সামিট ইউনিক রিলায়েন্স ও বিপিডিবি

আগামী বছর উৎপাদনে আসছে এলএনজিভিত্তিক চার বিদ্যুৎকেন্দ্র

আবু তাহের

তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসনির্ভর (এলএনজি) চার বিদ্যুৎকেন্দ্র আগামী বছর উৎপাদনে আসছে। মোট হাজার ৩৩৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্রগুলোর মধ্যে তিনটি নির্মাণ করছে সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল, ইউনিক গ্রুপ ভারতের রিলায়েন্স পাওয়ার। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) নির্মাণ করছে এলএনজিভিত্তিক আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম নারায়ণগঞ্জে চলছে এগুলোর নির্মাণকাজ। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জ্বালানি হিসেবে এলএনজি সরবরাহ নিশ্চিতে এরই মধ্যে সমঝোতা চুক্তি হয়েছে তিনটি দেশের সঙ্গে।

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য বলছে, আগামী বছরের ডিসেম্বর নাগাদ এলএনজিচালিত চারটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসছে। এর মধ্যে বেসরকারি তিন বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা মোট হাজার ৮৮৫ মেগাওয়াট। আর সরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সক্ষমতা হবে ৪৫০ মেগাওয়াট। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে গেলে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়াবে সাড়ে ২৭ হাজার মেগাওয়াটে।

বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতের সবচেয়ে বড় কোম্পানি সামিট পাওয়ার নারায়ণগঞ্জে এলএনজিভিত্তিক সামিট মেঘনাঘাট- নামে ৫৮৩ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০২২ সালের মার্চে উৎপাদনে যাওয়ার কথা। এরই মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির গ্যাস টারবাইন স্থাপন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কভিড মহামারীতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কেন্দ্রটির নির্মাণ শেষ করতে হাজারের বেশি কর্মী কাজ করছে।

নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে ৫৮৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার আরেকটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে ইউনিক গ্রুপ। আগামী বছরের আগস্টে উৎপাদনে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ইউনিক মেঘনাঘাট পাওয়ার নামের বিদ্যুৎকেন্দ্রটির। সম্প্রতি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থায়ন করছে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক। বিদ্যুৎ প্রকল্পটিতে ব্যয় ধরা হয়েছে হাজার ৭৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।

এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বিপিডিবির সঙ্গে নির্মাণ ক্রয় চুক্তি করে ভারতীয় কোম্পানি রিলায়েন্স। রিলায়েন্স মেঘনাঘাট ৭৫০ মেগাওয়াট আইপিপি- নামে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনে যাওয়ার কথা আগামী বছরের সেপ্টেম্বরে। এটিও নির্মাণ করা হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে।

এলএনজিভিত্তিক আরো একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিপিডিবি। চট্টগ্রামের রাউজানে নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা হবে ৪৫০ মেগাওয়াট। এলএনজিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি আগামী বছরের ডিসেম্বর নাগাদ উৎপাদনে যাবে।

এর বাইরে আগামী বছরই যুক্ত হবে ভারতের আদানি পাওয়ারের এলএনজিভিত্তিক ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। ভারতের ঝাড়খন্ডে নির্মাণ করা কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ আমদানি করবে। আগামী বছরের জুন নাগাদ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে উৎপাদন শুরুর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এলএনজিভিত্তিক এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে গেলে দৈনিক আরো ১৩০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফডি) গ্যাসের প্রয়োজন পড়বে। ফলে এসব কেন্দ্র চালু করতে হলে গ্যাস সংকট মেটানো না গেলে কেন্দ্র বসিয়ে রাখতে হবে। অন্যদিকে, এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানির জোগান নিয়েও চিন্তিত পেট্রোবাংলা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে গ্যাসের সংকটে অন্তত আড়াই হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে এলএনজিভিত্তিক নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে জ্বালানি চাহিদা পূরণ করতে না পারলে বসিয়ে রাখা কেন্দ্রের তালিকা দীর্ঘ হবে। জ্বালানির নিশ্চয়তা বিবেচনায় না নিয়েই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অনুমোদন দেয়ায় এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎ খাতে বর্তমানে প্রতিদিন গ্যাসের প্রয়োজন হাজার ৫০০ এমএমসিএফডি। এর বিপরীতে সরবরাহের পরিমাণ হাজার ২০০ এমএমসিএফডি। ৩০০ এমএমসিএফডি ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। আগামী পাঁচ-ছয় বছরে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র আসছে, সেগুলোর হিসাব করলে শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে দুই হাজার এমএমসিএফডি গ্যাসের চাহিদা তৈরি হবে।

বিদ্যুতের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, আগামীতে গ্যাসভিত্তিক যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসছে, সেখানে প্রচুর জ্বালানি প্রয়োজন হবে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানির জোগান নিশ্চিত করতে সরকার এলএনজি আমদানি করছে। দেশে বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে, সেখানে ৬০০ এমএমসিএফডি গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৩০০ এমএমসিএফডি গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। ঘাটতি মেটাতে হলে এলএনজি আমদানির কোনো বিকল্প নেই। সম্প্রতি সামিটের সঙ্গে এলএনজি আমদানিতে যে সমঝোতা চুক্তি হয়েছে, সেটি দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিদ্যমান গ্যাসের ঘাটতির বিষয়টি মাথায় রেখে।

তবে দেশে গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি চাহিদা পূরণে গত দুই মাসে তিনটি দেশের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি হয়েছে। গত ১৬ জুন ভারতের সঙ্গে এলএনজি আমদানি করতে এইচ-এনার্জির সঙ্গে চুক্তি করে পেট্রোবাংলা। চুক্তির বিষয়ে এইচ-এনার্জি জানিয়েছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এলএনজি টার্মিনাল থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণ করা হবে। পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে বাংলাদেশে এলএনজি সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

এলএনজি আমদানি করতে গত ১৩ জুলাই মালয়েশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করে বাংলাদেশ। দেশটির পেট্রোনাস এলএনজি লিমিটেড গ্লোবাল এলএনজি এসডিএন বিএইচডি এবং পেট্রোবাংলার মধ্যে সমঝোতা চুক্তি হয়। মালয়েশিয়ান সরকারের পক্ষে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের (অর্থনীতি) মন্ত্রী দাতো শ্রী মোস্তফা মোহাম্মদ এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ভার্চুয়ালি স্মারকে সই করেন। তবে ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় এবং কী পরিমাণ এলএনজি দেশটি থেকে আমদানি করা হবে তা জানানো হয়নি।

সম্প্রতি বাংলাদেশসহ এশীয় অঞ্চলে এলএনজি সরবরাহে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি কমনওয়েলথ এলএনজির সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) সই করেছে সামিট অয়েল অ্যান্ড শিপিং কোম্পানি। বছরে ১০ লাখ টন এলএনজি আমদানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সমঝোতা চুক্তি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে চুক্তি হয়। প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা . তৌফিক--ইলাহী চৌধুরীর উপস্থিতিতে সমঝোতা চুক্তি হয়।

জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিসুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, আগামী ২০২২-২৩ সালে গ্যাসভিত্তিক যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে যাবে, সেগুলোর জ্বালানি নিশ্চিত করতে মূলত এলএনজি সমঝোতা চুক্তি করা হচ্ছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে এসব দেশ থেকে এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা আমাদের। এর বাইরে পায়রা মোংলায় এলএনজিভিত্তিক টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনাও করছি। প্রাথমিক কার্যক্রম চালিয়ে দেখা হচ্ছে, এসব জায়গায় এলএনজি টার্মিনাল করা যায় কিনা। এটি করা গেলে দেশে সব প্রান্তে গ্যাসের সংকট কাটানো যাবে।

দেশে গ্যাসের চাহিদা ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলেছে। দেশীয় গ্যাস ফুরিয়ে আসার বিপরীতে বড় ধরনের কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত না হওয়ায় আমদানিনির্ভর জ্বালানিতে মনোযোগী হচ্ছে সরকার। দেশীয় গ্যাস উৎপাদনের সঙ্গে ৮০০ এমএমসিএফডি এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। তবুও প্রতিনিয়ত এক হাজার এমএমসিএফডি গ্যাসের ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্প, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বাসাবাড়িতে গ্যাস সংকট দেখা দিচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে দীর্ঘদিন অনুসন্ধান না থাকায় আমদানির এখন আর কোনো বিকল্প নেই। দেশে যে হারে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে এবং জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের যে চাহিদা বেড়েই চলেছে, তাতে সহজ হিসাবটি হলো আমদানি করা। তবে আমদানিতে অতিমাত্রায় নির্ভর হয়ে পড়লে দেশের জ্বালানি খাত বিপাকে পড়বে। বিশাল সম্পদ বছরের পর বছর অনাবিষ্কৃত থেকেই যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন