কেন্দ্র ব্যবস্থাপনায় জটিলতা

নিবন্ধন করেও টিকার জন্য অপেক্ষমাণের সংখ্যা বাড়ছে

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

চলতি মাসের শুরুতে নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকার জন্য অনলাইনে নিবন্ধন করেছেন পঁয়তাল্লিশোর্ধ্ব সেফাত আলী প্রামাণিক। কেন্দ্র হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। কিন্তু টিকা গ্রহণের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো ক্ষুদে বার্তা পাননি তিনি। বিষয়টি নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন মধ্যবয়স্ক বেসরকারি চাকরিজীবী। অন্যদিকে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব আহনাফ ইসলাম গত মঙ্গলবার বিকালে নিবন্ধন করার পর মাত্র ঘণ্টার ব্যবধানে টিকা গ্রহণের জন্য ক্ষুদে বার্তা পান। তিনি রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) গিয়ে গত বুধবার টিকা গ্রহণ করেছেন।

দেখা গেছে, পছন্দসই কেন্দ্রে নিবন্ধন করে কেউ টিকা গ্রহণের জন্য ক্ষুদে বার্তা পাচ্ছেন খুবই কম সময়ে আবার কেউ পাচ্ছেন মাস পেরিয়ে। এরপর ক্ষুদে বার্তা পেলেও আবার টিকা গ্রহণের তারিখ পাচ্ছেন দুই সপ্তাহের ব্যবধানে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে দেশে নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধে টিকাদান কর্মসূচি চলমান রেখেছে সরকার। টিকা গ্রহণের জন্য সরকারের নির্দিষ্ট সুরক্ষা ওয়েবসাইট অ্যাপে গিয়ে নিবন্ধন করছেন টিকাপ্রত্যাশীরা।

নিবন্ধনকৃত কেন্দ্র পর্যায়ক্রমে নাগরিকদের ক্ষুদে বার্তা পাঠায়। এর মধ্যে কোনো কেন্দ্রে বেশি নিবন্ধন হলে তাতে টিকা নেয়ার জন্য ক্ষুদে বার্তা আসতে দেরি হয়। আর যে কেন্দ্রে নিবন্ধন কম, তাতে কম সময় লাগে। নিবন্ধনে নির্দিষ্ট এলাকা উল্লেখ করার পর সক্ষমতা নিবন্ধনের সংখ্যা বিবেচনা করে কেন্দ্র নির্ধারণে সার্ভারের বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করলে জটিলতা সৃষ্টি হতো না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, কেন্দ্রের দৈনিক সক্ষমতা বিবেচনা না করেই নিবন্ধন উন্মুক্ত রাখায় টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে দেরি হচ্ছে। রাজধানীসহ সারা দেশে এমন অনেকে নিবন্ধনের পর টিকা গ্রহণের জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছেন। ফলে বর্তমানে নিবন্ধনের সংখ্যা বাড়লেও টিকা পাওয়ার হার কম।

গত ৩০ জুন টিকার নিবন্ধন কার্যক্রম দ্বিতীয় দফায় উন্মুক্ত করে সরকার। জানা গেছে, গত ৩০ জুন থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত ৬২ লাখ ২২ হাজার ২৯৮ জন টিকাপ্রত্যাশী নিবন্ধন করেছেন। পর্যন্ত মোট নিবন্ধন করেছেন প্রায় কোটি ৪০ লাখ মানুষ। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশই নিবন্ধন করেছেন গত ২৮ দিনে। বছরের শুরুতে নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধে টিকা কার্যক্রম শুরু হলে বিষয়টি নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতি ছিল। পরে সরকারি প্রচারণা, বিভিন্ন দেশে টিকা প্রয়োগের খবর পাওয়া বয়সের সীমা কমানোর কারণে নিবন্ধন বৃদ্ধি পায়। তবে নিবন্ধনের হার বাড়লেও টিকা পাওয়ার হার সে তুলনায় বাড়েনি। অর্থাৎ এখন মানুষের মধ্যে টিকা নেয়ার আগ্রহ তৈরি হলেও দৈনিক সক্ষমতা অনুযায়ী টিকা দিতে পারছে না স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ।

সরকারের হিসাব বলছে, গত ফেব্রুয়ারি দেশে গণপরিসরে টিকা কার্যক্রম শুরু হয়। সে সময় ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১০ দিনে ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ৩৬৮ ডোজ টিকা প্রয়োগ করা হয়। বর্তমানে মডার্না, সিনোফার্ম ফাইজারের টিকা গণপরিসরে প্রয়োগ করছে সরকার। জুলাই থেকে রাজধানীর সাত কেন্দ্রে ফাইজার, ১২ জুলাই থেকে জেলা উপজেলায় সিনোফার্ম এবং ১৩ জুলাই থেকে সিটি করপোরেশন এলাকায় মডার্নার টিকা প্রয়োগ চলছে। এর আগে সিনোফার্ম প্রয়োগ করা হলেও তা গণপরিসরে হয়নি। গণপরিসরে প্রয়োগ শুরুর পর ১০ দিনে তিন টিকার ১৭ লাখ ৯০ হাজার ৬৩৯ ডোজ প্রয়োগ করা হয়, যা ফেব্রুয়ারির চেয়ে মাত্র ১৩ শতাংশ বেশি।

সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ বা ১৩ কোটি ৮২ লাখ মানুষকে টিকা দেয়া হবে। মোট তিন পর্যায়ে পাঁচ ধাপে তাদের টিকার আওতায় আনা হবে। দেশে বর্তমানে হাজার ৫টি কেন্দ্রে টিকা কার্যক্রম চলমান। এসব কেন্দ্রে মোট হাজার ৪০০টি দল টিকা প্রয়োগের কাজ করছে। প্রতিটি দলে দুজন টিকা প্রয়োগকারী চারজন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন। প্রতিটি দল দৈনিক ১৫০ জনের শরীরে টিকা প্রয়োগে সক্ষম বলে জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সে হিসেবে দৈনিক সাড়ে তিন লাখের বেশি মানুষের শরীরে টিকা প্রয়োগের সক্ষমতা থাকলেও দেশে দৈনিক টিকা দেয়া হচ্ছে প্রায় আড়াই লাখ মানুষকে।

কর্মসূচির শুরুতে চল্লিশোর্ধ্ব অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কয়েক শ্রেণী-পেশার মানুষকে নিবন্ধনের সুযোগ দেয় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। পরে বয়সের সীমা কয়েকদফা কমিয়ে এনে তা ২৫- আনা হয়। শিগগরিই তা ১৮-তে নামিয়ে আনা হবে বলে পরিকল্পনা করছে সরকার। এতে স্বাভাবিকভাবেই নিবন্ধন সংখ্যা বাড়লেও কেন্দ্র ব্যবস্থাপনার জটিলতার কারণে ভোগান্তি আরো বৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সরকারের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) সাবেক প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. তাজুল ইসলাম বারী বণিক বার্তাকে বলেন, টিকার নিবন্ধনের বিষয়ে আরো সংশোধন আনা দরকার। বিষয়টি এমন হতে পারত যে কোনো ব্যক্তি এলাকা নির্ধারণ করে নিবন্ধন করবেন। ওই এলাকার টিকা কেন্দ্রের নিবন্ধনের সংখ্যা সক্ষমতা বিবেচনা করে সে অনুযায়ী একটি কেন্দ্রে নিবন্ধন হয়ে যাবে তারা। পুরো বিষয়টিই স্বয়ংক্রিয়ভাবে হবে। ফলে একই ভারসাম্য থাকবে। অন্যথায় পছন্দসই কেন্দ্র নির্বাচন করার সময় মানুষ জানে না যে কেন্দ্রে সে নিবন্ধন করছে, সেখানে আরো কতজন মানুষ নিবন্ধন করেছে এবং কেন্দ্রটির দৈনিক সক্ষমতা কত।

তবে এখনই স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেন্দ্র নির্ধারণের কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, মুহূর্তে বয়স কমিয়ে নিবন্ধন সহজ করা হচ্ছে। পরিস্থিতি অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। ১৮ বছরের বেশি বয়সী সবাইকে টিকার আওতায় আনতে সরকার কাজ করছে। যাতে ভোগান্তি না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখা হচ্ছে।

টিকাদান-সংক্রান্ত কিছু বিষয় এখনো অবহেলার মধ্যে থেকে যাচ্ছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বণিক বার্তাকে বলেন, টিকা নিয়ে এখনই আরো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে কাজ করা দরকার। যেভাবে মানুষ নিবন্ধন করছেন অপেক্ষা করছেন, তাতে এক সময় দালাল চক্র তৈরি হবে। এতে মানুষ প্রকৃত সেবা পাবে না। যখন কোনো সেবা পেতে মানুষের অপেক্ষার সময় বাড়ে হয়রানির শঙ্কা থাকে, তখনই তাতে অসাধু চক্র তৈরি হয়। টিকা কার্যক্রম আরো ঝামেলাহীন করার বিকল্প নেই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন