অভিমত

কিন্ডারগার্টেনগুলোর জন্য কি কিছুই করার নেই?

মাছুম বিল্লাহ

দীর্ঘ ১৮ মাসের ছুটির ধকল সইতে না পেরে দেশের কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দেশের কিন্ডারগার্টেনগুলো অভিভাবকহীন। যেসব কিন্ডারগার্টেন পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত, সেগুলো নিয়মানুযায়ী থাকা উচিত প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। কিন্তু মন্ত্রণালয় বলছে এসব বিদ্যালয় তাদের নয়। একইভাবে বাকিগুলোও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন নয়। কিন্তু এগুলো সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এগুলো সমাজের বাইরে থেকে আসেনি। সমাজের প্রয়োজন বাস্তবতায় গড়ে উঠেছে এসব কিন্ডারগার্টেন। এগুলো কোনো মন্ত্রণালয়ের নয় বলে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া যায় কিন্তু তাতে কি সমাধান হয়? কর্তব্য পালন করা হয়? এখানে কারা পড়ে? দেশের বাইরের শিশুরা, না আমাদের শিশুরা?

কিন্ডারগার্টেনগুলোকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য রেজিস্ট্রেশন করার নিয়ম। অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেন রেজিস্ট্রেশন করেনি বলে মন্ত্রণালয়ের এক ধরনের ক্ষোভ আছে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি। তাই কি তাদের প্রতি ধরনের আচরণ? একটু গভীরভাবে হিসাব করলে আমরা দেখতে পাব যে এখানে অনেক বেকারের কর্মসংস্থান হয়েছে। সমাজের অনেক তরুণ, প্রভাবশালী যেসব অপকর্ম করে বেড়ায়, সেগুলো থেকে কিন্ডারগার্টেনে কর্মরতরা তো মুক্ত ছিলেন। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই ভাড়া বাড়িতে ছিল। ফলে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির অর্ধেক বাড়িভাড়া, বিভিন্ন ধরনের বিল এবং শিক্ষকদের বেতন দেয়া হতো। করোনার কারণে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী কোথাও কোথাও ভর্তি হয়েছে, যাদের মধ্যে অনেকেই ফি পরিশোধ করছে না। কেজি স্কুলের শিক্ষকরা এমনিতেই বেতন পান খুব কম, তারা নির্ভর করেন প্রাইভেট টিউশনির ওপর। সেটিও যেহেতু এখন বন্ধ, তাই তারা পড়েছেন মহাবিপদে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নেমেছেন রাইড শেয়ারিংয়ে, কেউ তরকারি বিক্রিতে, কেউ কেউ জমিজমা বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন। কোরবানির একটি নাটকে দেখলাম একজন শিক্ষক পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এটিই তো আসলে সমাজের প্রকৃত চিত্র। গভীর ক্ষত হয়ে গেছে খাতে, যার সমাধান অনেক কঠিন হবে।

বাংলাদেশ প্রাইমারি এডুকেশন স্ট্যাটিস্টিকস-২০২০- উল্লেখ করা হয়েছে, সারা দেশে নয় ধরনের লাখ ৩৩২টি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রাথমিকে শিক্ষার্থী কোটি ১৫ লাখ ৫১ হাজার ৬৯১ জন আর শিক্ষক লাখ ৪০ হাজার ৪৭১ জন। এগুলোর মধ্যে ২৯ হাজার ৮৯৭টি কেজি স্কুলের শিক্ষার্থী ৪০ লাখ ৭৫ হাজার ৫৩৩ এবং শিক্ষক লাখ ৮৪৭ জন। কিন্তু কেজি স্কুলের নেতাদের দাবি সারা দেশে ধরনের স্কুল রয়েছে ৬০ হাজার, আর এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী ১০ লাখ। আমরাও তা- মনে করি। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অর্ধেকই এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে এগুলো আর চালু হবে না। ফলে অন্তত পাঁচ লাখ শিক্ষক আর পেশায় ফিরবেন না। এগুলো কোনো মন্ত্রণালয়ের নয় বলে সম্ভবত উপজেলা শিক্ষা অফিসও ওই এলাকায় কয়টি কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয় রয়েছে তার হিসাব ঠিকমতো রাখে না। তাই সংখ্যা নিয়েও রয়েছে নানা মত। বিভিন্ন সূত্র থেকে আমরা যতটা জানি, সে হিসাব রকমসরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা লাখ ৩৩ হাজার। এর মধ্যে সরকারি ৬৫ হাজার ৬২০টি। বাকি সবই বেসরকারি ব্যক্তিপর্যায়ে পরিচালিত এবং এগুলোয় কমবেশি এক কোটি   শিশু লেখাপড়া শেখে। কিন্ডারগার্টেন নিয়ে বিতর্ক আছে। এখানকার পড়াশোনার ধরন, সীমাবদ্ধ জায়গায় শিশুদের রেখে পড়ানো ইত্যাদি। কিন্তু সরকারি প্রাথমিকে তো সব শিক্ষার্থী যেতে চায় না, অভিভাবকরা পাঠাতে চান না। তার কারণ কি মন্ত্রণালয় খুঁজে দেখছে? তবে এটি আনন্দের সংবাদ যে সরকারি প্রাথমিকের অনেক শিক্ষক এখন অনেক দক্ষ। তাদের জন্য বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হচ্ছে। তাদের দক্ষতার পরিবর্তন হচ্ছে। তার পরেও পুরো ব্যবস্থার তো পরিবর্তন হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এত বিশাল জনসংখ্যার দেশে সরকারের একার পক্ষে সুষ্ঠুভাবে এবং মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা কঠিন। তাই বিকল্প ব্যবস্থা থাকতেই হয়। তবে সে ব্যবস্থা যাতে কোনোভাবেই অবহেলিত না থাকে। অবহেলিত থাকা মানেই আমাদের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের শিক্ষাগতভাবে পঙ্গু করে ফেলা। সেটি আমরা করতে দিতে পারি না। বরং সরকারি-বেসরকারি, যে মাধ্যমেই হোক, শিক্ষা হতে হবে যুগোপযোগী মানসম্পন্ন। আর সেটি করতে হলে এর সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের সবার অর্থনৈতিক নিরাপত্তা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। সেটি সরকারি কোষাগার থেকেই হোক আর সরকার জনগণের যৌথ প্রচেষ্টায়ই হোক। সর্বোপরি দেশের নাগরিকদের শিক্ষার দায়িত্ব কিন্তু রাষ্ট্রের।

আমাদের দেশের অসহায় বঞ্চিত পথশিশুদের জন্য রিচিং আউট অব স্কুল চিলড্রেন (রস্ক) প্রকল্পের আওতায় দেড় শতাধিক উপজেলায় ২২ হাজারেরও বেশি আনন্দ স্কুলে মোট লাখ ২৪ হাজার ১০৪ জন পথশিশু শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতি অনিয়ম পরিলক্ষিত হওয়ায় এরই মধ্যে প্রকল্পের অনেক স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ১৮ মাসের করোনাকালীন বন্ধে এসব আনন্দ স্কুলের শিক্ষার্থী শিক্ষকদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। পথশিশু হওয়ার মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্য, মা-বাবার বিচ্ছেদ কিংবা মৃত্যু, অর্থলোভী কিছু মাদক ব্যবসায়ীর নিষ্ঠুর নজর। চরাঞ্চল, নদীভাঙন, বন্যা কিংবা সাইক্লোন-ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে গৃহহারা মানুষদের একটি বড় অংশ আশ্রয় নেয় শহরের বস্তিগুলোয়। এসব পরিবারের শিশুরা নানা ধরনের অদক্ষ শ্রমিক শিশু শ্রমিক হিসেবে বিভিন্ন কাজে যুক্ত হয়, যেখানে মেলে নির্যাতন, বৈষম্য, শারীরিক মানসিক কষ্ট। ফলে তারা অনেক অসামাজিক কার্যকলাপেও জড়িয়ে পড়ে। সোস্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক এনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রামের (সিপ) গবেষণা অনুযায়ী পথশিশুদের প্রায় ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত, ৪১ শতাংশের ঘুমানোর কোনো বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ গোসল করতে পারে না, ৩৫ শতাংশ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে, ৫৪ শতাংশ অসুস্থ হলে দেখার কেউ নেই এবং ৭৫ শতাংশ অসুস্থ হলে ডাক্তারের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগযোগ করতে পারে না। আশ্চর্যের বিষয় হলো, খোলা আকাশের নিচে ঘুমানোর পরও ৫৬ শতাংশ শিশুকে মাসিক ১৫০ থেকে ২০০ টাকা হারে মাস্তানদের প্রদান করতে হয়। এই বিশালসংখ্যক শিশু, যাদের থাকার স্থায়ী জায়গা নেই, নেই মা-বাবার কোনো খোঁজখবর, তারা নেই বিদ্যালয়ে, কে কোথায় কেমন আছে নেই তার কোনো খবর। এটি একটি বিশাল সামাজিক অনাচার। শিশুরা সমাজে কীভাবে বেড়ে উঠছে। তারা স্কুল খোলাকালীন বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা পেত, যা এরই মধ্যে হয়তো ভুলে গিয়েছে কোনো কঠিন কাজ করতে গিয়ে, নয়তো কোনো অসামাজিক কাজ করতে গিয়ে। কী হবে এদের?

আমরা জানি গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফর এডুকেশন শীর্ষক সম্মেলনে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে বিলিয়ন ডলারের একটি তহবিল গঠন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। যুক্তরাজ্য কেনিয়ার উদ্যোগে আয়োজিত ওই সম্মেলনে তহবিল খরচের জন্য আগামী পাঁচ বছর সময় নির্ধারণ করা হয়। তহবিলের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বাড়তি আরো নয় কোটি শিশুর শিক্ষার সুযোগ এবং সাড়ে ১৭ কোটি শিশুর শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করা হবে বলে জানা যায়। এরই মধ্যে যুক্তরাজ্য অন্যান্য দাতা দেশ মিলে তহবিল সংগ্রহ করার ব্যাপারে একমত হয়েছে। গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফর এডুকেশনের চেয়ারম্যান  অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড  সম্মেলনে তহবিল সংগ্রহের ব্যাপারে বেশ আত্মবিশ্বাস ব্যক্ত করেন। এখানে আমার আরেকটি খটকা লাগে, সেটি হচ্ছে মুসলিম বিশ্বে বেশকিছু ধনী দেশ আছে, যারা সীমাহীন বিলাসিতা করে অজস  সম্পদের অপব্যবহার করে চলেছে। তারা কেন  বিশ্বের বঞ্চিত শিশুদের জন্য ধরনের তহবিল গঠন করছে না?

আগস্ট পর্যন্ত লকডাউন চলবে, তারপর হয়তো শিথিল হবে। আগস্ট থেকে গার্মেন্টসহ শিল্পপ্রতিষ্ঠান খুলে গেছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কী হবে? এসএসসি এইচএসসি পরীক্ষা সংক্ষিপ্ত আকারে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রত্যেক বিভাগের জন্য তিনটি বিষয়ে পরীক্ষা হবেবাংলা, ইংরেজি, গণিত চতুর্থ বিষয়ের পরীক্ষা দিতে হবে না। জেএসসি পিইসির বিষয়ে যতটা শোনা যায়, পরীক্ষা না- হতে পারে। ইউনেস্কোর মুখপাত্র জেমস এল্ডার বলেছেন, স্কুল বন্ধ এভাবে চলতে পারে না। বিভিন্ন দেশের সরকার কভিড-১৯ সংকট মোকাবেলা এবং রোগের বিস্তার যতটা সম্ভব কমিয়ে রাখার জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু সব শিক্ষক শিক্ষার্থীকে টিকা দেয়া পর্যন্ত স্কুল খোলার জন্য অপেক্ষা করা উচিত নয়। ১২ জুলাই ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর ইউনেস্কোর মহাপরিচালক অড্রে অ্যাজুল যৌথ বিবৃতিতে বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর ১৮ মাস পেরিয়ে গেছে। লাখ লাখ শিশুর পড়াশোনা ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকায় প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বিঘ্নিত হচ্ছে। কাজেই বিকল্প উপায়ে হলেও প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিতে হবে। আর কিন্ডারগার্টেনের ক্ষেত্রে সরকার যেটি করতে পারত বা এখনো পারে তা হলো, কেজি স্কুলে লেখাপড়া করা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনলাইন, মোবাইল, হোম স্কুলিং জাতীয় কিছু একটা করানোর নির্দেশনা দান করা এবং অভিভাবকদের অন্তত অর্ধেক বেতন পরিশোধ করতে বলা। তাহলে শিশুরা পড়াশোনার সঙ্গে লেগে থাকবে। পেশার সঙ্গে যুক্ত লাখ লাখ শিক্ষক তাদের পরিবার বেঁচে যাবে, তাতে সমাজের অস্থিরতা অনেকটাই কমে যাবে। আর অভিভাবকরা যদি অর্ধেক বেতন দেন, তাতে তাদের খুব একটা সমস্যা হবে না; বরং তাদের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার মধ্যে থাকবে। এই সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব তো আসলে আমাদের সবার। আর -জাতীয় প্রতিষ্ঠানে যেহেতু এক কোটির বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে তখন আমরা এত বড় একটি সত্য এবং দৃশ্যমান বাস্তবতাকে কোনোভাবে অস্বীকার করতে পারি না, কোনোভাবে এড়িয়ে যেতে পারি না।

 

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ গবেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন