বিশ্ব অর্থনীতি

এশিয়ার পরাশক্তিরা কোথায়?

জয়তী ঘোষ

সময়টি সম্পূর্ণভাবে এশীয় শতাব্দী হওয়ার কথা ছিল। অথচ চীন অনেকটা এককভাবেই নেতৃত্ব দিয়েছে। একক দেশ হিসেবে সামনের সারিতে আছে এবং গল্পের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশও তারা। অন্যান্য দেশেরও আঞ্চলিক তারকা রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তালিকায় ভারতের মতো ভীষণ সম্ভাবনাময় দেশ যেমন আছে, তেমনি দ্রুত শিল্পায়ন উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ মালয়েশিয়া, কৌশলগতভাবে সুপেয় পানি অন্যান্য কাঁচামালের গুরুত্বপূর্ণ রফতানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিত ইন্দোনেশিয়া এবং অঞ্চলের আরো নতুন কয়েকটি দেশ, যারা ক্রমে ভালো করছে, যেমন ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশও রয়েছে। 

জনসংখ্যা অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যের সম্ভাবনা থেকে অনেকে এশিয়াকে বিশ্বের সর্বাধিক গতিশীল অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করেছেন। চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি বিকশিত সাপ্লাই চেইন অনিবার্যভাবে অঞ্চলটির বেশির ভাগ অংশকে টেনে তুলবে বলে মনে করা হয়েছে। চীনের নিজের বহির্বাণিজ্য এবং বিদেশী বিনিয়োগ পরিকল্পনা ধারণাকে আরো শক্তিশালী করে। তাছাড়া ধরে নেয়া হয়েছে যে দেশটি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ এবং বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ যেমন চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অব চায়না এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের মাধ্যমে অনেক বেশি কাঠামোগত উন্নয়নে বৈদেশিক ঋণসহায়তা প্রদান করবে। প্রচেষ্টায় পরিবহন জ্বালানি অবকাঠামোগত বিকাশ ঘটবে। উন্নত অঞ্চল এবং বিশ্ববাণিজ্যের জন্য যৌক্তিক সহায়তা সরবরাহ করবে। পাশাপাশি ১৫টি দেশ মিলে গঠিত আঞ্চলিক সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের জোটটি পরবর্তী সময়ে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর উত্থানের দিকে এগিয়ে যাবে। ২০১০ দশকের শুরুর দিকে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হতো যে ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের সময় অন্যদের তুলনায় অঞ্চল দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করে।

তবে গত কয়েক দশকে যোগ হয়েছে অনেক পরিবর্তন। চীনকে ঘিরে পশ্চিমাদের ঘোর এবং দেশটির উত্থান নিয়ে তাদের মাথাব্যথার কারণগুলো দেখে মনে হয় জি৭ নেতারা (এবং বেশির ভাগ পশ্চিমা ভাষ্যকার) এশিয়ার অন্যান্য উদীয়মান বাজার ঘিরে খুব একটা মনোযোগ দিচ্ছেন না। তারা যদি মনোযোগী হতেন, তবে অবশ্যই এটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হতেন যে তাদের মধ্যে অনেকেই এক ধরনের প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। অবশ্যই কভিড সংকটের কারণে উৎপাদন বিনিয়োগ দুটোই হ্রাস পেয়েছে, আর পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা এখনো অনিশ্চিত। যদিও মহামারী শুরুর আগে থেকেই অঞ্চলের অর্থনৈতিক গতিশীলতা হ্রাস পেতে শুরু করে। তবে ভিয়েতনামের মতো কয়েকটি অপেক্ষাকৃত ছোট এশীয় অর্থনীতি সমর্থ হয়েছে মহামারীর মধ্যেও তাদের রফতানি সক্ষমতা ধরে রাখতে। কিন্তু অনেক দেশই মন্দার শঙ্কায় ভারাক্রান্ত হয়েছে এবং বৈচিত্র্য ফেরাতে দুর্বল চালিকাশক্তির প্রদর্শন করেছে।

এশিয়ার চারটি উদীয়মান অর্থনীতি ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া থাইল্যান্ডের কথা বিবেচনা করুন। যারা ব্যাপকভাবে এশিয়ার সাফল্যের উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতো এবং বিশ্বব্যাপী পছন্দের আর্থিক বাজারে পরিণত হয়েছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় উল্লিখিত চারটি দেশেরই জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। ২০১৬ সালে ভারতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি যেখানে শতাংশ ছিল, ২০১৯- তা প্রায় অর্ধেক হ্রাস পেয়ে হয় শতাংশ। তাছাড়া ধারণা করা হয় যে গণনা প্রক্রিয়ার কারণে সংখ্যাগুলো অনেকটাই বাড়িয়ে দেখানো হয়। 

গত দশকে থাইল্যান্ডের অর্থনীতি প্রতি বছর প্রায় শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেলেও ২০১৯- এসে মাত্র দশমিক শতাংশ হয়। একই সময়কালে মালয়েশিয়ার অর্থনীতিও দশমিক শতাংশ থেকে কমে দশমিক শতাংশ হয়েছে। শুধু ইন্দোনেশিয়ার ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির হার ২০১০ সালে দশমিক শতাংশ থেকে সামান্য কমে ২০১৯ সালে শতাংশ হয়। প্রবৃদ্ধির হার হ্রাসের একটি সুষ্পষ্ট কারণ হচ্ছে বিনিয়োগের পরিমাণ কমে যাওয়া। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং থাইল্যান্ডে মূলত ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে সংঘটিত পূর্ব-এশীয় সংকট দ্বারা পরিচালিত একটি মাঝারি মেয়াদি প্রবণতার প্রতিফলন ঘটেছে, ফলে বিনিয়োগের হার কমপক্ষে এক-চতুর্থাংশ হ্রাস পেয়ে জিডিপির ৪০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ হয়।

মালয়েশিয়ায়ও ২০১০ দশকের সময়কালে বিনিয়োগের নিম্নগতি পরিলক্ষিত হয়। ২০১৯ সালে দেশটিতে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল জিডিপির মাত্র ১৯ শতাংশ। একই ঘটনা ঘটে ভারতের ক্ষেত্রেও। ২০১০ সালে তাদের বিনিয়োগের হার জিডিপির ৪০ শতাংশ থাকলেও ২০১৯ সালে কমে হয় ৩০ শতাংশ। তাছাড়া ২০২০ সালে মহামারীর বছরে দেশগুলোয়  বিনিয়োগের নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা দেয়।

পর্যায়ে কভিড-১৯-এর প্রভাব একপাশে রেখে আমরা যদি প্রশ্ন করি, বিনিয়োগের হার কেন কমেছে? সেক্ষেত্রে বলা যায়, দেশগুলো শুধু চীন থেকে ইতিবাচক প্রণোদনাই প্রাপ্ত হয়নি, বরং বৈশ্বিক অর্থনীতির সরাসরি সুবিধাভোগী ছিল। তারা বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগ আকর্ষণ করেছেপ্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ, পোর্টফোলিও প্রবাহ, বন্ডের মাধ্যমে অর্থায়ন বাহ্যিক বাণিজ্যিক ঋণ। তাহলে প্রশ্ন আসে, সব মিলিয়ে কেন এগুলো উচ্চতর বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ঘটাতে সমর্থ হয়নি?

পর্যায়ে মূল সমস্যা ছিল অনিয়ন্ত্রিত মূলধন প্রবাহ। গত এক দশকের বেশির ভাগ সময়ে মালয়েশিয়া মূলত ছিল মূলধন রফতানিকারক। যেমনটা কয়েক বছর ধরে থাইল্যান্ডও করেছে। আরো খারাপ দিকটি হচ্ছে, বিদেশ থেকে দেশগুলোর আর্থিক সম্পদ রিটার্নের হার (কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিংবা বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে) ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে অনেক কম।

বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য বার্ষিক ক্ষতির দিকে নিয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, থাইল্যান্ডে ক্ষতির পরিমাণ ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর জিডিপির দশমিক শতাংশ করে, যা মূলধনের নিট প্রবাহের চেয়ে অনেক বেশি। এমনকি যেখনে নিট মূলধন প্রবাহ ইতিবাচক অবস্থায় রয়েছে, যেমন ভারত ইন্দোনেশিয়া, তারাও তাদের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং কাঙ্ক্ষিত খাতগুলোয় বিনিয়োগ করতে সমর্থ হয়নি। এর পরিবর্তে বরং সম্ভাব্য মুদ্রা পাচার বিনিময় হারের ভারসাম্য ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে।

এদিকে উদীয়মান অর্থনীতির সরকারগুলো নেতিবাচক আর্থিক বাজারের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে এতটাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল যে তারা বর্তমান মহামারীসহ মন্দা মোকাবেলা করতে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী আর্থিক সহায়তা প্রদানের ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করেছে। অদ্ভুতভাবে তাই অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের জন্য উদীয়মান বাজারকে আরো বেশি সমর্থন জোগাতে আর্থিক উদারীকরণের যে কথা ছিল, তা সম্পূর্ণ বিপরীত প্যাটার্নে পৌঁছেছে।

এমন কোনো ম্যাজিক বুলেট নেই, যা এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির বাস্তবিক উত্থান তাদের সার্বিক প্রতিশ্রুতি পূরণের বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে পারে। তবে দেশগুলো তাদের মূলধন হিসাব পরিচালনার ক্ষেত্রে মৌলিক পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে কাজ শুরু করতে পারে, যা তাদের জন্য বরং কল্যাণকর হবে।

[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

জয়তী ঘোষ: নির্বাহী সম্পাদক, ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস অ্যাসোসিয়েটস অধ্যাপক, ম্যাসাচুসেটস অ্যামহার্স্ট ইউনিভার্সিটি

ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন