পর্যালোচনা

বিশ্ববিদ্যালয় কী এবং কেন?

আবু এন. এম. ওয়াহিদ

মধ্য যুগের আগে গোটা ইউরোপে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার কোনো আলামতই খুঁজে পাওয়া যায় না, অথচ এশিয়া আফ্রিকায় প্রাচীন যুগেও বিশ্ববিদ্যালয় ছিল (University | Definition, Origin, History, & Facts | Britannica) এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় রকম স্পষ্ট সরল স্বীকৃতি দেখে আমি বিস্মিত না হয়ে পারিনি! এই ঐতিহাসিক গরমিলের উছিলায় এশিয়া-আফ্রিকার মানুষ কেউ একটু বড়াই করার সুযোগ নিতেই পারেন, কেউ আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুরও তুলতে পারেন। কিন্তু আমি সেদিকে না গিয়ে বরং দুই ধারার মধ্যে একটা চমত্কার মিল দেখতে পাচ্ছি। আরব দুনিয়ার সবচেয়ে পুরনো দুটো বিশ্ববিদ্যালয়মরক্কোর ফেজে অবস্থিত আল-কারাউইয়িন এবং মিসরের কায়রোয় আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা যদি ধরি তাহলে দেখা যায়, দুটোই গড়ে উঠেছিল ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের দ্বারা। শুধু তাই নয়, শুরুতে এগুলো ছিল মসজিদ, তারপর মাদ্রাসা; উন্নতি অগ্রগতির এক পর্যায়ে এসে তাদের রূপান্তর ঘটেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এবার ইউরোপের দিকে যদি চোখ ফেরাই দেখতে পাই, সেখানেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সূচনালগ্নে ধর্মের একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়ে গেছে। পশ্চিমা দেশগুলোয় উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্মেষ ঘটেছিল মধ্যযুগীয় স্কুল থেকে, যেগুলোকে বলা হতো Studia generalia মহাদেশের আনাচে-কানাচে থেকে এসব বিদ্যালয়ে ছাত্ররা পড়তে আসত চার্চের পাদ্রি, পুরোহিত সন্ন্যাসী হওয়ার জন্য (Modern western universities evolve from what - Google Search) আরো নির্দিষ্ট করে বলা যায়, ১০৭৯ সালে পোপ সপ্তম গ্রেগরি (১০২০-১০৮৫) ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় ক্যাথিড্রাল স্কুল স্থাপনের জন্য বিশেষ ডিক্রি জারি করেছিলেন। ওই স্কুলগুলোই ছিল সেই অঞ্চলের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার সূতিকাগার (History of European universities- Google Search) ইংরেজিভাষী দেশগুলোর প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয় অক্সফোর্ডের কথাই বলুন। এটাও শুরু হয়েছিল ৮৭২ সালে, যখন ইংল্যান্ডের রাজা মহান আলফ্রেড (৮৪৯-৮৯৯) অক্সফোর্ডের জমিনে সরেজমিনে গিয়ে কিছু খ্রিস্টান পাদ্রির সঙ্গে দেখা করেছিলেন এবং সেখানে ধর্মীয় বিষয়ে তাদের সঙ্গে এক জ্ঞানগর্ভ বাহাসে জড়িয়ে পড়েছিলেন, যা কিনা জারি ছিল একাধারে বেশ কয়েক দিন (Why Oxford University was established - Bing)

এখন মজার ব্যাপার হলো, হাজার বছর আগে যেসব প্রতিষ্ঠান ধার্মিকদের হাতে ধর্মশিক্ষার জন্য তৈরি হয়েছিল, পরবর্তীকালে এগুলোর অধিকাংশই গা-গতরে ডাঙর হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় নাম নিয়ে ধর্মকে নির্দয়ভাবে বাদ দিয়েছে অথবা দিতে চাইছে। জগতে অসংখ্য ধর্ম রয়েছে। সব ধর্ম যেমন শিক্ষাকে সমানভাবে মর্যাদা দেয় না এবং উৎসাহিত করে না, তেমনি সব ধর্ম আবার মানবজীবনের কোনো আবশ্যকীয় অনুষঙ্গ থেকে তফাতও রয় না। ধর্মে ধর্মে যেমন ফারাক আছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও সব এক নয় এবং একই গুণে-মানে একইভাবে কাজ করে না। তথাপি তাদের সবার মধ্যে কিছু ন্যূনতম সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকা চাই। বিবেচনায় এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সংজ্ঞাও উপস্থাপন করেছে। সন্ধানপুস্তক অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় বলতে এমন এক শিক্ষায়তনকে বোঝায়, যেখানে স্নাতক স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বিজ্ঞান এবং ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদি মনের উদারতা বৃদ্ধিকারী জ্ঞানশিক্ষা দেয়া হয়। এছাড়া উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানডাক্তার, প্রকৌশলী, উকিল-মোক্তার, হিসাবরক্ষক ইত্যাদি পেশায়ও ছাত্রছাত্রীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় উপযুক্ত ছাত্রছাত্রীদের স্নাতক থেকে পিএইচডি সমমানের সনদ দেয়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পবিত্র দায়িত্ব এবং কর্তব্য। ব্যাপারে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে সীমাহীন স্বাধীনতাও। একটি বিশ্ববিদ্যালয় যথার্থ মনে করলে একজন মেথরকেও পিএইচডি ডিগ্রি দিতে পারে।

সনদ বিতরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের এখতিয়ার নিয়ে আমার কোনো প্রশ্ন নেই। তবে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার দেয়া সংজ্ঞাটি সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য হলেও আমার কাছে পছন্দ হয়নি।

তাই আমি আরেকটু অনুসন্ধান করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতি সংক্ষিপ্ত আরেকটি সংজ্ঞা পেয়েছি। জার্মান কূটনীতিক, দার্শনিক শিক্ষাবিদ উইলহেলম ভন হামবল্ট (১৭৬৭-১৮৩৫) ১৮১০ সালে একটি মেমোরেন্ডামে লিখেছিলেন, . শিক্ষণ-গবেষণা, . শিক্ষার স্বাধীনতা . স্বশাসন তিনের সমন্বয়ে গড়ে উঠতে পারে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। একই সালে হামবল্টের দর্শন মেনেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বার্লিনের বিখ্যাত হামবল্ট বিশ্ববিদ্যালয় (Geoffrey Boulton and Colin Lucas - 2008: ‘What are universities for’ League of European Research Universities Website)

একই সূত্রে আরেকটু বিস্তারিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি ধারণা পাওয়া গেছে, যার ওপরও ভিত্তি করে তৈরি হতে পারে একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়। এটি এসেছে খ্রিস্টান ধর্মযাজক বিখ্যাত ব্রিটিশ ধর্মতাত্ত্বিক কার্ডিন্যাল জন হেনরি নিউম্যানের (১৮০১-১৮৯০) মাথা থেকে। তিনি বিষয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করেছেন এবং অনেক কথাও বলে গেছেন, তবে তার মূলকথা হলো, বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি পরিবেশ, যেখানে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে নরনারী এক জায়গায় এসে জড়ো হবেন, এক জায়গায় থাকবেন, তাদের মধ্যে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির ভাবের দেয়া-নেয়া হবে। এখানে মনের সঙ্গে মনের দ্বন্দ্বে, জ্ঞানের সঙ্গে জ্ঞানের সংঘর্ষে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি হবে, পুরনো জ্ঞানের চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে, হবে পরিমার্জন-পরিবর্ধন পরিবর্তন। তিনি হামবল্টের প্রায় ৪০ বছর পরে ১৮৫২ সালে ধারণা দিয়েছেন। এখানে একটি মজার ব্যাপার খেয়াল করুন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যাবলির মধ্যে নিউম্যান শ্রেণীকক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠদানের কথা বলেননি। তার ধারণায় সার্টিফিকেট বিতরণের কথাও উঠে আসেনি। নিউম্যানের কথা আমি যেটুকু বুঝেছি, তিনি বলতে চাইছেনবিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান এবং কেবলই জ্ঞান উৎপাদনের একটি কারখানা ছাড়া আর কিছু নয়। এখানে অধ্যাপক ছাত্রছাত্রীরা মিলে তাদের যৌথ পাণ্ডিত্য গবেষণা দ্বারা নিত্যনতুন জ্ঞান সৃষ্টি করবেন এবং পুরনো জ্ঞানকে পরিমার্জন পরিবর্তন করবেন অথবা অটুট রাখবেন।

এখানে একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উঠতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় কীএকথা বলতে গিয়ে নিউম্যান কেন জ্ঞান বিতরণ ডিগ্রি দেয়ার ব্যাপারে নীরব রইলেন। আমার মতে, এর একটি উত্তর হতে পারে, নিউম্যানের কাছে বিষয়গুলো মোটেও গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি, তাই এসব ব্যাপারে তিনি কিছু স্পষ্ট করে বলে যাননি। তার নীরবতার আরেকটি ব্যাখ্যাও হতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয় শুধু জ্ঞান সৃষ্টি করবে এবং কলেজগুলো জ্ঞান বিতরণ করবে এবং সার্টিফিকেট বিলাবে (Geoffrey Boulton and Colin Lucas -2008: ‘What are universities for’ League of European Research Universities Website)

নিউম্যানের সংজ্ঞা আমার কাছে সবচেয়ে বেশি মনঃপূত হয়েছে এবং এরই আলোকে আমি সমসাময়িক জগতের সেরা ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট তালাশ করে বের করার চেষ্টা করেছি কোন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিউম্যানের ধারণার সবচেয়ে কাছে। সাম্প্রতিক কিউএস র্যাংকিংয়ের ক্রমানুসারে, এই সেরা ১০টি হলো এমআইটি (ইউএসএ), অক্সফোর্ড (ইউকে), স্ট্যানফোর্ড (ইউএসএ), কেমব্রিজ (ইউকে), হার্ভার্ড (ইউএসএ), ক্যাল-টেক (ইউএসএ), ইম্পিরিয়াল কলেজলন্ডন (ইউকে), সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (সুইজারল্যান্ড), ইউনিভার্সিটি কলেজলন্ডন (ইউকে), ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো  (ইউএসএ)

পশ্চিমা দুনিয়ায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন স্তরের নিজস্ব পথপ্রদর্শক-নীতিমালা (Guiding principles) থাকে। প্রথম হলো দূরদৃষ্টি কিংবা চূড়ান্ত লক্ষ্য (Vision), তারপর আশু কর্তব্য (Mission), সব শেষে মৌলিক মূল্যবোধ (Core values) তিনটি বিষয় সামনে রেখে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তার জন্য স্বল্প, মধ্য দীর্ঘমেয়াদি কর্মকৌশল ঠিক করে। কৌশলপত্র যেহেতু একটি বিশাল বিরাট দলিল, তাই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্র কী, তার লক্ষ্য উদ্দেশ্য কী, তা বোঝার জন্য সংক্ষেপে দেখতে হয় তার চূড়ান্ত লক্ষ্য, আশু কর্তব্য মৌলিক মূল্যবোধ।

আমি তাই করেছি এবং যা পেয়েছি তাতে দেখা যায়, ১০টি অত্যন্ত নামিদামি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান জন হেনরি নিউম্যানের ধারণার সবচেয়ে কাছাকাছি। এবার দেখুন কেমব্রিজ কীভাবে সুন্দর করে তার তিন তিনটি নীতিমালা সাজিয়েছে।

চূড়ান্ত লক্ষ্য: . বিশ্বমানের পাঠদান এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুনিয়াজুড়ে কেমব্রিজের খ্যাতি বৃদ্ধি করা; . উদ্ভাবন, আবিষ্কার, উত্কর্ষ শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে সারা পৃথিবী থেকে সেরা অধ্যাপক, শিক্ষার্থী কর্মচারী-কর্মকর্তাদের কেমব্রিজে আকৃষ্ট করা।

আশু কর্তব্য: . পাণ্ডিত্য গবেষণা দ্বারা নিত্যনতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা; . কার্যকর  সময়োপযোগী শিক্ষণের মাধ্যমে জ্ঞানের আলো চারদিকে ছড়িয়ে দেয়া; . জনসেবার মাধ্যমে নতুন নতুন জ্ঞানের প্রয়োগ করা।

মৌলিক মূল্যবোধ: . চিন্তা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা; . সব ধরনের বৈষম্যহীন পরিবেশ বজায় রাখা।

আমার মতে, তাত্ত্বিক বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে নিউম্যানের ধারণাই সঠিক। তাই উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ হওয়া উচিত কেবল জ্ঞান বা বিদ্যা সৃষ্টি করা এবং কলেজগুলোর দায়িত্ব হওয়া উচিত বিদ্যা বিতরণ সার্টিফিকেট বিলি করা। কিন্তু বাস্তবে তো আমরা নিউম্যানের যুগে বাস করি না, তাই দেখা যায় বিশ্বায়ন, যুগের চাহিদা, প্রতিযোগিতার চাপ এবং ব্যবসার স্বার্থে সব দেশে নামি-বেনামি সব বিশ্ববিদ্যালয় সেভাবেই চলছে, যেভাবে চলতে বাধ্য হচ্ছে।

সব শেষে সব দেশের সরকারের প্রতি আমার একটি আবদার থাকবে, পাইলট প্রকল্প হিসেবে দেশে অন্তত একটি বিশ্ববিদ্যালয় থাকা উচিত, যেখানে নিরন্তর নতুন জ্ঞান তৈরি হবে এবং পুরনো জ্ঞান নিয়ে হামেশা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলবে।

 

আবু এন. এম. ওয়াহিদ: অধ্যাপক টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ 

[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন