ভঙ্গুর স্বাস্থ্য খাত

সুলভে সব নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে

বিশ্বে সরকারি, বেসরকারি এনজিওতিন ধরনের সফল স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালু আছে। বাংলাদেশ এর কোনোটির মধ্যেই নেই। চিকিৎসাসেবায় দ্রুতগতিতে বাড়ছে বেসরকারি অংশীদারি নিয়ন্ত্রণ। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্বাস্থ্যসেবার ৭০ শতাংশের বেশি জোগাচ্ছে ব্যক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে ব্যক্তির স্বাস্থ্য ব্যয় কমার বদলে বাড়ছে। স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের নিজস্ব ব্যয় (আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার) অনেক বেশি। সর্বশেষ হিসাবে দেখা যায়, স্বাস্থ্যসেবার পেছনে যত ব্যয় হয়, তার ৭৪ শতাংশ মানুষ নিজের পকেট থেকে করে, যা এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। এটি সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বাস্তবায়নে বড় বাধা। স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে মানুষের নিজস্ব ব্যয় কমিয়ে আনতে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর বিকল্প নেই।

অস্বীকারের উপায় নেই, কভিড-১৯ মহামারী দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। শক্তিশালী নেটওয়ার্কের কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যেমন কভিডের টিকা কার্যক্রমের আওতায় এসেছে আবার এর বিপরীতে মানসম্পন্ন সেবার অভাবে রোগীকে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরতে দেখা গেছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের অন্তর্নিহিত বিভিন্ন দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠেছে সময়ে। শহরাঞ্চলে সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রের অপ্রতুলতা, বিভাগীয় শহরের বাইরে বিশেষায়িত চিকিৎসক, আইসিইউসহ প্রয়োজনীয় হাসপাতাল এবং জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা উপকরণের অভাব, বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে খরচের নিয়ন্ত্রণ বা স্বাস্থ্যবীমা না থাকায় চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে জনগণের নাভিশ্বাস ওঠা ইত্যাদি। এছাড়া জনস্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধা এবং কভিড প্রতিরোধে জনসম্পৃক্তকরণে ব্যর্থতা, সংক্রামক ব্যাধি ২০১৮ আইন থাকা সত্ত্বেও জনগণকে ঝুঁকিপূর্ণ চলাফেরা অস্বাস্থ্যকর ব্যবহারে নিবৃত্ত করতে না পারা এবং পরিকল্পনায় ঘাটতিসহ নীতিনির্ধারকদের বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এসব ঘাটতি দূরীকরণে একটি সর্বজনীন পরিকল্পনা প্রয়োজন।

নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে বাংলাদেশে বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকের সম্প্রসারণ ঘটে বলা যায়। বাংলাদেশে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের তুলনায় বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র বেশি এবং উত্তরোত্তর এর সম্প্রসারণ ঘটছে। বাংলাদেশে বেসরকারি চিকিৎসা খাত বিশাল এক বাজার। অথচ প্রায় ৪০ বছর আগের বিধিমালা অনুযায়ী খাত পরিচালিত হওয়ায় দৃশ্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বেসরকারি হাসপাতাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিশনার অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) অধ্যাদেশ ১৯৮২-এর বিধিমালা অনুযায়ী পরিচালিত হওয়ার কথা থাকলেও সেটি হচ্ছে না। তাছাড়া ব্যবসায়িক মুনাফার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এসব কেন্দ্রে নিয়ন্ত্রণের জন্য বিধিমালা কখনই যুগোপযোগী ছিল না। বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ অনুযায়ী বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালিত হয়, যার ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত।  একইভাবে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইন ২০১০, মানসিক স্বাস্থ্য আইন ২০১৮সহ বিদ্যমান একাধিক আইন বিধিমালায় অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন প্রয়োজন।

জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১-তে সেবা সরবরাহের ক্ষেত্রে দুর্বল ব্যবস্থাপনা, সম্পদের সীমাবদ্ধতা, সেবার দুর্বল গুণগত মানের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহীতাদের সামর্থ্যহীনতা, জ্ঞান স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী জীবনযাপন পদ্ধতি অনুসরণ না করা ইত্যাদি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছে, যা আজও প্রাসঙ্গিক। থেকে উত্তরণে যে কর্মকৌশলগুলো সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো জাতীয় স্বাস্থ্য কাউন্সিল গঠন করা। কাউন্সিল স্বাস্থ্যনীতি বাস্তবায়নে দিকনির্দেশনা প্রদান করবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মকৌশল যেখানে চাকরিজীবীদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা এবং অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে, যা গত ১০ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। তাছাড়া বেসরকারি খাতে স্বাস্থ্যসেবা চিকিৎসা ব্যবস্থায় রোগীদের সঠিক এবং মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় বিধিবিধান তৈরি প্রয়োগ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ অন্যান্য চিকিৎসা ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে রাখার কথা বলা হয়েছিল। এক্ষেত্রেও কোনো অগ্রগতিই হয়নি। এগুলো অসম্পূর্ণ রেখে কাগজে-কলমে ভবিষ্যতে যত আকর্ষণীয় নীতি, পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হোক না কেন তা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে না।

ভারতের নতুন স্বাস্থ্যনীতিতে বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করার পাশাপাশি তার সার্বিক সমাধানের ওপরও বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে। এজন্য বেসরকারি খাতের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। স্বাস্থ্য পরিচর্যার মানোন্নয়ন, বিভিন্ন রোগ-ব্যাধির মোকাবেলা এবং স্বাস্থ্য পরিচর্যা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হলো নীতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ভারতের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১৭ হলো নাগরিককেন্দ্রিক উন্নতমানের এক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি। মূল উদ্দেশ্য হলো নাগরিকদের সুস্বাস্থ্য এবং ভালো থাকার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ মাত্রায় উন্নীত করা। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে দেশের কোনো নাগরিকই যাতে স্বাস্থ্য পরিষেবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়, তা নিশ্চিত করা নীতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যনীতিও একইভাবে সংশোধন করা প্রয়োজন।

২০১২ সালে স্বাস্থ্য পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তৈরি স্বাস্থ্য অর্থায়ন কৌশলপত্রে বলা হয়েছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় কমিয়ে ৩২ শতাংশে আনা হবে। কৌশলপত্র তৈরির সময় স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৪ শতাংশই বহন করতেন ব্যক্তি, সরকার দিত ২৬ শতাংশ আর অন্যান্য উৎস থেকে আসত বাকি ১০ শতাংশ। কিন্তু অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় বাজেট, সরকারের নীতি পরিকল্পনায় ধারাবাহিকভাবে স্বাস্থ্যকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে বছরে মাথাপিছু ব্যয় হয় মাত্র ৩২ ডলার, যা এশিয়ার অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক কম। স্বাস্থ্য খাত বরাবরই অবহেলার শিকার। দীর্ঘ সময়ে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ মোট জাতীয় বাজেটের দশমিক থেকে দশমিক (গড়ে দশমিক ) শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ এবং জিডিপির ক্ষেত্রে সব সময়ই শতাংশের নিচে থেকেছে। অর্থাৎ সরকারিভাবে স্বাস্থ্য খাতকে সঠিক গুরুত্ব দিয়ে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে না। ফলে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারি ব্যয়ে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য অর্থায়ন কৌশলপত্রে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি (এসএসকে) নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা হয়। এটি মূলত এক ধরনের স্বাস্থ্যবীমা কর্মসূচি, যেখানে বীমার আওতাভুক্ত ব্যক্তি এবং তার পরিবার ইলেকট্রনিক হেলথ কার্ডের মাধ্যমে বিনামূল্যে ৭০ ধরনের অসুখে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা পাবে। প্রাথমিকভাবে অতিদরিদ্র মানুষ সেবা পাবে পরিকল্পনা করা হলেও ধাপে ধাপে বাংলাদেশের সব মানুষকে প্রকল্পের আওতায় আনার কথা বলা হয়। পাইলট প্রকল্প পর্যন্তই এটি আটকে রয়েছে, যা হতাশাজনক।

সদা পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে স্বাস্থ্য খাতে তথ্যপ্রযুক্তিগত নিত্যনতুন সেবা সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তিগত পরিবর্তন ছাড়াও চিরায়ত কিছু চ্যালেঞ্জ প্রচলিত নীতিমালা এবং আইনের বাইরেও বিদ্যমান। মানসম্মত সেবা নিশ্চিতে, স্বচ্ছতা জবাবদিহিতার স্বার্থে স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন অতি প্রয়োজনীয়। ইলেকট্রনিক মেডিকেল রেকর্ডস (ইএমআর) সেবা যেমন দরকারি, তেমনি তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষাসহ ডিজিটাল হেলথের বিভিন্ন অনুষঙ্গ যেমন টেলিমেডিসিন সেবা নিয়ন্ত্রণে বিধিমালা প্রণয়ন এবং বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেয়ার সময় এখনই। ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নে কভিড-পরবর্তী জটিলতা, চিকিৎসা গবেষণা, অসংক্রামক ব্যাধি, ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ার মতো নতুন-পুরনো অসুখের পুনরায় বিস্তার, বয়স্ক ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য সমস্যা, মলিকিউলার ডায়াগনস্টিকস, অভিবাসীদের স্বাস্থ্য সমস্যা, হেলথ ট্যুরিজম প্রভৃতি ক্ষেত্রে সম্ভাব্য উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় নিতে হবে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য শক্তিশালী সরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন