অভিমত

বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’ বাড়াতে করণীয়

ড. জাহাঙ্গীর এইচ মজুমদার

শততম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পার করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ব্র্যান্ড ভ্যালু রয়েছে, এটা অস্বীকার করার জো নেই। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েরও কম-বেশি ব্র্যান্ড ভ্যালু রয়েছে। যদিও এটা প্রায় নিশ্চিত যে চাকরিদাতারা চাকরিপ্রত্যাশীদের যোগ্যতা দেখেই নিয়োগ দেন; তথাপি চাকরিপ্রত্যাশীদের সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে আলমা ম্যাটারের ব্র্যান্ড ভ্যালুর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। একটা উদাহরণ দিই। ফুটবল একটা বৈশ্বিক খেলা। তার পরও দেখা যায় ইউরোপের দেশগুলোর ঘরোয়া ফুটবলেই বিশ্বের তাবৎ তারকা খেলোয়াড় ভিড় জমান। না, এখানে টাকাটাই মুখ্য নয়, এখানকার ব্র্যান্ড ভ্যালু জমাট প্রতিযোগিতাই তাদের টানে। সে কারণে পেট্রোডলারের ধনী দেশগুলো, চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাবগুলো অধিক পরিমাণ টাকা দেয়ার প্রস্তাব করলেও মেসি বা রোনালদোরা সেখানে খেলতে যান না। তবে একদম যে যান না তা নয়, তারা তাদের খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টানতে। তাই ব্র্যান্ড ভ্যালুর ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যাগ নিজে দিলে হবে না, তা দিতে হবে অন্যদের।

১৯২১ সালের জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে যতটা শিক্ষার সম্প্রসারণের উদ্যোগ ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল ব্রিটিশরাজ পূর্ববঙ্গের মুসলিমদের মধ্যকার রাজনৈতিক টানাপড়েন হ্রাসের প্রচেষ্টা। মুনতাসীর মামুন ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী গ্রন্থে লিখেছেন, লর্ড লিটন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সেপ্লনডিড ইম্পেরিয়াল কমপেনসেশন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অনেকে অভিমত দেন, ১৯৪৭ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়টি বিদ্যাচর্চা গবেষণায় নজরকাড়া সাফল্য দেখিয়েছে, রাজনীতি প্রতিষ্ঠানটিকে স্পর্শ করেনি। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের সূচনায় শিক্ষা ভাষা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের উদ্ভট নানা পরিকল্পনার প্রতিক্রিয়া শিক্ষার্থীদের রাজনীতির ময়দানে নিয়ে আসতে থাকে। জনগণের সচেতন অংশ অসংগঠিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে তাদের এগিয়ে আসাটা মনে হয় অবশ্যম্ভাবী ছিল। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হয়। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে তা দৃঢ়ভাবে উদ্ভাসিত হয় এবং ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্র সৃষ্টিতে পরিপূর্ণতা পায়। আর সর্বশেষ ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বলা যায় অধ্যায়ের যবনিকাপাত ঘটে। প্রতিষ্ঠানটি জাতির দুঃসময়ে অবদান রাখা আর বিদ্যাচর্চা গবেষণার ক্ষেত্রে ব্যস্তানুপাতে অগ্রসর হয়েছে। তবে ধারণা করা হয়, ১৯৯০-এর পর দুই সূচকের গতিই নিম্নমুখী। বর্তমান সময়ে প্রকাশিত বিভিন্ন তালিকায় দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টি এশিয়ার মানেও পিছিয়ে রয়েছে, বৈশ্বিক মানে তো বটেই।

উচ্চশিক্ষা বিশেষজ্ঞ, মরোক্কান বংশোদ্ভূত জামিল সালমি ২০০৯ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন, তিনটি উপাদান আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে এগিয়ে রাখে। তিনটি উপাদানের প্রথমটি হলো মেধাবী শিক্ষক, শিক্ষার্থী গবেষকদের ঘন নিবিড় উপস্থিতি। মেধাবীদের এক ভূখণ্ডে না- পাওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষক, শিক্ষার্থী গবেষকদের টানতে দেশের ভূখণ্ডের সীমানার বাধা সরিয়ে দেয়। ফলে নামটা যেমন বিশ্ববিদ্যালয়, তেমনি বিশ্বের সব প্রান্তের সব মেধাবীকে জড়ো করতে তারা দ্বারের অর্গল খুলে অপেক্ষা করে। সে কারণে মার্কিন মুলুকে এফ আর খান সিয়ার্স টাওয়ারের নকশা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। হাল আমলের প্রিন্সটনের ইউজিন হিগিন্স অধ্যাপক বাংলাদেশের জাহিদ হাসান সেখানে বসে কোয়ান্টাম ফিজিকসের  টপোলজিক্যাল ইনসুলেটর ভাইল ফার্মিয়ান নিয়ে মৌলিক গবেষণা করছেন। অনেকে ভবিষ্যদ্বাণী করেন, আগামীতে তিনি নোবেল বিজয়ী হতে পারেন। তার প্রিন্সটনে নিয়োগ পাওয়ার ঘটনাটি বেশ চমকপ্রদ। এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছেন, আমি একটা বক্তৃতা দিতে গিয়েছি প্রিন্সটনে। বক্তৃতা শেষেই তারা আমাকে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানায়। কোনো জীবনবৃত্তান্তও তৈরি ছিল না। পিএইচডিও শেষ হয়নি। এমনটি কি বাংলাদেশে ভাবা যায়? অন্যদিকে ভারতীয় পিচাই সুন্দরাজন আর সত্য নারায়ণ নাদেলা যথাক্রমে অ্যালফাবেট (গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান) আর মাইক্রোসফটের মতো টেক জায়ান্টকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মিসরীয় নারী অর্থনীতিবিদ মিনুচে শফিক লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। এখন দেখা যাক বিশ্বের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কী পরিমাণ বিদেশী শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। উদাহরণ হিসেবে হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড, কলাম্বিয়া কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়কে বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, এদের ওখানে যথাক্রমে ১৯, ২১, ২৩ ১৮ শতাংশ, অর্থাৎ গড়ে প্রতি চারজনের একজন শিক্ষার্থী বিদেশী। এখন আসা যাক আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কতজন বিদেশী শিক্ষার্থী আছেন? আমাদের ব্র্যান্ড ভ্যালু কি মেধাবী বিদেশী শিক্ষার্থীদের টানতে পারছে? উত্তর নেতিবাচক হওয়ার কথা। ইদানীং আমাদের মেধাবীরাও অন্য দেশে পাড়ি দিচ্ছেন। 

সালমি দ্বিতীয় যে উপাদানটির কথা বলেছিলেন, সেটি হলো বাজেট। বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ পেয়ে থাকে। সরকারি অর্থে তারা প্রধানত অপারেশনাল গবেষণা কার্যক্রম চালায়। এছাড়া চুক্তিভিত্তিক বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সংস্থা থেকে গবেষণার জন্য তারা বিপুল তহবিল পেয়ে থাকে। তদুপরি এনডাউমেন্ট, উপহার, শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি থেকেও তারা আয় করে। ইদানীং উন্নত রাষ্ট্রগুলোয় বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বেসরকারি গবেষণামূলক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেশ ভালো করছে। বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থপ্রাপ্তি তাদের বিকাশ ত্বরান্বিত করছে। উদাহরণ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ধনী বিশ্ববিদ্যালয়টির কথা বলা যায়। এটি বার্ষিক শিক্ষার্থীপিছু ৪০ হাজার মার্কিন ডলার (প্রায় ৩৪ লাখ টাকা) পেয়ে থাকে। এবার আসা যাক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ৮৩১ কোটি টাকা। শিক্ষার্থীপিছু আনুমানিক প্রাপ্তি দাঁড়ায় লাখ ৮০ হাজার ৬৫ টাকা মাত্র (২০১৮-১৯ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৮তম বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযাযী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৬,১৫০ জন) অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষার্থীপিছু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় প্রায় ৯৫ শতাংশ বেশি অর্থ আয় করে। এশিয়ার ব্যাঘ্র অর্থনীতির দেশ সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি শুধু সরকারের দয়ার ওপর নির্ভর না করে বিভিন্ন উৎস থেকে ফান্ড সংগ্রহ করছে। বিশ্বমানে পৌঁছে যাওয়া তাদের উত্থান রীতিমতো ঈর্ষণীয়। আসলে পর্যাপ্ত অর্থপ্রাপ্তির একটা চেইন রিঅ্যাকশন রয়েছে। অধিক ফান্ড মানে মেধাবীদের মধ্যেও মেধাবীদের টানতে পারার সুযোগ সক্ষমতা সৃষ্টি। অর্থের সমাগম পুরো ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনে।

সালমি তৃতীয় কারণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন স্বাধীনতা, স্বায়ত্তশাসন নেতৃত্বের সমন্বিত বিষয়টি। তিনি মনে করেন, বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ এমন যে তা প্রতিযোগিতা, বাধাহীন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, ক্রিটিক্যাল থিংকিং, উদ্ভাবন সৃজনশীলতাকে বিকশিত করে। পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন মানে আমলাতন্ত্র অন্যান্য বাহ্যিক শক্তির হাত থেকে নিজেদের মুক্ত রেখে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বৈশ্বিক বাজারের পরিবর্তনের সঙ্গে দ্রুত সাড়া প্রদান করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়েছিল; তার সুষ্ঠূ প্রয়োগ, নাকি অপপ্রয়োগ হয়েছে তা গবেষণার বিষয়। আর নেতৃত্ব নিয়ে বলার তেমন কিছু নেই। বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সমস্যায় ধুঁকছে।

জামিল সালমি যে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন, তার প্রায় সবগুলোই অর্জনযোগ্য। তবে মাত্রা পরিমাণে হয়তো রাতারাতি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছানো যাবে না। সালমির মডেল অনুসরণে নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তাহলে কী করা উচিত। তাহলে কি আমরা বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা থেকে পিছিয়ে যাব? না, তা নয়। আমাদের সালমির মডেলেই এগোতে হবে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশে সরকার উন্নয়নের সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি। সুতরাং সরকারকেই নির্মোহভাবে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা জার্মানির পলিটেকনিক বিশ্ববিদ্যালয় বা ভারতের আইআইটি, আইআইএসসির মডেল অনুসরণ করতে পারে। বাংলাদেশের লক্ষ্য হবে কম খরচে উচ্চসক্ষমতার উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করা। তবে এখানে যে সংস্কৃতি, তাতে পুরনোগুলোয় চেষ্টা না করে নতুন একটি মডেল বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দিকে মনোযোগ দেয়া যেতে পারে। মডেল বিশ্ববিদ্যালয়টির গবেষণা বরাদ্দ নিয়োগ হবে বৈশ্বিক, উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক এবং এখানে টিকে থাকার একমাত্র সূত্র যোগ্যতা। মানসম্পন্ন সুযোগের নিশ্চয়তা পেলে মেধাবীরা বাংলাদেশে জড়ো হতে পিছপা হবেন না।

প্রস্তাবিত মডেল বিশ্ববিদ্যালয়টি পাবলিক হলেও অনুসরণ করতে পারে নিউ পাবলিক ম্যানেজমেন্ট নির্দেশিত কৌশল: সরকারি খাতে বেসরকারি ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি। দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি শক্তিশালী অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে নীতিনির্ধারণী বিষয়ে পরামর্শ দেবে। মেধাতন্ত্রের চর্চা, দক্ষতা জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধা হবে এগিয়ে যাওয়ার মূলমন্ত্র। সেরা গবেষক পাবেন সর্বোচ্চ সুবিধা। মেধাকে প্রাধান্য দিয়ে সব জাতি-ধর্ম-বর্ণের জন্য এর দ্বার উন্মুক্ত রাখতে হবে। ব্রিটেনে রকম অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থার উপহার হলো ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাক পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সাজিদ জাভিদ; তারা দুজন মিলে সামলাচ্ছেন ব্রিটিশ অর্থ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অধিকন্তু, গবেষকদের হতে হবে সত্যানুসন্ধানী। সত্য বর্জন, বৌদ্ধিক ন্যায়পরায়ণতা আনুগত্যের ক্ষেত্রে আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের চেতনা ব্যতীত অন্য কোনো কিছুর কাছে গবেষকদের নতি স্বীকার হলো বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্বাসঘাতকতা। এমনটাই মনে করেন জার্মান নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক হার্মান হেসা। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট হাচিন্স ১৯৫৩ সালে বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হলো মুক্তচিন্তার কেন্দ্র। সত্যানুসন্ধান তার প্রকাশে বাধাহীন গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্যের চাবিকাঠি। সেজন্য সৃজনশীলতা উদ্ভাবনী প্রবণতার লালন করতে হবে।

ইউরোপীয় ফুটবলের ব্র্যান্ড ভ্যালু যেমন তারকা খেলোয়াড়দের কাছে টানে, ঠিক তেমনি ইউরোপ-আমেরিকার জগদ্বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বিশ্বের তাবৎ মেধাবীকে গুটিকয়েক শিক্ষাঙ্গনে জড়ো করে। প্রান্তিক দেশের জন্য তা ব্রেইন ড্রেইন হলেও উন্নত দেশের জন্য তা ব্রেইন গেইন খ্যাতিমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর খ্যাতি মূলত তাদের গবেষণা উদ্ভাবনের জন্য। সেজন্য তারা ইউনিক আইডিয়ার জন্য পুরো ভূভাগ থেকে জড়ো করে সেরাদের, সেরা ব্রিলিয়ান্ট শিক্ষক, শিক্ষার্থী গবেষকদের, যারা প্রতিষ্ঠানটিকে বিখ্যাত বানান। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব দেয়। তাই যে সময়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা মাস্টার্স পাস করে বের হন, সে সময়ে সেখানকার শিক্ষার্থীরা পিএইচডি শেষ করে ফেলেন। আরেকটি প্রশ্ন, হার্ভার্ড পাস করা শিক্ষার্থীরা কি সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন? চিন্তা করার মতো প্রশ্ন! হার্ভার্ড থেকে পাস করে শিক্ষার্থীরা আসলে কী করেন? হার্ভার্ড গ্র্যাজুয়েটদের বড় অংশটি উচ্চ বেতনে (৬১%) বৃহদাকার বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় বা আন্তর্জাতিক সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। এছাড়া উত্তীর্ণদের অনেকে গবেষণায় ক্যারিয়ার গড়েন। তবে উত্তীর্ণ হোক বা অনুত্তীর্ণ, বিশ্ববিদ্যালয়টির সংস্কৃতি তাদের অনেককে উদ্যোক্তা হওয়ার দিকেও ঠেলে দেয়। তাই দেখা যায়, বিশ্বের শতকোটি ডলার ক্লাবের সদস্যদের দশমিক শতাংশ হার্ভার্ডের সাবেক শিক্ষার্থী। এটি আবার একটি চেইন প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। বিলিয়নেয়াররা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে বিপুল পরিমাণ অর্থ দান বা উপহার প্রদান করে বিশ্ববিদ্যালয়ের এগিয়ে যাওয়ার পথ মসৃণ করেন। বোঝা যাচ্ছে, হার্ভার্ড স্নাতকরা নেতৃত্ব দেন। মার্ক জাকারবার্গ বা বিল গেটসের নাম  শোনেনি, প্রযুক্তিচালিত দুনিয়ায় এমন মানুষ খুব কমই আছে। জানেন কি তারা দুজনই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝরে পড়া শিক্ষার্থী। যেনতেন প্রতিষ্ঠান থেকে নয়, তারা ঝরে পড়েছিলেন হার্ভার্ড থেকে। হার্ভার্ড শুধু পাঁড় পড়ুয়াদের চায় না, প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার্থীদের এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিজকেও বেশ গুরুত্ব দেয়।

বর্তমানে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মূল কোর্সের পড়াশোনা সীমিত হয়ে পড়েছে। পাঠ্যবহির্ভূত কাজও সীমিত; লক্ষ্য শুধু সার্টিফিকেট অর্জন। মূল পড়াশোনা কেন্দ্রীভূত হয়েছে বিসিএস উত্তীর্ণ হয়ে সিভিল সার্ভিসে যোগদান করায়। কোন বিসিএসে বিশ্ববিদ্যালয়টির কয়জন টিকল, তা হয়ে দাঁড়িয়েছে সাফল্যের মাপকাঠি। তবে ইঞ্জিনিয়ারিং মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের উপরের সারির সাধারণ ক্যাডারগুলোর ওপর নজর পড়ায় এখন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আরো তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হচ্ছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সীমাবদ্ধতা অনেক। অবকাঠামো, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর হার, পাঠদান পদ্ধতি, শিক্ষা গবেষণার পরিবেশ, ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি, মেধাতন্ত্রের চর্চা, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়ানো, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম, স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা, নেতৃত্ব, নিয়োগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সমস্যা প্রকট। সমস্যা সমাধানে সরকারের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাক্তন শিক্ষার্থীদেরও অবদান রাখার সুযোগ আছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অনেক শিক্ষার্থী কোটিপতি হলেও হার্ভার্ডিয়ানদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়কে উপহার প্রদানের নজির খুব বেশি সৃষ্টি করেননি। মোটের ওপর একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে মানসম্পন্ন হতে হলে কী করতে হবে, তার একটি দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় ইউরোপিয়ান কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স এজেন্সির গাইডলাইনে। প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নির্ধারণে আটটি বিষয়কে বিবেচনা করেছে। এগুলো হলো যুগোপযোগী মিশন কৌশল, গুণগত মানের নিশ্চায়ন, স্বচ্ছ দায়িত্বশীল শাসন; শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিখন-শেখানো পদ্ধতির প্রয়োগ; আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা; কমিউনিটির অংশগ্রহণ; যোগ্যদের নিয়োগ, গবেষণার স্বাধীনতা প্রদান প্রয়োজনানুযায়ী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং অর্থের সংস্থান বহিস্থ অডিটিংয়ের জন্য আর্থিক হিসাব উন্মুক্তকরণ। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও মানদণ্ড অনুসরণ করে কাঙ্ক্ষিত পথে অগ্রসর হতে পারে।  

 

. জাহাঙ্গীর এইচ মজুমদার: শিক্ষক গবেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন