জায়গা চিহ্নিত করতে বলা হলেও গুরুত্ব বেশি পাচ্ছে অর্থনীতি সচল রাখা। করোনা ব্যবস্থাপনা রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে নেই। সেজন্য খাপছাড়া, সমন্বয়হীন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে। সেখানেও আবার ক্ষমতা বলয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থনৈতিক জগিট বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। অর্থাৎ রফতানিমুখী শিল্প সচল রাখাটাই সবচেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে সময়ে। করোনা ব্যবস্থাপনাটা একটা গৌণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যদিও সেভাবে বলা হচ্ছে না। কিন্তু কার্যত আমরা সেটিই দেখছি।

করোনা ব্যবস্থাপনায় কয়েকটি বিষয় আছে। একটি হলো করোনা আক্রান্তের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা। আমাদের স্বাস্থ্য খাত আক্রান্তদের সেবা দিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। তাদের ভালোভাবে চিকিৎসা দেয়া যাচ্ছে না। স্বাস্থ্থ্য ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো সময়ে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। অনেক সময় পাওয়া গেলেও এমনকি বাইরের অভিজ্ঞতা সামনে থাকলেও সরকার করোনা-সংক্রান্ত স্বাস্থ্যসেবার  আওতা, পরিসর কার্যকারিতা বাড়াতে পারেনি। সেটি করোনা পরীক্ষা থেকে শুরু করে আইসিইউ ব্যবস্থা সব ক্ষেত্রের জন্য প্রযোজ্য। চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় কোনো সমন্বয় নেই। কেন্দ্রের সঙ্গে মাঠের সংযোগ নেই। অনেকটা বিচ্ছিন্নভাবে চলছে সবকিছু।

দ্বিতীয়ত, টিকাদান ব্যবস্থাপনা। এটিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সাম্প্রতিক সময়ে এখানে নজর দেয়া হচ্ছে। এটাতেও কেন্দ্রের সঙ্গে মাঠের সংযোগ দুর্বল। বেশ আগেই করোনার টিকাদান শুরু হলেও মাঝে টিকার মজুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় কার্যক্রম। এখন মজুদ বাড়ানো হচ্ছে, কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। এখন জোরালোভাবে টিকাদান চলছে। তবে টিকা সংগ্রহ থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ে সেটির প্রয়োগ, সবখানে অব্যবস্থাপনার ছাপ স্পষ্ট।

ব্যবস্থাপনার তৃতীয় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সঠিক বার্তা প্রদান ব্যবস্থাপনা। বিশ্বের সব দেশের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য। সঠিক মেসেজিং কমিউনিকেশন। মানে কী করা দরকার, কী করতে হবে, কখন করতে হবে। প্রথম থেকেই সরকার জনগণের কাছে সঠিক বার্তা প্রদানে ব্যর্থতা দেখিয়েছে। এর পেছনের কারণ একে নিছক একটা বিভাগীয় দায়িত্ব হিসেবে দেখা হয়েছে। সেদিক থেকে ম্যাসেজিংয়ের একটা বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে। ফলে জনগণের মধ্যে  বিভ্রান্তি আছেমেসেজের ব্যাপারে সরকারের প্রতি আস্থার সংকট আছে। একেক সময় একেক কথা বলা হচ্ছে। বলা হলো, ইউনিয়ন পর্যায়ে এক সপ্তাহ ধরে গণটিকা দেয়া হবে। পরে বলা হলো, শুধু একদিন দেয়া হবে।

ব্যবস্থাপনার চতুর্থ স্তম্ভ, লকডাউন ব্যবস্থা। যে নামই দেয়া হোক না কেন, লকডাউন দেয়া হচ্ছে। বারবারই এখানে নানা অসংগতি দেখা গেছে। কোনো কাজে আসছে না লকডাউন। আমরা দেখেছি প্রচলিত ধারার লকডাউন আসলে কোথাও সফল হয়নি। সফল হয়েছে স্মার্ট লকডাউন। স্মার্ট লকডাউনে এলাকাভিত্তিক, সময়ভিত্তিক এবং সুনির্দিষ্ট গ্রুপভিত্তিক একটা বিষয় রয়েছে। সেখানে দৃঢ়তা দেখানোর বিষয় আছে, রয়েছে ব্যবস্থাপনার বিষয়। নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্য জোগানো আর্থিক সহায়তার বিষয় আছে। সময় চাপে পড়লে সরকার লকডাউন শিথিল করছে। খুব একটা তদারক করা হচ্ছে না। আবার লকডাউন ব্যবস্থাপনার মধ্যে অন্যতম বিষয় থাকছে অর্থনীতি সচল রাখার ব্যাপারটি। বিষয়টিকে সমন্বিতভাবে করা যাচ্ছে কিনা, সেটি এক বড় প্রশ্ন। দীর্ঘ সময় পর এসে মনে হচ্ছে, সফল করোনা ব্যবস্থাপনা আসলে রাজনৈতিক মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে নেই। এটা একটা বিভাগীয় দায়িত্ব পর্যায়েই রয়ে গেছে। সবকিছু চলছে খাপছাড়াভাবে। কোথাও  চাপ তৈরি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হচ্ছে।

কাজেই বলা চলে ব্যবস্থাপনার চারটি স্তম্ভএক. আক্রান্তদের স্বাস্থ্যসেবা, দুই. টিকাদান, তিন. করোনা-সংক্রান্ত মেসেজিং, কমিউনিকেশন এবং চার. লকডাউন ব্যবস্থাসব ক্ষেত্রেই দুর্বলতা লক্ষ করা যাচ্ছে। চরম সমন্বয়হীনতা বিরাজ করছে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের তরফ থেকে দায়িত্বের বণ্টনটা ঠিক সুস্পষ্ট নয়। কার কী দায়িত্ব, সেটিও পরিষ্কার নয়। দায়িত্ব বণ্টনের কাজটি কোনো সুচিন্তিত জায়গা থেকে হচ্ছে না। এটি মুহূর্তের একটা সিদ্ধান্ত মনে হচ্ছে। এভাবেই বিষয়টি এগোচ্ছে।

বংলাদেশে প্রথম থেকেই করোনাকে একটা সাময়িক সংকট হিসেবে দেখার প্রবণতা ছিল। ২০২১ সালে এসে ধারণা ধাক্কা খেয়েছে। তার পরেও বিষয়টি সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা হচ্ছে না। যেখানে ব্যবস্থাপনার ঘাটতি সমন্বয়হীনতা প্রকট। কেন্দ্র মাঠের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি বিদ্যমান। কেন্দ্রের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টনের বিশৃঙ্খলা রয়েছে। ব্যর্থতার কোনো শাস্তি নেই। ব্যবস্থাপনার কোনো প্রতিকার নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দিকে তাকালে বিষয়টি আমরা আরো ভালোভাবে বুঝতে পারব। এসব কারণে আমরা ব্যবস্থাপনার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে যেতে পারিনি। যেমন প্রথম দিকে টিকা নিতে আগ্রহ কম ছিল, এখন কিন্তু  টিকা নেয়ার ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। টিকা নেয়া সংক্রান্ত সচেতনতার ঘাটতি এখন আর নেই। তবে কথা সত্য, মাস্ক পরার বিষয়ে সচেতনতার ঘাটতি রয়ে গেছে। আস্থার সংকট রয়ে যাচ্ছে, নানা জনে নানা কথা বলছে। কোনো সুস্থিরতার বিষয় নেই। ঘাটতিগুলো দূর করতে হবে।

অর্থনীতি সচল রাখার ব্যাপারেও আমরা একটা শর্টটার্ম চিন্তার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি। বিবিএস সম্প্রতি বলেছে, ২০১৯-২০ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাড়ে শতাংশ হয়েছে। বাস্তবে আরো কম হতে পারে। তার পরের অর্থবছরের জন্য সংস্থাটি জিডিপি প্রবৃদ্ধি শতাংশ বলেছে। হয়তো সেটিও কমে আসবে। কমে আসতে বাধ্য। ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির মাশুল দিতে হচ্ছে অর্থনীতিকে। ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি এই অর্থে যে নীতিনির্ধারকরা ভাবছেন করোনা ব্যবস্থাপনাকে একটি পার্শ্ববর্তী এজেন্ডা হিসেবে রাখি, অর্থনীতি সচল রাখবএটিই হবে বাংলাদেশের প্রধান কাজ। ফলে এটি একটা বিভাগীয় কাজ হিসেবে রাখা হলো। ফলে অসমন্বিতভাবে কিছু কাজ হচ্ছে। সফল কিছু হচ্ছে না। যেভাবে সংক্রমণ বাড়ছে, তাতে আমরা জানি না এর শেষ কোথায়। একটি বিষয় পরিষ্কার, অনিশ্চয়তার আবহ রেখে কোথাও সফল কিছু ব্যবস্থা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। অর্থনীতিও সচল করা যায়নি। আস্থার জায়গা তৈরি না হলে অর্থনৈতিক সুফল ঘরে তোলা কঠিন।

করোনা ব্যবস্থাপনাকে রাজনৈতিক গুরুত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা দরকার। এটি এলেই অনেক সিদ্ধান্ত এমনিতেই সামনে চলে আসবে। শুধু বিভাগীয় পর্যায়ে ছেড়ে দিলে হবে না। এটিকে গুছিয়ে আনতে হবে। অদক্ষতার ধারাবাহিক চেহারা যে আমরা দেখেছি, তার একটা প্রতিকার প্রয়োজন।

করোনা ব্যবস্থাপনাকে রাজনৈতিকভাবে গৌণ দায়িত্ব হিসেবে রেখে দিলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারও সফলভাবে হবে না। বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা বলে, যারা করোনা ব্যবস্থাপনায় সফল, তারা অর্থনৈতিকভাবেও সফল হয়েছে। অনেক দেশই করোনা নিয়ন্ত্রণ করে দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করেছে। গত বছর বাংলাদেশে চাপটা গেছে মূলত  নগর অর্থনীতির ওপর। গ্রামীণ অর্থনীতি এক ধরনের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছে। এবারে আমরা জানি না আসলে কী হবে। কারণ সংক্রমণ এখন আর শহরে সীমাবদ্ধ নেই, গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। তাহলে কী হবে? অর্থনীতির যে কয়েকটি রক্ষাকবচ ছিল যেমন কৃষি, হালকা প্রকৌশল শিল্প ইত্যাদি এবারে সেগুলো সমস্যায় পড়বে। আর অর্থনীতির একটা দীর্ঘমেয়াদি সংকটও তৈরি হচ্ছে। যেমন শিক্ষা মানবসম্পদ। এর ফলে হয়তো আমাদের আগামী পাঁচ বছর সস্তা শ্রমের উৎপাদন কৌশলের মধ্যে আটকে থাকতে হবে। সস্তা শ্রমের বদলে দক্ষ শ্রমে এগোনোই ছিল আমাদের মধ্যম আয়ে উত্তরণের মূল লক্ষ্য। করোনাকালে মানবসম্পদে যে অভিঘাত, সেটি আমরা নজরেই আনছি না। এটা অর্থনীতিতে খুব বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এসব দিক বিবেচনা করে করোনা ব্যবস্থাপনা সফল করতে সুচিন্তিত কৌশল নেয়া শুধু নয়, একে রাজনৈতিক মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে হবে।

 

. হোসেন জিল্লুর রহমান: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা; নির্বাহী চেয়ারম্যান, পিপিআরসি; চেয়ারপারসন, ব্র্যাক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন