অভিমত

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ ও উচ্চশিক্ষা

ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী

অর্থমন্ত্রী কর্তৃক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ১৫ শতাংশ করারোপের কথা বাজেট পেশের আগেই চাউর হলে আমাদের কেউ কেউ করের বিরুদ্ধে নেতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করেন। বাজেট পেশের পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি কার্যকরী কমিটির সম্মতিতে প্রিন্ট ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তার প্রতিবাদ জানিয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করেন, যা বলতে গেলে ভাইরাল রূপ নেয়। আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর এমন একটি অন্যায্য, অবৈধ, অনৈতিক বৈষম্যমূলক কর ধার্য করা হবে না। কিন্তু যতই দিন যেতে লাগল ততই একথা স্পষ্ট হলো যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কর দিতেই হবে। তাই আবারো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি তার সদস্য এবং একই সঙ্গে সংসদে কয়েকজন সদস্য নিয়ে পুনরায় আলোচনায় বসে। লবিংয়ের পথ ধরে যখন কোনো সুফল এল না, তখন সমিতি আবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আরো কিছু প্রয়াস বলবত করে। তার পরও ব্যাপারে আগের সিদ্ধান্তই বলবত থাকে এবং বাজেট পাস হলে দেখা যায় যে অর্থবিলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি কলেজ, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বা কেবল তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষাদানে নিয়োজিত বেসরকারি কলেজের উদ্ভূত আয়ে ১৫ শতাংশ কর বলবৎ রয়েছে। অবস্থায় উপায়ান্তর না দেখে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি কর রহিতকরণে প্রয়াস চালাচ্ছে।

তাদের বক্তব্য হচ্ছে, সিদ্ধান্ত বেআইনি, অবৈধ এমনকি আদালত অবমাননার শামিল; অনৈতিক বৈষম্যমূলক। সরকার হয়তো আশঙ্কা করছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আরোপিত কর ছাড় দিলে অন্যরাও তা দাবি করবে। বেসরকারি অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তা করবে না, করলে তা অযৌক্তিক অবৈধ হবে; কেননা তারা কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত এবং লভ্যাংশ নিজেরা নিতে পারছে। তাদের কর দেয়ার কথা ছিল ২৫ শতাংশ, দিচ্ছে ১৫ শতাংশ। অতএব, তারা অখুশির চেয়ে খুশিই হবে। পক্ষান্তরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিবন্ধিত ট্রাস্টের আইনের অধীনে এবং তার উদ্বৃত্তাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা সামগ্রিক উন্নয়নের জন্যই ব্যয় করতে হবে বলে আইনি বিধান; যদিও অভিযোগ আছে যে কৌশলে কিছু উদ্যোক্তা লভ্যাংশ নিয়ে থাকেন। অবৈধ কাজ প্রতিরোধ করার জন্য বরং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কোম্পানি আইনের অধীনে নিবন্ধন দেয়া বাঞ্ছনীয়। ২০১০ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে ট্রাস্ট ছাড়াও অন্যভাবে নিবন্ধিত বা পরিচালিত হওয়ার আইনি বিধান রয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অধিকাংশই বিবিধ কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। বেশ কয়েকজন তাদের ভাড়াকৃত ক্যাম্পাস গুটিয়ে নিয়েছে। কেউ কেউ মালিকানা হস্তান্তর করেছে বলে শোনা যায়, কেউ কেউ নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে আর কেউ কেউ কর্মকাণ্ড শুরু করছে না। একটা সময় আসবে যখন করের বোঝা কোনো না কোনোভাবে শিক্ষার্থীদের ওপরে চাপিয়ে দেয়া হবে। বেঁচে থাকার স্বার্থে উন্নয়নের জন্যই সেটা করা হবে। দেশে মুষ্টিমেয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি অর্থে পরিচালিত এবং ইউজিসির প্রতিবেদন মোতাবেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি শিক্ষার্থী ব্যয় গড়ে ৮০ হাজার টাকা, কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে লাখ টাকা হয়তো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করতে পারছে; তা- করোনা সূচনার আগে। একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গড় মাসিক বেতন ৫০ হাজার টাকার কম নয়। সে হিসাবে ছাত্র থেকে প্রাপ্ত অর্থের বিরাট অংশই শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ বিল, কর্মচারী-কর্মকর্তার বেতন, ল্যাব খরচে চলে যায়। অতীতে এসব ব্যয় বহনের পর সামান্য অংশই উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করা যেত। করোনার কারণে এবং নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি না হওয়ায় এসবও থমকে আছে। অবস্থায় উদ্বৃত্ত আয়ে কর আরোপিত হলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে এক ধরনের বন্ধ্যত্ব পরিস্থিতির জন্ম হবে, অস্বস্তিকর পরিস্থিতিরও জন্ম দিতে পারে। সমিতি করারোপকে তাই মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা বলছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০ শতাংশ ব্যয় সরকার বহন করে, তদুপরি অনলাইন শিক্ষার জন্য বিনা সুদে ঋণ দিচ্ছে; যা ক্রমে অনুদানে রূপ নেবে। অতএব, বৈষম্যহীনতার স্বার্থে বরং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনুদান প্রদান যেখানে বাঞ্ছনীয়, সেখানে বোঝার উপর শাকের আঁটি চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উচ্চারিত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞজনের মতে, Income শব্দের অর্থ What comes in. সেক্ষেত্রে ঘরে মধ্যে মাছি এলেও তা- কিন্তু ইনকাম, যদি তার ওপর আর্থিক মূল্যারোপ করা হয়। সেদিক থেকে ইউজিসির মাধ্যমে সরকারি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রাপ্ত অর্থ তাদের আয় বা ইনকাম। অতএব, তার ওপর কর ধার্য করাও বাঞ্ছনীয়। সরকারি অর্থ ব্যয় করলে উত্তরোত্তর অনুদান বা বিনা সুদে ঋণ পাওয়া যাবে আর নিজ অর্থ শিক্ষার জন্য ব্যয় করলে করের বোঝা নিজকে বইতে হবে-জাতীয় বৈষম্য বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে চলতে পারে না বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। বঙ্গবন্ধু ক্ষুধামুক্ত, শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন। শিক্ষাঙ্গনে যদি বৈষম্য থাকে তাহলে আমরা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ থেকে সরে যাচ্ছি। আর শিক্ষাকে পণ্যে রূপান্তরের শেষ মরণকাঠিটা বঙ্গবন্ধুকন্যা স্পর্শ করবেন কেন? খুদ খেয়ে পেট নষ্ট করার মানেটা কী? আরেকটি কথা, অনেকে হাস্যোচ্ছলে উচ্চারণ করেন যে কর কর্তৃপক্ষের নাকি পাথর নিংড়িয়ে রস বের করার ক্ষমতা আছে। আর একবার তা করতে পারলে ক্রমে তার পরিমাণ বেড়েই চলে। তাই একবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর কর আরোপিত হলে তা ক্রমে বাড়তেই থাকবে। ক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সামর্থ্য হারাতে হারাতে বন্ধ হয়ে যাবে। বিদ্যমান শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব তখন সরকারকে নিতে হবে। তখন প্রাইমারি, সেকেন্ডারি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পর্যাপ্ত ব্যয় বৃত্তি দেয়া যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার বর্তমান স্থিতি হ্রাস পাবে, কেননা অনেক শিক্ষার্থী আগের মতোই বিদেশগামী হবে।

একটা বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। দেশে কাগজে-কলমে ১১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। তার মধ্যে কর্মক্ষম আছে বড়জোর ৮৭টি। ৮৭টির মধ্যে ২৫টির কার্যক্রমে ইউজিসির এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা আছে। অবস্থায় সেশনজটে আটকে যাওয়া এবং সহসাই নিষ্কৃতি পাওয়া দ্বাদশ পর্যন্ত পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের তুলনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমে যাবে। তখনই সরকারের আরোপিত কর অবশ্যই শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এর কুফল হিসেবে আপাতত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হয়ে তা সংক্রমিত হতে পারে। নিশ্চয়ই সামান্য কিছু অর্থ পাওয়ার আশায় বড় আকারের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি কাম্য নয়। এসব বিবেচনায় এবং বিশেষত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির আবেদনে প্রদত্ত বিষয়গুলো প্রাধান্য দিয়ে অন্তত ট্রাস্ট পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো কর আরোপ না করতে অনুরোধ করছি। তাহলে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-টা পড়বে না।

 

. আবদুল মান্নান চৌধুরী: শিক্ষাবিদ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সহচেয়ারম্যান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন