ডলার নেই, আমদানি সংকোচনের পথে হাঁটছে শ্রীলংকা

বণিক বার্তা ডেস্ক

দুর্বল বাণিজ্য নীতি বিপাকে ফেলেছে শ্রীলংকার অর্থনীতিকে। কলম্বো বন্দরের দৃশ্য ছবি: রয়টার্স

মুদ্রা রিজার্ভ সংকটে ভুগছে শ্রীলংকা। পরিস্থিতি সামলাতে বাণিজ্য নীতিতে পরিবর্তন এনেছে কলম্বো। নিষিদ্ধ করা হয়েছে বেশকিছু পণ্যের আমদানি। অনেকটাই অপরিকল্পিত লক্ষ্যহীনভাবে প্রয়োগকৃত নতুন আমদানি নীতি কোনো সুফলই বয়ে আনতে পারেনি এখনো। বরং অর্থনীতির ক্ষত দিন দিন আরো বড় হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে কৃষি পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি খাতই এখন ধুঁকছে শ্রীলংকায়।

গত বছরের মার্চের দিকে প্রথম আমদানি সংকোচনের পথে হাঁটতে শুরু করে শ্রীলংকা। এরপর দিন দিন দেশটিতে আমদানি নিষিদ্ধের তালিকা আরো বড় হয়েছে। তালিকায় মোটরযান, এয়ারকন্ডিশনার থেকে শুরু করে পানীয়, বস্ত্র, কসমেটিকস এমনকি হলুদের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় মসলাও রয়েছে। দেশটির স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, বর্তমানে সেখানে টেলিভিশন, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার ওয়াশিং মেশিনসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানি নিষিদ্ধেরও পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আমদানির বড় মাত্রার সংকোচনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশটির ব্যক্তি খাত। ভোক্তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করতে পারছে না অনেক প্রতিষ্ঠানই। এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোরই ব্যবসা এখন পুরোপুরি বন্ধ।

অন্যদিকে বিপর্যয়ের আশঙ্কায় পড়েছে দেশটির কৃষি খাতও।  সার কৃষি রাসায়নিক আমদানি নিষিদ্ধ করার কারণে বিপাকে পড়েছেন শ্রীলংকার কৃষকরা। বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে এখন ক্ষোভ বিরাজ করছে। সংকট মোকাবেলায় কৃষকদের এখন অর্গানিক সার উৎপাদনে প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। যদিও গোটা প্রক্রিয়াটিই বেশ সময়সাপেক্ষ বলে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে।

কভিডের প্রাদুর্ভাব গত বছর শ্রীলংকার অর্থনীতিকে পুরোপুরি ধসিয়ে দিয়ে গিয়েছে। মহামারীর অভিঘাতে ২০২০ সালে দশমিক শতাংশ হারে সংকুচিত হয়েছে বলে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সংকটকে আরো জোরালো করে তুলেছে মুদ্রা ব্যবস্থার ভঙ্গুর দশা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও খুব একটা সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে নেই। গত মাসের শেষে দেশটির রিজার্ভের ব্যাপ্তি ছিল বিলিয়ন (৪০০ কোটি) ডলার। নিকট অতীতে রিজার্ভের এত বড় সংকটে পড়েনি শ্রীলংকা। বর্তমানে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার নিয়েছে। শ্রীলংকার মুদ্রা, পুঁজিবাজার সরকারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী অজিত নিভারদ কাবরাল গত মঙ্গলবার জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক একটি সভরেন বন্ড বাবদ প্রদেয় ১০০ কোটি ডলার পরিশোধের পর ওইদিন দেশটির রিজার্ভের আকার ছিল প্রায় ৩০০ কোটি ডলার।

দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বর্তমানে মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যমে সংকট কাটানোর চেষ্টা করেও পারছে না। চলতি বছরের শুরুর দিকে চীনের সঙ্গে কারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমে ১৫০ কোটি ডলার সংগ্রহ করে শ্রীলংকা। এছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে ২৫ কোটি ভারতের সঙ্গে ৪০ কোটি ডলারের সোয়াপ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তবে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদার তুলনায় অংক খুবই সামান্য। 

আগে থেকেই রিজার্ভের আকার ধরে রাখতে বড় ধরনের হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলেন কলম্বোর আর্থিক মুদ্রা খাতের নীতিনির্ধারকরা। এর মধ্যে কভিডের প্রাদুর্ভাব তাদের জন্য আরো বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় দেশটির পর্যটন খাতের কথা। পণ্য বাণিজ্যের বাইরে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস হলো পর্যটন খাত। বিভিন্ন উৎসে পাওয়া তথ্য বলছে, গত বছর খাতটি থেকে শ্রীলংকার আয় হয়েছে মোটে ৯৬ কোটি ডলার। যেখানে আগের বছরও খাতটি থেকে ৩৬০ কোটি ডলার আয় করেছিল দেশটি।

মহামারীর কারণে অর্থনীতিতে ধস নামলে সঞ্চিতির দ্রুত পতন কমাতে আমদানিতে লাগাম টানা শুরু করে শ্রীলংকা সরকার। দিনে দিনে লাগাম আরো শক্ত হয়েছে, যার ক্ষত বইতে হচ্ছে দেশটির ব্যক্তি খাতকে। এরই মধ্যে অনেক ব্যবসায়ী ব্যবসা গুটিয়ে নিতেও বাধ্য হয়েছেন।

লংকান ব্যবসায়ীরা এখন দেশটির জন্য কভিডের চেয়েও বড় হুমকি হিসেবে দেখছেন আমদানি নিষিদ্ধের নীতিকে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে নিয়ে তাদের নানা বক্তব্যও উঠে এসেছে। দেশটির এমনই পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর নিগোম্বোর এক মাঝারি ব্যবসায়ী স্টিভ চাই। আগে সেখানে জাপানি সুজুকি মোটরসাইকেলের পরিবেশক হিসেবে ব্যবসা করেছেন তিনি। ব্যবসায়ী হিসেবে বেশ সফলও ছিলেন। কিন্তু গত বছর বাজারে সরবরাহের জন্য মোটরসাইকেল আমদানি করতে না পেরে ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়েন স্টিভ চাই। 

সম্প্রতি জাপানি সংবাদ মাধ্যম নিক্কেই এশিয়াকে তিনি বলেন, তারা মোটরসাইকেল আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্চে। এরপর ছয় মাসের মধ্যে আমাদের ব্যবসায় টিকিয়ে রাখার মতো পণ্যের মজুদ ফুরিয়ে যায়।

তবে আমদানি নিষিদ্ধের কারণে শ্রীলংকায় সেকেন্ডহ্যান্ড পণ্যের বাজার এখন আকাশচুম্বী। স্টিভ চাই জানালেন, দেশটিতে বর্তমানে একটি সেকেন্ডহ্যান্ড স্কুটার লাখ রুপির (সর্বশেষ বিনিময় হার অনুযায়ী লাখ ১৩ হাজার টাকা) কম দামে পাওয়া যায় না। অথচ আমদানি নিষিদ্ধের আগেও সুজুকি ব্র্যান্ডের নতুন একেকটি মোটরসাইকেল পাওয়া যেত মাত্র সাড়ে লাখ রুপিতে (প্রায় দেড় লাখ টাকার সমপরিমাণ)

তার অভিযোগ, আমদানি নিষিদ্ধের কারণে বিপদে পড়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়ীদের সুরক্ষায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে শ্রীলংকার সরকার। তিনি বলেন, আমাদের ওপর কভিডের বড় একটা প্রভাব ছিল। কিন্তু আমদানি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত আমাদের ক্ষতি করেছে তার চেয়েও বেশি।

বৈধভাবে আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশটিতে এখন বেশকিছু পণ্যের কালোবাজারির মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমনকি মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থায়ও কালোবাজারই এখন সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছেন শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ডব্লিউএ বিজয়বর্ধন।  

বর্তমানে সার কৃষি রাসায়নিক আমদানির ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে শ্রীলংকা। বিষয়ে কলম্বোর যুক্তি হলো প্রতি বছর দেশটিকে এসব কৃষি উপকরণ আমদানিতে ৪০ কোটি ডলারেরও বেশি ব্যয় করতে হয়। তবে উদ্যোগের কারণে দেশটির কৃষি রফতানি খাতও ভুগতে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) শঙ্কা, উদ্যোগের ফলে দেশটির রফতানিযোগ্য কৃষিপণ্যের উৎপাদন ব্যাহত হবে। অন্যদিকে দেশটির চা পাম অয়েলের মতো অর্থকরী ফসল উৎপাদনে এর মারাত্মক প্রভাব পড়তে যাচ্ছে বলে সম্প্রতি ঋণমান সংস্থা ফিচ রেটিংসের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

ফিচ রেটিংস এরই মধ্যে শ্রীলংকার ঋণমান সিসিসি ক্যাটাগরিতে নামিয়ে এনেছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে শ্রীলংকাকে আরো হাজার ৯০০ কোটি ডলারের ঋণ পরিশোধের উপায় খুঁজে বের করতে হবে।

মুডি ইনভেস্টর সার্ভিস এরই মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক মুদ্রা ইস্যুকারী হিসেবে শ্রীলংকাকে সিএএ১ ক্যাটাগরিতে নামিয়ে এনেছে। বর্তমানে দেশটির ঋণমান কমিয়ে আনার বিষয়ে পর্যালোচনা চালাচ্ছে সংস্থাটি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন